X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

রাজনীতি:‘পুলিশি’ ও ‘নালিশি’

শুভ কিবরিয়া
২১ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৬:০৮আপডেট : ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৬:১১

শুভ কিবরিয়া

নির্বাচনের সময় এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন দলের জোট গঠন প্রক্রিয়া যেমন এগুচ্ছে তেমনি বড় দুই দলের বাহাসও প্রত্যক্ষ হচ্ছে। বিএনপি ইতোমধ্যে জাতিসংঘে গিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর নজর রাখতে অনুরোধ করেছে। অন্যদিকে সরকার বিএনপির এই প্রক্রিয়াকে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার প্রয়াস বলে আওয়াজ তুলেছে। আওয়ামী লীগ বলছে বিএনপি এখন ‘নালিশ পার্টি’ হয়ে গেছে। অন্যদিকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ভাষায়, চলমান রাজনৈতিক সংকটের বিষয়টি তারা জাতিসংঘের কাছে তুলে ধরেছেন।

রাজনীতির এই বাহাস কিছুটা অনিশ্চয়তাও তৈরি করছে।

প্রশ্ন জাগছে নির্দিষ্ট সময়ে একাদশ সংসদ নির্বাচন হবে কি? হলে কীভাবে হবে? সরকারি দল যেভাবে নির্বাচন করতে চাইছে তার নমুনা অতীতে তারা দেখিয়েছে। আবার বিএনপি যা চাইছে, তা পেতে তারা কী করতে পারে তার দৃষ্টান্তও তারা রেখেছে। তাহলে কী হবে নিকট ভবিষ্যতে?

সরকারি দল কি তার বর্তমান অবস্থা অনড় ধরেই এগুবে। বিএনপি বা অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলো কি এমন কোনও চাপ তৈরি করতে পারবে যেখানে সরকারি দল তাদের অবস্থান পাল্টাতে পারে? সেরকম কোনও সম্ভাবনা কি বর্তমানের রাজনীতিতে আছে? আপাতত সেই সম্ভাবনা না থাকলেও ভবিষ্যতে কি সেরকম কোনও পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা চলতে পারে? এসব অনেক  প্রশ্ন জনমনে জাগছে। নির্বাচনের নির্দিষ্ট সময়ের দুয়ারে এসেও তাই রাজনীতি ও নির্বাচন নিয়ে জল্পনা থামছে না।

দুই.

রাজনীতির এই উত্তাপ ও অনিশ্চয়তার মধ্যেই ‘যুক্তফ্রন্ট’ রাজনীতিতে জাতীয় ঐক্যের ডাক নিয়ে হাজির হয়েছে। এতদিন রাজনীতিতে আ’.লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট এবং বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট কার্যকর ছিল। ভোট যত এগিয়ে আসছে ততই জোটের রাজনীতি নতুন চেহারা নিচ্ছে। ড. কামাল হোসেন, বদরুদ্দোজা চৌধুরী, মাহামুদুর রহমান মান্না, আ স ম আব্দুর রবের সমন্বয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়েছে। ভোটের হিসেবে এসব দলের শক্তি খুব জোরালো নয়। কিন্তু ব্যক্তিত্ব এবং জনদাবির প্রেক্ষিতে এই ‘যুক্তফ্রন্ট’ ইতোমধ্যে আলোচনায় এসেছে। ন্যূনতম শর্তে যুক্তফ্রন্ট যদি বিএনপির সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলে তবে তা সরকারের জন্য কি বড় সংকট তৈরি করবে? সরকার এই চাপ কীভাবে মোকাবিলা করবে?

প্রথমত সরকার চাইবে ১৪ দলীয় জোটকে সম্প্রসারিত করতে। অপরাপর বাম দলগুলো ও ডানপন্থী ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে একাট্টা করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীনে আনতে। জাতীয় পার্টি যাতে কোনোরকমে অন্যপথে পা না বাড়ায় সেই চেষ্টা অব্যাহত রাখতে চাইবে ক্ষমতাসীন দল। এগুলো হচ্ছে নির্বাচনি কৌশল। যদি নির্বাচন হয় তবেই এসব খেলা মাঠে আরও নানারূপে দেখা যাবে।

কিন্তু সরকার কি সেই পথে হাঁটতে চাইবে?

