X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

মহানগর নাট্যমঞ্চে নতুন নাটক!

প্রভাষ আমিন
২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৫:৩৭আপডেট : ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৫:৪৭

প্রভাষ আমিন একসময় বাংলাদেশে নাটকপাড়া বললেই মানুষ বুঝতো বেইলি রোড। সেখানে মহিলা সমিতি আর গাইড হাউস মিলনায়তনকে কেন্দ্র করেই বাংলাদেশে বিকশিত হয় মঞ্চনাটক চর্চা। কিন্তু ঐতিহ্য দিয়ে সবসময় চাহিদা মেটে না। নাট্যকর্মীরা আধুনিক, আরামদায়ক বিকল্প খুঁজছিলেন। এখন অবশ্য বাংলাদেশের মঞ্চনাটক অনেকটাই শিল্পকলা একাডেমিকেন্দ্রিক। তবে নাট্যকর্মীদের দাবির মুখে অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশন গুলিস্তানে নির্মাণ করেছিল মহানগর নাট্যমঞ্চ। কিন্তু নামে নাট্যমঞ্চ হলেও এখানে কখনও নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে বলে আমার মনে পড়ে না। তবে হ্যাঁ, এখানে মাঝে মধ্যে রাজনৈতিক নাটক মঞ্চস্থ হয়, যার সর্বশেষটি হলো ২২ সেপ্টেম্বর।
টানা ১০ বছর একটি দল ক্ষমতায়; যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, দুঃশাসন, লুটপাট, মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া, মানবাধিকার লঙ্ঘন, গুম, খুন, দখল, চাঁদাবাজির এন্তার অভিযোগ- তাদের হটানোর জন্য একটা বৃহত্তর ঐক্য হতেই পারে। সেটা দোষের কিছু নয়। নাটকীয়তাটা আসলে মঞ্চে উপস্থিতির বৈচিত্র্যে। কট্টর বাম জোনায়েদ সাকি যেমন ছিলেন, ছিলেন চরম ডান হেফাজতে ইসলামী নেতা মাওলানা নুর হোসাইন কাসেমীও। ১/১১’র বিপ্লবী ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন যে মঞ্চে বসে ঘুমাচ্ছিলেন; সেই মঞ্চ থেকেই ঘোষণাপত্র পাঠ করেন সদা বিপ্লবী, সব অন্যায়ের প্রতিবাদে সামনের সারিতে থেকে সবার শ্রদ্ধা কুড়ানো প্রকৌশলী শহীদুল্লাহ।

বলছিলাম ব্যারিস্টার মইনুলের ঘুমের কথা। তবে ব্যারিস্টারকে একা দোষ দেওয়াটা অন্যায় হবে। একটা ছবিতে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার মঞ্চের সামনের সারিতে চার নেতাকে দেখা যাচ্ছে। তাদের মধ্যে লন্ডন, আমেরিকা, জাতিসংঘ, নির্বাচন, আন্দোলন, কারাগার নিয়ে চিন্তায় অস্থির মির্জা ফখরুল জেগে আছেন। আর যার ডাকে বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে থেকে লাখ লাখ লোক ঢাকায় আসতে চেয়েও মহানগর নাট্যমঞ্চে জায়গা হবে না ভেবে আসতে পারেননি, সেই ড. কামাল হোসেন ঘুমাচ্ছেন। আমার ধারণা বি চৌধুরী সত্যি সত্যি কিছুটা অসুস্থ। গত সপ্তাহে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার অনুষ্ঠানে তার না থাকা নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। তাই এবার মান ভেঙে এসে লম্বা অনুষ্ঠানের এক ফাঁকে ঘুমিয়ে গেছেন। আর ব্যারিস্টার মইনুলরা তো সারা বছর ঘুমিয়েই থাকেন। ১/১১ বা ক্ষমতার গন্ধ পেলে আড়মোড়া ভেঙে শীতনিদ্রা থেকে ওঠেন। তবে ঘুমের রেশ রয়ে যায়। এই ছবি নিয়ে দেখি ফেসবুকে  অনেকে ট্রল করছেন। জাতিকে জাগাতে এসে নিজেরাই ঘুমিয়ে পড়েছেন বলে অনেকে হাসি-ঠাট্টা করছেন। জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার নেতাদের যা বয়স, তাতে দুপুরের খাওয়ার পর একটা ভাতঘুম তারা ডিজার্ভ করেন। কিন্তু গণতন্ত্রের জন্য তারা ভাতঘুমের আয়েশ ছেড়ে মাঠে নেমেছেন। তাদের দেশপ্রেম কাহিনি অমর হয়ে থাকবে। তারা ঘুমাচ্ছেন, এমন নেতিবাচক ভাবনা বাদ দিয়ে ইতিবাচকভাবেও কিন্তু ভাবা যায়। তারা আসলে ঘুমাচ্ছিলেন না, ‘জালিম সরকার’-এর হাত থেকে দেশকে রক্ষার উপায়ের কথা গভীরভাবে ভাবছিলেন। দৃষ্টিভঙ্গি বদলান, জীবন বদলে যাবে।

