X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

ট্রাম্পের অভিশংসন দ্রুত এগিয়ে আসছে

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী
০৪ অক্টোবর ২০১৮, ১৭:৩৪আপডেট : ০৪ অক্টোবর ২০১৮, ১৭:৩৫

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার নানা নির্বাচনি প্রচারণা বক্তৃতায় বলেছিলেন, তিনি নির্বাচিত হলে যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বের দরবারে হাসির পাত্র করবেন না। কিন্তু কী অদ্ভুত ব্যাপার, ট্রাম্পের শাসনের দুই বছর না হতেই তার মুখের ওপর বিশ্ব একযোগে হাসলো। জাতিসংঘের ৭৩তম সাধারণ অধিবেশনের ভাষণে তিনি যখন দাবি করলেন, গেলো দুই বছরেরও কম সময়ে ট্রাম্প প্রশাসন যে উন্নয়ন করেছে, যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে আর কোনও সরকার তা করে দেখাতে পারেনি, তখন  হাসির রোল পড়ে যায় সম্মেলন কক্ষে। সবার হাসি দেখে মার্কিন প্রেসিডেন্টও নিজের হাসি ধরে রাখতে পারেননি। পরে বলেন, এ ধরনের প্রতিক্রিয়া তিনি প্রত্যাশা করেননি।
সাধারণ অধিবেশনে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির মাঝে তীব্র বাক্যযুদ্ধ হয়েছে। এ বাগবিতণ্ডায় হাসান রুহানি ট্রাম্পকে ‘বুদ্ধি প্রতিবন্ধী’ লোক বলে অবহিত করেছেন। এ পর্যন্ত ট্রাম্পকে যে যেভাবেই বর্ণনা করুন না কেন, সম্ভবত হাসান রুহানিই তার সম্পর্কে সত্য উপলব্ধি এবং সঠিক কথাটা প্রকাশ করেছেন। ট্রাম্প এতই নির্বোধ যে পরিপূর্ণ চার বছর প্রেসিডেন্ট থাকলে মনে হয় আমেরিকা একটা আঞ্চলিক শক্তির পর্যায়ে নেমে আসবে। এবং বিশ্ব ব্যবস্থায় একটা বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। শুধু বিশ্ব ব্যবস্থা নয়, আমেরিকার অভ্যন্তরীণ বিষয়েও শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হবে।

কানাডাকে নিয়ে যেমন বাজে মন্তব্য করে যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা সম্পর্কে ফাটল ধরিয়েছেন, তেমনি সর্বশেষ সৌদি আরব সম্পর্কে করেছেন। দুই অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের মিসিসিপির সাউথহ্যাভেনে এক সমাবেশে ট্রাম্প দাবি করেন, যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা ছাড়া সৌদি বাদশাহ বা তার রাজত্ব দুই সপ্তাহও টিকে থাকতে পারবে না। তার এই মন্তব্যের জেরে আলোচনার ঝড় উঠেছে উভয় দেশের কূটনৈতিকপাড়ায়। ‘অকূটনৈতিক’ এবং বেফাঁস মন্তব্য কোনও মার্কিন প্রেসিডেন্ট এর আগে কখনও করেননি।

আমেরিকার প্রেসিডেন্টের সেক্রেটারিয়েটে অর্থাৎ হোয়াইট হাউসে দেড় হাজারের মতো স্টাফ রয়েছে। বিভিন্ন দফতরের সচিবরা এর অন্তর্ভুক্ত। পিয়ন থেকে বিভিন্ন দফতরের দায়িত্বে থাকা সচিব পর্যন্ত সবাই ভীতসন্ত্রস্ত থাকেন কখন তাকে বিদায় নিতে হয়। নিজের অফিসকে নিজে ভীতির মাঝে রাখলে সুষ্ঠু কাজ চালানো তো কখনও সম্ভব হয় না। হোয়াইট হাউসেই ট্রাম্প বর্তমানে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছেন। ট্রাম্পের এখন কোনও বন্ধু নেই। তিনি কারও বন্ধুত্ব চানও না। তিনি সকলের কাছ থেকে নিঃশর্ত আনুগত্য কামনা করেন।

