X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কেন বারবার তীরে এসেই তরী ডোবে?

রেজানুর রহমান
২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৪:১০আপডেট : ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৪:১৫

রেজানুর রহমান ক্রিকেট এখন বাংলাদেশের মানুষের জন্য শুধুমাত্র একটি খেলা নয়, মান মর্যাদার লড়াইও বটে। ক্রিকেট হাসলে বাংলাদেশ হাসে। আবার ক্রিকেটের ব্যর্থতায় কষ্টের হাহাকার ছড়িয়ে যায়। ২৮ সেপ্টেম্বর দুবাইয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল যখন ভারতের সঙ্গে এশিয়া কাপ ক্রিকেটের শিরোপার লড়াইয়ে জান প্রাণ দিয়ে খেলছিলো রাতে তখন গোটা বাংলাদেশ জেগেছিল। সবার চোখে-মুখে একই প্রত্যাশা– অধরা স্বপ্নটি এবার নিশ্চয়ই বাস্তবে ধরা দেবে। ক্রিকেটের এশিয়া কাপ এবার বাংলাদেশের হবে। কিন্তু আবারও ব্যর্থ হলো বাংলাদেশ। ‘দান দান তিন দান’। অথাৎ তৃতীয় বারের মতো ফাইনালে উঠেও বাংলাদেশের পক্ষে এশিয়া কাপ জেতা হলো না। ভারত এবার নিয়ে সপ্তম বারের মতো এশিয়া কাপ জিতে নিলো। তবে বাংলাদেশ এবার এশিয়া কাপ জিততে না পারলেও ক্রিকেটের লড়াইয়ে মর্যাদাবান দেশ হিসেবে নিজেকে আরেকবার প্রতিষ্ঠিত করেছে নিঃসন্দেহে। ছয় দেশের এশিয়া কাপ লড়াইয়ে অনেকাংশে বাংলাদেশই ছিল এগিয়ে। ফাইনালে ভারতের সঙ্গে হারলেও শেষ বল পর্যন্ত দুর্দান্ত লড়াই করেছে। ফলে দেশে গভীর রাত পর্যন্ত জেগে থাকা মানুষেরা এবং দুবাই স্টেডিয়ামে সরাসরি খেলা দেখতে আসা প্রবাসীরাও বেশ খুশি। দেশে, প্রবাসে একই সুর বেজেছে– লড়াই করে হেরেছে বাংলাদেশ। এই হারে কোনও লজ্জা নাই। বরং আছে অর্জন। আছে ভবিষ্যতের জন্য প্রেরণা। এবার কাপ জেতা হলো না। কিন্তু আগামীর সময়টা হবে বাংলাদেশের। ক্রিকেটের অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশকে কেউ দাবায়া রাখতে পারবে না।

এবার এশিয়া কাপকে ঘিরে জানা-অজানা অনেক পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়েছে বাংলাদেশকে। এশিয়া কাপের প্রথম খেলায় ক্রিকেটের পরাশক্তি শ্রীলংকাকে পরাজিত করে ক্রিকেট বিশ্বে বাংলাদেশ ব্যাপক আলোড়ন তোলে। এই খেলায় বাংলাদেশকে কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলাও করতে হয়েছে। খেলার শুরুতেই বাংলাদেশের নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যান তামিম ইকবাল হাতে চোট পেয়ে মাঠের বাইরে চলে যান। ফলে প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশের জয় প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু খেলোয়াড়দের দেশ প্রেমই ওই খেলায় জিতিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশকে। এক্ষেত্রে মুশফিকুর রহিমের নাম কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করছি। হাতে চোট পাওয়া তামিম ইকবাল খেলার মাঠ থেকে বেরিয়ে চিকিৎসা নেওয়ার জন্য হাসপাতালে গিয়েছিলেন। হাসপাতাল থেকে ফিরে চোট পাওয়া হাত নিয়ে আবার ব্যাট করতে মাঠে নেমে পড়েন। এক হাতে প্রতিপক্ষের বলও ঠেকিয়েছেন। বলা যায়, তামিম ইকবালের এই দৃষ্টান্ত বাংলাদেশ ক্রিকৈট দলকে জয়ের ধারায় অনেক প্রেরণা জুগিয়েছে।

ক্রিকেট অনিশ্চয়তার খেলা। কাজেই আগে থেকে কিছুই আন্দাজ করা যায় না। তবে পরিস্থিতি বিবেচনায় দেশের মানুষ আশায় বুক বেঁধেছিল এইভেবে যে, বাংলাদেশ এবার এশিয়া কাপের শিরোপা জিতবে। কাপ জেতা হয়নি। তবে বাংলাদেশ কাপের বাইরেও অনেক কিছু জিতেছে। সব চেয়ে বড় কথা এবার এশিয়া কাপে বাংলাদেশ অজানা অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পেরেছে। যেমন দলের ব্যাটিং স্তম্ভ তামিম ইকবাল হাতের ইনজুরির কারণে দল থেকে ছিটকে পড়লেন। তামিম দলে না থাকলে সাধারণত দলে একধরনের অস্থিরতা দেখা দেয়। এবার সেটা কাটিয়ে উঠতে পেরেছে বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে অবশ্য তামিমের ভূমিকাও ছিল বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। হাতের ইনজুরির কারণে দলের বাইরে থেকেও দলের প্রতিটি সদস্যকে ফোনে উজ্জীবিত করেছেন।

