X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড: কতটা প্রস্তুত বাংলাদেশ

লীনা পারভীন
২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৫:৩১আপডেট : ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৫:৩৩

লীনা পারভীন অনেক দিন ধরেই আমরা শুনে আসছি বর্তমান বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ হচ্ছে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড। কিন্তু এই ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড শব্দটার অর্থ হয়তো অনেকের কাছেই অপরিচিত। আমি নিজেও খুব একটা পরিষ্কার ছিলাম না কিছু দিন আগেও। তবে জেনে এসেছিলাম যে যখন কোনও দেশের বেশিরভাগ জনগোষ্ঠী একটি কর্মক্ষম বয়সের মাঝে অবস্থান করে তাকে এই নামে ডাকা হয়। নিজের আগ্রহেই সামান্য পড়াশুনা করেছি। জানতে চেয়েছি যে দেশের জনসংখ্যা ছিল সবচেয়ে বড় সমস্যা। ছোটবেলা থেকেই রচনা মুখস্থ করে এসেছি, পরীক্ষার খাতায় লিখেছি বাংলাদেশের এক নম্বর সমস্যা হচ্ছে এর বাড়তি জনসংখ্যা। সেই দেশে এই সমস্যা কেমন করে সুবিধায় পরিণত হলো? কী এমন জাদু আছে যে কয়েক বছরের মাঝেই এক নম্বর সমস্যা হয়ে গেলো এক নম্বর সুবিধা।
বাংলাদেশে বর্তমানে মোট জনসংখ্যার ৬৮ শতাংশ কর্মক্ষম, যাদের বয়স ১৫ থেকে ৬৪ বছর। আমাদের দেশ ২০৪১ সালে উন্নত রাষ্ট্র হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে চলেছে এবং দেশের সকল উন্নয়ন পরিকল্পনা ও উন্নয়নের ইন্ডিকেটর সবদিকেই সেই ইঙ্গিত বহন করছে।

এবার আসা যাক ডেমোগ্রাফ্রিক ডিভিডেন্ড, যাকে বাংলায় জনবৈজ্ঞানিক মুনাফাও বলা যায়, সেটা আসলে কী? কেন বাংলাদেশ এখানে সুবিধাপ্রাপ্ত একটি দেশ? এর অর্থনৈতিক প্রভাবইবা কেমন করে জাতীয় উন্নতিতে কার্যকর হয়।

ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড হচ্ছে যখন একটি দেশের বেশিরভাগ জনসংখ্যাই কর্মক্ষম বয়সের মাঝে অবস্থান করে। জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপি) প্রদত্ত সংজ্ঞা অনুযায়ী, যখন কোনও দেশের কর্মক্ষমহীন মানুষের চেয়ে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা বেশি থাকে এবং সেটা যখন অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখে, তখনই তাকে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বলা হয়। এখানে কর্মক্ষম মানুষের নির্ধারক হচ্ছে তাদের বয়স অর্থাৎ ১৫ থেকে ৬৪, আর কর্মক্ষমহীন মানুষ বলতে বুঝায় ১৪-এর নিচের এবং ৬৫-এর বেশি বয়সের মানুষকে।

যেহেতু বাংলাদেশে এখন বেশিরভাগ মানুষ (৬৮%) কর্মক্ষম বয়সের সীমায় অবস্থিত তাই বাংলাদেশ এই প্রাকৃতিক সুবিধার আওতায় আছে। বলা হয় এই সুবিধা কোনও একটি দেশে কেবল একবারই আসে এবং এর স্থায়িত্ব ধরে নেওয়া হয় ৩০/৩৫ বছর পর্যন্ত। তাহলে এরপর কী হবে? হিসাবটা খুব সহজ। ৩০/৩৫ বছর পর এই কর্মক্ষম মানুষগুলোর প্রায় সবাই বৃদ্ধ হয়ে কর্মক্ষমহীন হয়ে যাবে। একদিকে জনসংখ্যার আধিক্য ঠেকাতে পরিকল্পিত পরিবারের আহ্বান, অন্যদিকে শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস, গর্ভকালীন মায়ের মৃত্যুহার হ্রাস ইত্যাদি কারণেই ঘটে থাকে এই সুবিধা প্রাপ্তি। এবং এই কর্মযজ্ঞ একদিনের নয়। আর এটাই হচ্ছে ম্যাজিকাল স্ট্যান্ড যেখানে এক নম্বর সমস্যা হয়ে যায় এক নম্বর সুবিধা।

আমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে বাংলাদেশ এই সবক’টি ক্ষেত্রেই অত্যন্ত সফল এবং অন্যান্য দেশের জন্যও উদাহরণ তৈরি করতে পেরেছে। একসময়ের জনাধ্যিক্য আজ  হয়ে গেলো জনমুনাফা। প্রকৃতির কী খেলা। আসলেই কী এটা প্রকৃতির খেলা নাকি একটি দেশের পরিকল্পিত কাঠামোর অংশ এটি? সে বিতর্কে না হয় নাইবা গেলাম। এটি পাঠকেরাই ঠিক বুঝে নিক।

কিন্তু কথা হচ্ছে আমাদের দেশ এই সুবিধা থেকে কতটা রেজাল্ট নিতে পারছে বা পারবে। যদি ৩০/৩৫ বছর পর এর মেয়াদ না থাকে তাহলে আমরা কি যথেষ্ট পরিকল্পনামাফিক এগুতে পারছি?  আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে এর জন্য আবার তেমন পরিকল্পনার কী দরকার? চীনের মতো দেশ এখন তারুণ্য সংকটে ভুগছে। তাদের কর্মক্ষমহীন মানুষের সংখ্যা বেড়ে গেছে অনেক এবং এটাই এখন তাদের জন্য বিরাট সমস্যা ও জাতীয় ভোগান্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ বৃদ্ধ মানুষের পেছনে রাষ্ট্রকে বিনিয়োগ করতে হয় অনেক। তাদের চিকিৎসা ও ভরণপোষণই হয়ে যায় প্রধান খরচের জায়গা যেখান থেকে রিটার্ন আসে না। স্বাধীনতার পর আমাদের দেশে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩৬ ভাগ যাদের অর্ধেক ছিল নারী। যারা ঘরে বসে থাকতো। অর্থাৎ প্রায় ২০-২২ ভাগ মানুষ টেনে নিয়ে চলেছিলো সিংহভাগ জনগোষ্ঠীকে যারা অন্যের ওপর নির্ভর করে জীবন চালিয়েছিলো। আর কর্মক্ষমহীনের সংখ্যা ছিল ৬৪ ভাগ। ২০১৭ সালের হিসাব বলছে প্রায় ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে নারী ও পুরুষের সংখ্যা এখন প্রায় সমান সমান (বাংলা ট্রিবিউনে প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী)।

স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত চিত্র অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এখন আমাদের দেশে কর্মহীন নারীর সংখ্যা অনেক কম। নারীরাও এখন আয় -রোজগার করছে, সংসার চালাচ্ছে। জাতীয় আয়ে নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে অনেকগুণ। এমনকি বিদেশে শ্রমবাজার গড়ে উঠেছে বিশাল।

