X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

এমনও হয়

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৬:৪৯আপডেট : ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৬:৫৭

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা গণতন্ত্রের তিন স্তম্ভের মধ্যে বিচার বিভাগ সতত স্বতন্ত্র, তার গৌরব, মর্যাদা, দায়িত্ব—সবই অন্য সব বিভাগ থেকে অনেক বেশি। আর সেই ‘বেশি’ গৌরব ও মর্যাদা কতখানি রক্ষা করা সম্ভব, তার ওপরই নির্ভরশীল গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ। নির্ভরশীল বাকি বিভাগসমূহের কর্মক্ষমতাও।
বিচারপতি মানেই আমাদের কাছে এমন এক ব্যক্তি, যিনি চারিত্রিক দৃঢ়তার দিক দিয়ে অভ্রান্ত, এমনই দৃঢ় ও মর্যাদাময়, যাতে তিনি প্রয়োজনে শাসন বিভাগের বিরুদ্ধেও শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলতে পারেন। বাংলাদেশের বিচার বিভাগ নিয়ে কথা বলতে গেলে এসব কথা সামনে আসে। সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘আ ব্রোকেন ড্রিম’ (ভেঙে যাওয়া স্বপ্ন) প্রকাশিত হওয়ার পর এ কথাগুলো আবার উচ্চারিত হচ্ছে। আমরা আমাদের জীবদ্দশায় দেখেছি কীভাবে সামরিক শাসকদের আলিঙ্গন করেছেন কোনও কোনও বিচারপতি। আমরা আবার এও জেনেছি, বিচারপতি সায়েমের মতো বিচারপতি থেকে রাষ্ট্রপতি হওয়া ব্যক্তিকে কীভাবে জেনারেল জিয়াউর রহমান অস্ত্র দেখিয়ে, তার টেবিলে পা তুলে পদত্যাগ করিয়েছেন।
সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাও যখন নির্বাচনের ঠিক আগে আগে একটি স্বপ্নভঙ্গের গল্প লিখে আলোড়ন তুলতে চাইছেন, তখন আবার এসব প্রশ্ন সামনে এসেছে। স্বপ্নভঙ্গের কথা বললেও তার স্বপ্নটা ঠিক কি ছিল তা অবশ্য তিনি পরিষ্কার করতে পারেননি এই বইতে। আছে কেবল সরকারের বিরুদ্ধে বিষোদগার। আমাজনের স্বত্ব থাকা সত্ত্বেও এই বইয়ের পাইরেটেড বা চুরিকৃত কপি এখন সামাজিক মাধ্যমে। বোঝাই যাচ্ছে এই বইয়ের রাজনৈতিক বিতরণ চলছে জোরদারভাবে।
বিচারপতি সিনহা বিদেশে চলে গেছেন, কার চাপে বা কি কারণে সে কথা বলতে চাই না। কিন্তু যদি তার কথাকেও সত্যি ধরে নিই যে তাকে জোর করে বাইরে পাঠানো হয়েছে, তাহলেও বলতে হবে যে তার নিজস্ব স্বচ্ছতা এই জায়গায় ছিল না যে তিনি তা ঠেকাতে পেরেছেন। কারণ, একজন বিচারপতি নিজে না গেলে তাকে বাধ্য করা যায় না পদত্যাগে।
তার বিরুদ্ধে ১১টি দুর্নীতির অভিযোগ ছিল এবং সেগুলোর কোনটিরই সুস্পষ্ট জবাব দিয়ে কোনও সুরাহা করেননি। অবৈধভাবে সম্পদ অর্জন, ঘুষগ্রহণ, ক্ষমতার অপব্যবহার, বিদেশে অর্থ পাচার ও নারী কেলেঙ্কারির অভিযোগগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এসব অভিযোগ এমন একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে উঠেছিল যিনি বিচার বিভাগের অভিভাবক ছিলেন।
আশ্চর্য ঠেকে এখন এসব শুনলে। সাবেক প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে অভিযোগ জনসমক্ষে প্রকাশিত হলো। তা কতটা ঠিক হলো বা ভুল হলো এ নিয়ে অনেক কথা বলা যাবে। এসবই বিতর্কযোগ্য সন্দেহ নেই, কিন্তু এগুলো সবই ছোট ছোট বিতর্ক। আসল বড় বিতর্কটা হলো, এস কে সিনহা ঠিক কি কারণে বিচার বিভাগকে আলাদা রাখতে গিয়ে বাকি বিভাগগুলোর থেকে এত দূরবর্তী স্থানে নিয়ে গেলেন? নাকি তারও প্রত্যাশা ছিল রাজনীতির সর্বভেদী দুনিয়াদারির মধ্যে কিছু খুঁজে পাওয়া?