ফাইনালে প্রতিপক্ষ যখন বিশ্ব ক্রিকেটের পরাশক্তি ভারত তখন তো বাংলাদেশ দলে সাকিব, তামিমকে ছাড়া কিছুই কল্পনা করা যায় না। অথচ সাকিব, তামিমকে ছাড়াই ভারতের সঙ্গে সমানে সমানে ক্রিকেটের শিরোপার লড়াই করেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের পরাজয় হলেও এক অর্থে বাংলাদেশই জিতেছে। দল হিসেবে বাংলাদেশের প্রতিটি ক্রিকেট খেলোয়াড়ের মাঝে পারস্পরিক সমঝোতা, ঐক্য আর শ্রদ্ধা ভালোবাসার বিশ্বস্ত একটি ছবি পাওয়া গেছে। আশা করা যায় এই একটি ছবিই বাংলাদেশের ক্রিকেটকে সামনের দিকে শ্রেষ্ঠত্বের কাতারে এগিয়ে নেবে।

বিশেষ ভাবে বলতে হচ্ছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অকুতোভয় কাপ্তান মাশরাফি বিন মোর্তুজার কথা। একজন মাশরাফি মানেই বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অফুরান প্রেরণার প্রতিচ্ছবি। শরীরের নানান পর্যায়ের অস্বস্তি ও ইনজুরি সত্ত্বেও অবলীলায় দলের নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন তিনি। মূলত তার দূরদর্শী ও প্রেমময় নেতৃত্বের গুণেই বাংলাদেশ ক্রিকেট দল এবার এশিয়া কাপের জানা-অজানা সকল সংকটের মোকাবিলা করতে পেরেছে। টুর্নামেন্টের প্রথম খেলায় আঘাত প্রাপ্ত হাত নিয়ে তামিমকে মাঠে পাঠানোর প্রেরণা জুগিয়েছিলেন মাশরাফিই। তামিম একথা স্বীকারও করেছেন। ‘মুশফিক যদি মাঠে থাকে তাহলে তুই মাঠে যাইস– মাশরাফি ভাইয়ের এই কথা শুনে প্রথমে ভেবেছিলাম তিনি আমার সাথে হয়তো রসিকতা করছেন। পরে মনে হয়েছে তিনি সিরিয়াসলি বলছেন। বলা যায় তার প্রেরণায় হাতের ইনজুরি সত্ত্বেও মাঠে নেমেছি।’

আফগানিস্তানের সঙ্গে শেষ খেলাটিতে তো হেরেই যাচ্ছিল বাংলাদেশ। কাপ্তান মাশরাফি তার শিষ্য মোস্তফিজের হাতে শেষ ওভারের বল তুলে দিয়ে বলেছিলেন ‘যা এবার তুই একটা কিছু কইর‌্যা দেখা’। মোস্তাফিজের ভাষায় ‘ভাই কথাটা বলার পর আমার খুব ভালো লেগেছে। বল করতে গিয়ে সাহস পেয়েছি’। আফগানিস্তানের শেষ ওভারে মোস্তাফিজের উইকেট শিকারই তো বাংলাদেশ দলকে এশিয়া কাপের ফাইনালের টিকেট এনে দেয়। যার অনেকটা কৃতিত্ব দলের কাপ্তান মাশরাফিরও বটে।

ধন্যবাদ জানাতেই হয় প্রবাসী বন্ধুদের। যারা দুবাই ও আবুধাবীর ক্রিকেট মাঠে হাজির হয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে প্রেরণা জুগিয়েছেন। কখনও কখনও মনে হয়েছে দুবাই অথবা আবুধাবীতে নয় ঢাকায় শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে এশিয়া কাপের খেলা দেখছি। অনেকে পরিবার পরিজন নিয়েও বাংলাদেশের খেলা দেখতে এসেছিলেন। দেশের জন্য অনেক মায়া ছড়িয়েছেন তারা। এজন্য প্রবাসী ভাই- বোনদের অনেক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।

দেশের কোটি কোটি ক্রিকেট প্রেমী মানষের কথাও বিশেষ ভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন। যারা বিরতিহীন ভাবে দেশের ক্রিকেটকে সুখে-দুঃখে সমর্থন দিয়ে চলেছেন। আমাদের ক্রিকেটের উন্নয়নের ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিকতার কথাও বিশেষ ভাবে উল্লেখ করতে চাই। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিয়ে তিনি ব্যস্ত সময় পার করছেন। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশ-ভারত ক্রিকেট ফাইনালের আগে বাংলাদেশ দলের প্রতিটি সদস্যের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন। মাশরাফির ভাষায়, ‘আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ফোন করেছিলেন। চাপ না নিয়ে আমাদেরকে খেলতে বলেছেন’।