ফেসবুকে প্রিয় সাংবাদিক মোস্তফা ফিরোজ ভাই এই প্রবীণদের নিয়ে রসিকতা বা উপহাস না করে প্রয়োজনে তাদের কাজের সমালোচনা করার পরামর্শ দিয়েছেন। আমি তার সঙ্গে পুরোপুরি একমত। কিন্তু সমস্যা হলো, জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার কোনও কথায় আমি সমালোচনা করার উপাদান পাই না। তারা যা বলেন, সব একদম আমার মনের কথা। তারা গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা চান, আইনের শাসন চান, সৎ ও যোগ্য প্রার্থীর মনোনয়ন চান, সুষ্ঠু নির্বাচন চান, ক্ষমতার ভারসাম্য চান, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ চান। সত্যি বলছি, সব একদম আমার মনের কথা। শুনতে শুনতে আমি এতটাই মুগ্ধ হয়ে আছি, ভাবছি, আমার এলাকায় দাঁড়ালে ড. কামাল হোসেনকে একটা ভোট দেবো। কিন্তু সমস্যা হলো, আমার একার ভোটে তো তিনি পাস করবেন না। জিততে হলে চাই আমজনতার ভোট। সমস্যা হলো, আমজনতা এই ভালো ভালো কথাগুলো বুঝতে পারছে না। আমি কিন্তু অনেক দিন ধরেই বলে আসছি, সংখ্যাগরিষ্ঠতার গণতন্ত্রে আমার আস্থা নেই। আমি বিশ্বাস করি ন্যায্যতার গণতন্ত্রে। বঙ্গবন্ধু শিখিয়ে গেছেন, কেউ ন্যায্য কথা বললে, একজন হলেও তার কথা মানতে। কিন্তু সমস্যা হলো, বাংলাদেশে এখনও সংখ্যারিষ্ঠের গণতন্ত্রই প্রতিষ্ঠিত। তাই ড. কামালদের ন্যায্য কথা শোনার লোক নেই, তারা পিছিয়েই থাকেন। তবু কাউকে না কাউকে ন্যায্য কথা বলে যেতেই হবে।

জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া বিএনপির কাঁধে চেপে আমজনতার কাছে তাদের ন্যায্য কথাগুলো পৌঁছে দিতে চায়। আর বিএনপি চায়, জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার ইমেজের সিঁড়ি বেয়ে ক্ষমতায় যেতে বা অন্তত আওয়ামী লীগকে সরাতে।

জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার দফা, দাবি, উদ্দেশ্য, লক্ষ্য, ঘোষণা সব অতি সাধু। আমার খালি একটা জায়গায় আপত্তি- টাইমিং। ভালো ভালো মানুষগুলোর তো সারা বছর ন্যায্য কথাগুলো বলার কথা, বলা উচিত। কিন্তু নির্বাচনের তিন মাস আগে কেন তারা ঐক্য করেন! তার মানে তাদেরও খায়েশ আছে নির্বাচন করার, খোয়াব আছে ক্ষমতায় যায়। সেটার জন্য কিন্তু জনগণের ভোট লাগবে; ড. কামাল যেমন চান, সেই গণজাগরণ লাগবে। কিন্তু তিন মাসে ভোট বিপ্লব বা গণজাগরণের স্বপ্ন জেগে দেখা সম্ভব নয়; ঘুমিয়েই দেখতে হবে। হয়তো মঞ্চে তারা তাই করছিলেন।