হোয়াইট হাউসে তার মেয়ে ইভাঙ্কা ছাড়া কেউই বরখাস্ত হওয়ার ভীতির বাইরে নন। রাষ্ট্রীয় স্তরে তিনি বহু পুরনো ব্যবস্থা বাতিল করে দিয়েছেন, নতুন বিতর্কিত ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছেন। ট্রাম্প বর্ণবাদী লোক হিসেবে প্রমাণিত হয়েছেন। তার সবচেয়ে বেশি বিদ্বেষ বিগত ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রতি। ওবামা কালো আফ্রিকান আমেরিকানের সন্তান। ক্ষমতায় এসেই তিনি ওবামার স্বাস্থ্যবীমা বাতিল করেছেন। ওবামা স্বাক্ষরিত প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে আমেরিকাকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। ইরানের সঙ্গে স্বাক্ষরিত পরমাণু বিষয়ক চুক্তি থেকে আমেরিকা সরে এসেছে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাশিয়া ট্রাম্পের পক্ষে হস্তক্ষেপ করেছিল–এ কেলেঙ্কারি নিয়ে ট্রাম্প খুবই বিব্রত অবস্থায় রয়েছেন। নিক্সন ওয়াটারগেটে কেলেঙ্কারির শাস্তি থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য ভাইস প্রেসিডেন্ট ফোর্ডের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে পদত্যাগ করেছিলেন। ট্রাম্পও অনুরূপ অবস্থার সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তার অ্যাটর্নি জেনারেল জেফ সেশনসকে তিনি বশীভূত করতে পারেননি। এ নিয়ে তিনি সমস্যায় আছেন।

আবার তার সাবেক নির্বাচন প্রচার কমিটির চেয়ারম্যান পল ম্যানাফোর্ট ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় তার অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। শুল্ক কেলেঙ্কারি ও জালিয়াতির বিষয়ে ম্যানাফোর্ট দোষী প্রমাণিত হয়েছেন। এ মামলায় ম্যানাফোর্টকে সারা জীবন জেলে কাটাতে হবে। সুতরাং এখন তিনি বাঁচার পথ অনুসন্ধানে ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন। শুল্ক কেলেঙ্কারি ও জালিয়াতির অভিযোগ থেকে ম্যানাফোর্টকে অব্যাহতি প্রদানের জন্য বিশেষ ক্ষমতা বলে ট্রাম্প তাকে ক্ষমা করার কথা চিন্তা করেছিলেন। কিন্তু অনুরূপ ক্ষমার ঘটনায় মধ্যবর্তী নির্বাচনে রিপাবলিকান পার্টি বিপর্যয়ের সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে। এই ভয়ে সেই পদক্ষেপ ট্রাম্পের পক্ষে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

ম্যানাফোর্ট মধ্যবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করে বসে থাকাটাও সঠিক মনে করছেন না। কারণ, মধ্যবর্তী নির্বাচনে ট্রাম্পের অবস্থা খারাপ ভিন্ন ভালো হওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে তিনি মনে করেন না। শেষ পর্যন্ত ম্যানাফোর্ট তার সব সম্পদ সরকারের হাতে তুলে দিয়ে নিজেকে সারা জীবন জেলে থাকার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য একটা চুক্তি করেছেন এবং প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছেন তিনি নির্বাচনে রুশ হস্তক্ষেপের বিষয়ে তদন্ত কর্মকর্তা মুলারকে বিস্তারিত জানাবেন।

ট্রাম্প বিশ্বব্যাপী আমেরিকার অবস্থানকে এমন এক নাজুক অবস্থায় এনে দাঁড় করিয়েছেন, তাতে ডেমোক্র্যাটরা তার বিরুদ্ধে অভিশংসনের আয়োজন করতে তৎপর হতেন। কিন্তু কংগ্রেসে ডেমোক্র্যাটরা সংখ্যাগরিষ্ঠ নন। আগামী ৬ নভেম্বর কংগ্রেসের মধ্যবর্তী নির্বাচন। সাধারণত আমেরিকার কোনও বিদায়ী প্রেসিডেন্ট বর্তমান প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে মুখ খোলেন না। কিন্তু সেই রেওয়াজ ভঙ্গ করে বারাক ওবামা ট্রাম্পের বিরুদ্ধে কথা বলা আরম্ভ করেছেন। তিনি ট্রাম্পের বহু কর্মকাণ্ডের সমালোচনাও করেছেন, যা মধ্যবর্তী নির্বাচনকে প্রভাবিত করবে।