নিস্পৃহতা বা নিষ্ক্রিয়তা শুনতে নিরীহ, কিন্তু কোনও কোনও ক্ষেত্রে ভয়ঙ্কর। তিনি এত কথা বলেছেন যা আগে কখনও কেউ বলেনি। আমার সাংবাদিকতা জীবনে আমি এমন প্রধান বিচারপতি খুব কমই পেয়েছি, যিনি প্রায়ই গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছেন। তিনি সরব ছিলেন প্রায় সব বিষয়ে, অনেক বেশি পাবলিক ফাংশনে বক্তব্য দিয়েছেন। কিন্তু নিজের বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগে তিনি নীরব থেকেছেন সব সময়, এমন কি এই বইতেও। এই বই প্রকাশিত হওয়ার পর তার কানাডায় কেনা বাড়ি নিয়েও যেসব কথা উঠেছে সেখানেও তিনি ভয়ঙ্করভাবে নিস্পৃহ।
একটা কথা বলা যায় যে, এসব অভিযোগ তো প্রমাণিত নয়। ঠিক তা-ই। প্রমাণিত নয়। প্রমাণ যথেষ্ট কিনা, সেটা তো বিচারেই প্রমাণিত হওয়ার কথা। কিন্তু যেখানে এমন সাংঘাতিক অভিযোগ উঠল, এগিয়ে গেল, এবং এতদূর এসে তাকে চলে যেতে হলো—সেই পরিস্থিতিটার মধ্যেও কি একটা বিপজ্জনক বার্তা নেই? কী সেই বাস্তবের চেহারা, যেখানে এতদিক থেকে এত রকম অভিযোগ ধেয়ে এসে এত হৃষ্টপুষ্ট হয়ে ওঠে একজন প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে?
দেশের সর্বোচ্চ আদালতের অভ্যন্তরীণ হালচাল এমন হোক, তা কেউ চায় না। সাবেক প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তো শেষ পর্যন্ত ‘কোনও এক ব্যক্তির প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি’ মাত্র নয়। প্রমাণিত হোক না হোক, অভিযোগটুকুই তো গোটা বিচার বিভাগের প্রতি জনআস্থা বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি করে, যদিও তা হয়নি। আমাদের আস্থা আছে এবং থাকবেও। কিন্তু ব্যক্তি সিনহার কাজকর্ম সেদিকে নিয়ে যাওয়ার কোনও প্রয়াস ছিল কিনা, তাও বিশ্লেষণ প্রয়োজন।
বিচারক যখন বিচার করেন, তাঁর নিজেরও বিচার হয়। কারণ, তিনি তার ন্যায্যতার বিচার করেন নিজেই। নির্বাচনকে সামনে রেখে বই লিখেছেন, সেই বইয়ে নিজের ছবিই প্রথম পাতায় এবং সেই বই দ্রুততার সাথে কপিরাইটের তোয়াক্কা না করে ছুটে চলেছে মানুষের কাছে।
বিচারপতিদের চারিত্রিক দৃঢ়তা হবে এমন স্বতঃসিদ্ধ, সর্বজনস্বীকৃত, কোনও প্রশ্ন উঠতেই পারবে না তা নিয়ে। সত্যি বলতে কি, এস কে সিনহা নিজেকে সে জায়গায় নিতে পারেননি। বিচার বিভাগের সাথে রাজনীতির সংকট আমাদের শঙ্কিত করে। তবে, একথাও সত্য এস কে সিনহার পর্ব দেখলে মনে হয়, এমনটাই তো হওয়ার কথা, যদি বিচারপতিরা নিজেদের ক্ষুদ্রতা, দলীয়তা, সংকীর্ণতা, অনিয়ম আর বিতর্কমুক্ত রাখতে না পারেন।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, জিটিভি ও সারাবাংলা

/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
হৃদরোগ বিভাগে ছারপোকার রাজত্ব, হাসপাতাল পরিচালক দুষছেন রোগীদের
রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালহৃদরোগ বিভাগে ছারপোকার রাজত্ব, হাসপাতাল পরিচালক দুষছেন রোগীদের
‘মডার্ন মেট্রোপলিস’ থিমে ঈদ সংগ্রহ এনেছে ঢেউ
‘মডার্ন মেট্রোপলিস’ থিমে ঈদ সংগ্রহ এনেছে ঢেউ
কাপাসিয়ায় গরু চোর সন্দেহে ২ জনকে পিটিয়ে হত্যা
কাপাসিয়ায় গরু চোর সন্দেহে ২ জনকে পিটিয়ে হত্যা
ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে কবে সমন্বয় করবে রাজউক?
বহুতল ভবনের সংজ্ঞাফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে কবে সমন্বয় করবে রাজউক?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