তিন.

সরকার কেন বিএনপির প্রত্যাশা মতো একটি নির্বাচনে যেতে চাইবে?

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ‘অন্যরকম’ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ সাফল্যের সঙ্গে সকল বাধা অতিক্রম করেছে। সে কারণেই তারা বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী নিজেদের নিয়ন্ত্রণে সরকার, প্রশাসন রেখেই নির্বাচন করতে চায়। দেশের শাসনদন্ডসহ সবরকম রাষ্ট্রিক সুবিধাদি তাদের হাতেই শক্তভাবে পরিচালিত হচ্ছে। তারা অধিক উন্নয়ন দিয়ে কম গণতন্ত্র চালু রাখার নীতিতে যে সাফল্য পেয়েছে তাকে ধরেই অগ্রসর হতে চায়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রভাব রাখতে পারে যেসব আঞ্চলিক বা আন্তর্জাতিক শক্তি,  যেমন- ভারত বা আমেরিকা কিংবা চীন অথবা রাশিয়া তাদের সবার সমর্থন এখনও ধরে রেখেছে আওয়ামী লীগ।

এর বাইরে আছে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক শক্তি। তাই আওয়ামী লীগ নির্বাচন ব্যবস্থাকে নিজেদের আওতায় নিয়েই আগামী নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সাফল্য পেতে চায়। চলমান উন্নয়নের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে চায়।

চার.

তাহলে আওয়ামী লীগের জন্য চ্যালেঞ্জ কোথায়?

আগামী সংসদ নির্বাচন ‘নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন’-এর বাইরে গেলে ভোটের হাওয়া আওয়ামী লীগকে স্বস্তি দেবে কিনা, সে বিষয়ে তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত ভেতরে ভেতরে একটা অস্বস্তি আছে। তাই আওয়ামী লীগ চাইবে যেভাবে তারা উপজেলা পরিষদ, ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, সিটি করপোরেশনের নির্বাচন করে এসেছে ঠিক সেই মডেলে আগামী সংসদ নির্বাচন করতে। কিন্তু এবার সেটা বাস্তবায়ন করা আওয়ামী লীগের জন্য সহজ হবে কিনা? যেসব নতুন জোট তৈরি হচ্ছে এরা এক্ষেত্রে কোনও বাধা তৈরি করে কিনা?

আওয়ামী লীগ গত এক দশকে বিশেষ করে গত পাঁচ বছরে যেভাবে বিএনপিকে পুলিশি কায়দায় মোকাবিলা করেছে সেই আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতেই বিএনপিকে কোণঠাসা করতে চাইবে। বিএনপি যাতে কোনও ঐক্যবদ্ধ জোট তৈরি করে সরকারের বিরুদ্ধে বড় চাপ তৈরি না করতে পারে সেজন্য বিএনপিকে মাঠ থেকে দূরে রাখার সম্ভাব্য সকল পদক্ষেপই নেবে আওয়ামী লীগ। কিন্তু শেষাবধি বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রাখা যাবে কিনা? অপরপক্ষে গতবারের মতো বিএনপি নির্জীবতার পরিচয় দেবে কিনা?

দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে নির্যাতিত মানুষ যেভাবে ঘুরে দাঁড়ায় সেভাবেই বিএনপি ও তার মিত্ররা অস্তিত্বের প্রশ্নে যদি ঘুরে দাড়ায় সেটা কি শুধু পুলিশি কায়দায় সামাল দিতে পারবে আ. লীগ, বিশেষত নির্বাচনের সময়।

পাঁচ.

নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বড় শত্রু হতে পারে তার ঘরের বিবাদ। ২০০৮ সালের পর থেকে টানা প্রায় দশ বছর ধরে নিরঙ্কুশ ক্ষমতায় আছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। দলের ক্ষমতাবান নেতারা তাদের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ভিত যথেষ্ট শক্তিশালী করতে পেরেছেন। দলের মধ্যে অনেক নতুন নতুন ক্ষমতাবান মানুষের উদ্ভব হয়েছে। ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা, শিল্পপতিদের যথেষ্ট সমাবেশ ঘটেছে দলের মধ্যে। দলের ক্ষমতাবান নেতাকর্মীদের একটা বড় অংশ নতুন করে সম্পদশালী হয়েছেন। আবার অনেকেই এ সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। তাছাড়া দলের ছাত্র, যুব সংগঠন থেকে অনেক নতুন নতুন নেতার আবির্ভাব ঘটেছে। ফলে সকল সংসদীয় আসনে আ’লীগের একাধিক প্রার্থী নির্বাচনে মনোনয়ন চাইবেন। দলের বঞ্চিত অংশ ও সুবিধা পাওয়া অংশের যে পক্ষ মনোনয়ন পাবেন তার বিপরীতে একটা শক্তিমান অংশ দাঁড়িয়ে যাবে। প্রকাশ্যে না পারলেও তারা গোপনে দলের প্রার্থীর বিরুদ্ধে সর্বশক্তি নিয়োগ করবেন। ফলে, ন্যূনতম গ্রহণযোগ্য নির্বাচনি পরিবেশ তৈরি হলে আ’লীগের বিরুদ্ধেই লড়তে হবে আ’লীগকে।

দশম সংসদ নির্বাচনে আন্তর্জাতিক মহলের শক্তিমান অংশ বিশেষত ভারতীয় এস্টাবলিস্টমেন্ট প্রকাশ্যে আ’লীগের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল। এবার কী হবে?

ছয়.

আপাতত এসব চ্যালেঞ্জ থাকছে সরকারি দলের জন্য। কিন্তু তাদের ভরসা শেষ পর্যন্ত দলনেত্রী শেখ হাসিনা। এ পর্যন্ত তিনি যেভাবে সকল বাধা কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন আগামী দিনের সকল বাধা সেভাবেই উৎরাতে পারবেন বলেই আ’লীগের বড় অংশের ধারণা। শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কৌশল আর শক্তিশালী নেতৃত্বের কাছে বিএনপির জেলে থাকা, নির্বাসনে থাকা নেতৃত্ব কিংবা  কথিত ‘যুক্তফ্রন্ট’ আদৌ হালে পানি পাবে কিনা, সেটাই এখন মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন। শেখ হাসিনার শক্তিমত্ত রাজনীতির কাছে বিএনপির নালিশি রাজনীতি প্রতিকূলতা ঠেলে এগুতে পারবে কিনা দেখার বিষয় সেটাও।

রাজনীতির শেষ খেলা দেখার জন্য তাই আমাদের আরও অপেক্ষা করতে হবে।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক।

 

/ওএমএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
২৪ ঘণ্টার মধ্যে মেট্রোরেল লাইনের ওপর থেকে ক্যাবল সরানোর অনুরোধ
২৪ ঘণ্টার মধ্যে মেট্রোরেল লাইনের ওপর থেকে ক্যাবল সরানোর অনুরোধ
ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ‘জেনোসাইড কর্নার’ বন্ধ থাকায় সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রীর অসন্তোষ
ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ‘জেনোসাইড কর্নার’ বন্ধ থাকায় সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রীর অসন্তোষ
ইতিহাস বিকৃতিতে ব্যর্থ হয়ে বিএনপি আবোল-তাবোল বলছে: হাছান মাহমুদ
ইতিহাস বিকৃতিতে ব্যর্থ হয়ে বিএনপি আবোল-তাবোল বলছে: হাছান মাহমুদ
শাহীনকে সরিয়ে বাবরকে নেতৃত্বে ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে পিসিবি!
শাহীনকে সরিয়ে বাবরকে নেতৃত্বে ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে পিসিবি!
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