বলছিলাম মহানগর নাট্যমঞ্চে লোকসমাগমের কথা। জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া কিন্তু প্রথমে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই সমাবেশ করতে চেয়েছিল। অনুমতি না পেয়ে যেন তারা হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন। কোনও আপত্তি বা প্রতিবাদ না করেই তারা চলে যান মহানগর নাট্যমঞ্চে। শুনে ক্ষোভ প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি তাৎক্ষণিকভাকে ডিএমপি কমিশনারকে নির্দেশ দেন জাতীয় ঐক্যকে যেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করতে দেওয়া হয়, প্রয়োজনে মঞ্চ বানিয়ে দেওয়ার ঘোষণাও দেন তিনি। ভাববেন না প্রধানমন্ত্রী ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে এই অনুমতির ব্যবস্থা করেছেন। তিনি আসলে কৌশলে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়াকে একটা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলেন, পারলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করে দেখান। কিন্তু সেই চ্যালেঞ্জটা নেয়নি ঐক্য প্রক্রিয়া। ডিএমপি থেকে যোগাযোগ করা হলেও তারা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যেতে রাজি হননি। মহানগর নাট্যমঞ্চে যারা এসেছেন, বেগম জিয়ার মুক্তির দাবিতে স্লোগান দিয়ে তাদের বেশিরভাগই নিজেদের পরিচয় নিশ্চিত করেছেন। ড. কামাল জানেন, তার ডাকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যত লোক আসবে; তারচেয়ে বেশি লোক প্রতিদিন সেখানে বুট-বাদাম আর গাঁজা খেতে যায়। তাই আমি বারবার বলছি, ড. কামাল হোসেনরা যদি পলিটিক্যাল থিঙ্কট্যাঙ্ক হিসেবে কাজ করতেন, জাতির বিবেক হিসেবে দল নির্বিশেষে সবার ভুল ধরিয়ে দিতেন; সবাই তাদের শ্রদ্ধা করতো, ভালোবাসতো। কিন্তু তারা যখন ক্ষমতামুখী রাজনীতির মাঠে নামেন; তখন তাদের জনসমর্থন, ভোট নিয়ে কথা উঠবে; তাদের নানা উপহাস-বিদ্রুপ সইতে হবে। চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার অথবা হজম করার মতো সহিষ্ণুতা থাকতে হবো।

এতদিন কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতারা যুক্তফ্রন্ট আর জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়াকে স্বাগতই জানাচ্ছিলেন। কিন্তু বিএনপি সেই ঐক্য প্রক্রিয়ায় যুক্ত হলেন, তখনই তাদের গায়ে যেন জ্বালা ধরেছে। আওয়ামী লীগ নেতারা কোরাস ধরেছেন, এটা অশুভ শক্তির ঐক্য, এটা ষড়যন্ত্র। আসলে বিএনপির ভোট আর জাতীয় ঐক্যের ইমেজ আওয়ামী লীগকে বেকায়দায় ফেলতে পারে; এটাই তাদের ভয়। তবে শেখ হাসিনার মধ্যে কোনও ভয় নেই। তিনি বারবার বলছেন, জনগণ ভোট দিলে ক্ষমতায় যাবেন, নইলে নয়। তাই অপেক্ষা করুন। জনগণ যাদের ভোট দেবে, তারাই ক্ষমতায় যাক।

আমে দুধে মিশে গেলে আঁটি গড়াগড়ি খায়। আগামী নির্বাচনে কে যে আঁটি হবে বোঝা মুশকিল। আমে-দুধে তবু মেশে। কিন্তু তেলে আর জলে তো কখনোই মেশে না। ড. কামাল হোসেন  ‘অসম্ভবকে সম্ভব’ করতে চাইছেন। চরম ডান, চরম বাম, চরম ধান্দাবাজ, চরম সুবিধাবাদীদের একসঙ্গে ঘুটা দিয়ে তিনি কী স্যালাইন বানাতে চাইছেন আল্লাহ মালুম। তবে নুর হোসাইন কাসেমী আর জোনায়েদ সাকির চাওয়াটাকে এক বিন্দুতে মিলিয়ে দিতে পারাটাই আপাতত জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার সবচেয়ে বড় অর্জন।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
কান উৎসব ২০২৪জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