এখন যেটা দরকার সেটা হচ্ছে একটু সুন্দর ও সুষ্ঠু উন্নয়ন পরিকল্পনা যাতে করে ৩০/৩৫ বছর পর গিয়েও আমরা এই সুবিধাজনক অবস্থান থেকে ছিটকে না পড়ি। কী সেই পরিকল্পনা? সেটি হতে হবে পরিকল্পিত পরিবার গঠন যেখানে ছোট পরিবার গঠনের স্লোগান থেকে কিছুটা হলেও সরে আসা। পরিকল্পিত শিক্ষাব্যবস্থা, কর্মসংস্থানের যথাযথ ব্যবস্থা করা। মানবসম্পদকে প্রকৃত সম্পদে পরিণত করার লক্ষ্যে কর্মপরিকল্পনার ভিত্তিতে তাদের দক্ষতা উন্নয়নের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। নারী শিক্ষাকে আরও উন্মুক্ত করে দেওয়া এবং নারীর জন্য কর্মসহায়ক পরিবেশ ও সুযোগের সৃষ্টি করা। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দিকে আরও মনোযোগী হওয়া যাতে করে যারা বয়স্ক হয়ে পড়ছেন তাদের জন্য সুচিকিৎসার ব্যবস্থা নিশ্চিত হয়। সুচিকিৎসার অভাবে যেন আমাদের দেশের লোক এই খাতে দেশে খরচ না করে বিদেশে চলে না যায়। বয়সভিত্তিক জনগোষ্ঠীর একটি সুশৃঙ্খল তালিকা করা এখনই প্রয়োজন এবং এই হিসাব যদি সরকারের হাতে থাকে তাহলে বয়সভিত্তিক সুযোগ সুবিধা ও করণীয় ঠিক করা অনেক সহজ হয়ে যাবে।

ঢালাও সবজায়গাতেই ফোকাস না করে প্রয়োজন ও সময় অনুযায়ী ফোকাস করাই হবে সময়ের সঠিক কাজ। এ কাজে সরকার যেমন তার নিজের মন্ত্রণালয় ও সরকারি কাঠামোকে কাজে লাগাতে পারে ঠিক তেমনি প্রয়োজন আছে বেসরকারি পর্যায়ের অংশগ্রহণও। কিন্তু বাস্তবে অবস্থা কি সেটাকে সমর্থন করছে? আমাদের সরকারের দিকে তাকালে যেমন অনেক উন্নয়ন পরিকল্পনার নিদর্শন পাওয়া যায় আবার কিছু অপরিকল্পিত কার্যক্রম বা যথাযথ পদক্ষেপেরও অভাব দেখা যায়। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কি এই বিষয়ে যথাযথ গবেষণা করে তাদের করণীয় নির্ধারণে কাজ করছে? আমরা জনগণ এই বিষয়ে যথেষ্ট অন্ধকারের মাঝেই আছি। আমরা এটাও জানি যে আমাদের দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা কোনও উন্নয়নকেই ধারাবাহিকভাবে টিকে থাকতে সাহায্য করে না। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গেই চিত্র পালটে যায়। এই বাস্তবতা থেকেও সরে আসার সঠিক সময় এখন। আমাদের জনগণকেও বুঝতে হবে আমাদের দেশ একদিন উন্নত দেশ হতে গেলে দরকার সরকারের ধারাবাহিকতা। যে পরিকল্পনা নিয়ে বর্তমান সরকার আগাচ্ছে সেগুলোকে ইতিবাচকভাবে চালাতে গেলে অবশ্যই এর ধারাবাহিকতার কোনও বিকল্প নেই, তবে সরকারকেও তার আগে নির্ধারণ করতে হবে তারা তাদের প্রশাসনিক দুর্বলতাকে কেমন করে কাটিয়ে ওঠে জনগণের আস্থাকে নিজেদের সুবিধায় পরিণত করতে পারবে।

লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
একযুগ পর দলছুট, সঙ্গে সঞ্জীব চৌধুরী
একযুগ পর দলছুট, সঙ্গে সঞ্জীব চৌধুরী
সুন্দরবনে মধু সংগ্রহ করা ব্যক্তির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো বাঘ, নিয়ে গেলো গহীন বনে
সুন্দরবনে মধু সংগ্রহ করা ব্যক্তির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো বাঘ, নিয়ে গেলো গহীন বনে
ট্রাম্পের বিচার চলাকালে আদালতের বাইরে গায়ে আগুন দিলেন এক ব্যক্তি
ট্রাম্পের বিচার চলাকালে আদালতের বাইরে গায়ে আগুন দিলেন এক ব্যক্তি
দুই জনপ্রতিনিধির নাম বলে সাভারে সাংবাদিকের ওপর কেমিক্যাল নিক্ষেপ
দুই জনপ্রতিনিধির নাম বলে সাভারে সাংবাদিকের ওপর কেমিক্যাল নিক্ষেপ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