আবারও বলি ক্রিকেট এখন শুধুমাত্র একটি খেলার নাম নয়। ক্রিকেট মানেই মান-মর্যাদার প্রতিচ্ছবি। ক্রিকেটের অনেক পজিটিভ অর্জন বাংলাদেশকে গর্বিত করেছে। এশিয়া কাপে বাংলাদেশ ক্রিকেটের অর্জন আবারও বিশ্ব ক্রিকেটে পজিটিভ আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এখন সময় সামনে এগিয়ে যাওয়ার। সামনের বছর অনুষ্ঠিত হবে বিশ্বকাপ ক্রিকেট প্রতিযোগিতা। তার আগে দেশ-বিদেশে বেশ কয়েকটি টুর্নামেন্টে খেলবে বাংলাদেশ। সামনে রয়েছে দেশের বিপিএল আর নতুন আসর আমরা মনে করি সব কিছু ছাপিয়ে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের জন্য বাংলাদেশের এখনই একটি বৃহৎ পরিকল্পনা সাজানো জরুরি। এশিয়া কাপ ক্রিকেটে সফলতা ও ব্যর্থতার নিরীখে এই পরিকল্পনা সাজানো যেতে পারে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের দুর্বল জায়গা হলো ব্যাটিংয়ে টপ অর্ডারের ব্যর্থতা। এশিয়া কাপে তা হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া গেছে। বাস্তব পরিস্থিতি দেখে কখনও কখনও মনে হয়েছে মাশরাফি, সাকিব, তামিম, মুশফিক ও মাহমুদউল্লাহর বাইরে তরুণ খেলোয়াড়েরা তেমন একটা সুবিধা করতে পারছেন না। একই সঙ্গে তামিম ও সাকিবের ইনজুরি বোধকরি বাংলাদেশ দলকে আগাম সতর্ক বার্তা দিচ্ছে। ভবিষ্যতে যদি সিনিয়র অন্য খেলোয়াড়রাও এভাবে ইনজুরিতে পড়েন তাহলে দলের পারফরমেন্সের কী হবে? কাজেই তরুণ খেলোয়াড়দের উচিত দলে আস্থার জায়গাটা পোক্ত করা। এশিয়া কাপে যেমন শেষে একটা দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করলেন মেহেদী হাসান মিরাজ। লিটন দাসের সঙ্গে ওপেনিং ব্যাটসম্যান হিসেবে নেমে নতুন করে নিজের প্রতিভার ঝলক দেখিয়েছেন। ফলে তার প্রতি দলের নতুন করে একটা আস্থার জায়গা তৈরি হয়েছে। লিটন দাস ও একটা ভরসার জায়গা তৈরি করেছেন। অন্যদেরও উচিত এভাবেই নিজেকে মেলে ধরা।

প্রসঙ্গক্রমে আরেকটি কথা বলতে চাই। এক সময় বাংলাদেশে ক্রিকেট দলের অনেক সদস্যের মাঝে বড় দলের সঙ্গে ক্রিকেট খেলার ব্যাপারে এক ধরনের মানসিক ভীতি কাজ করতো ক্রিকেট। শ্রীলংকা, পাকিস্তানের সঙ্গে খেলার আগেই যেন হেরে বসে থাকতো অনেকে। অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ডকে জুজুর মতো ভয় করতো কেউ কেউ। অথচ এই দলগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশ এখন হেসে খেলে ক্রিকেট খেলে। তবে ভারতের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দলের সদস্যদের মধ্যে কেউ কেউ বোধকরি অত্যধিক মানসিক চাপ অনুভব করেন। আমাদের ক্রিকেট কর্তাদের উচিৎ এ ব্যাপারে দলের সদস্যদের মাঝে মানসিক শক্তি জোগানো। পাশাপাশি ক্রিকেটের বিতর্কিত আম্পায়ারিংয়ের বিরুদ্ধেও বাংলাদেশের ক্রিকেট কর্তা ব্যক্তিদের সোচ্চার ভূমিকা জরুরি। ভারত বাংলাদেশের ফাইনাল খেলায় অস্ট্রেলিয়ান আম্পায়ার বাংলাদেশের ব্যাটসম্যান লিটন দাসকে যেভাবে আউট ঘোষণা করেছেন তা নিয়ে বেশ বিতর্ক শুরু হয়েছে। আহারে! লিটন ওভাবে আউট না হলে বাংলাদেশের রান সংখ্যা নিশ্চয়ই আরও বাড়তো। তখন খেলার ফলাফল হয়তো বাংলাদেশের পক্ষেই যেতো!

জয় হোক বাংলাদেশের ক্রিকেটের।

লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক আনন্দ আলো

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
প্রতিবন্ধী শিল্পীদের আয়োজনে মঞ্চস্থ হলো ‘সার্কাস সার্কাস’ নাটক
প্রতিবন্ধী শিল্পীদের আয়োজনে মঞ্চস্থ হলো ‘সার্কাস সার্কাস’ নাটক
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