মাইকেল কোহেন ট্রাম্পের দীর্ঘদিনের অ্যাটর্নি জেনারেল। ট্রাম্পের বিরুদ্ধে নির্বাচনের সময় দুই মহিলা তাদের সঙ্গে যৌন কেলেঙ্কারির বিষয়ে মুখ খুলতে চেয়েছিল। আর প্রচুর টাকা খরচ করে ট্রাম্প এই দুই মহিলার মুখ বন্ধ করার আয়োজন করেছিলেন এবং এ দুই মহিলাকে নিবৃত করার কাজটা করেছিলেন এই মাইকেল কোহেন। মাইকেল কোহেন এখন সবকিছুই বলে দিচ্ছেন। তিনি ট্রাম্পের ব্যবসারই অ্যাটর্নি জেনারেল ছিলেন। তিনি এখন বলছেন তদন্ত কর্মকর্তা মুলারের কাছে তিনি তার ব্যবসার বিষয়েও কথা বলবেন।

ট্রাম্পের আচরণে সব সহকর্মীই বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন। ট্রাম্পের কথায় ‘ইয়েস ইয়েস’ বলতে চাচ্ছেন না। কারণ, তারাও বুঝেছেন তারা যেহেতু প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কার্য কারণে সম্পৃক্ত, সেহেতু আমেরিকান সমাজে তাদেরও দায়বদ্ধতা রয়েছে। সমাজটাকে বিরান করে দিতে তারা ট্রাম্পকে সহযোগিতা করতে অনিচ্ছুক হয়ে উঠলেন।

ইভাঙ্কার স্বামী জ্যারেড কুশনার একজন ইহুদি। এখন মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে ইভাঙ্কার স্বামীই সবকিছু দেখাশুনা করছেন। মধ্যপ্রাচ্য সম্পর্কে ইভাঙ্কার স্বামীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। পররাষ্ট্র সচিব বা দেশরক্ষা সচিবের ভূমিকা এ বিষয়ে গৌণ। অনুরূপ শ্বশুর-জামাই বা পিতা-পুত্রের শাসন আমেরিকান সমাজ কখনও দেখেননি। দুই শতাধিক বছরের মধ্যে আমেরিকার শাসন ব্যবস্থায় অনুরূপ ঘটনা বিরল। ইভাঙ্কার স্বামীর কারণে আমেরিকার ওপর ইসরায়েলের প্রভাব খুবই দৃশ্যমান। জেরুসালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী ঘোষণা করলেও কোনও দেশ কখনও তাদের দূতাবাস তেল-আবিব থেকে জেরুসালেমে সরিয়ে নেয়নি। কিন্তু জামাইর প্রভাবে ট্রাম্প আমেরিকার দূতাবাস জেরুসালেমে স্থানান্তর করেছেন। সঙ্গে প্রভাব খাটিয়ে আরও কয়েকটা ছোট রাষ্ট্রের দূতাবাসও নিতে পেরেছেন।

ট্রাম্প এবারের জাতিসংঘের ৭৩তম সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ভাষণে বিশ্বে তার ১নং বন্ধুর কথা বলতে গিয়ে উত্তর কোরিয়ার স্বৈরশাসক কিম জং উনের নাম উল্লেখ করেছেন। তখন অধিবেশনে অংশগ্রহণকারী নেতারা হেসে ফেলেন। তিনি এতই নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছেন যে কিম জং উন ছাড়া তার আর কোনও বন্ধু নেই। অথচ উনের সঙ্গে যে চুক্তি হয়েছে তা তিনি কার্যকর করছেন না। কারণ, উন বলেছেন অবরোধ পরিপূর্ণভাবে প্রত্যাহার না করলে তিনি চুক্তি কার্যকর করবেন না।

এন্থনি কেনেডির স্থলে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হিসাবে ট্রাম্প কাভানাকে নিয়োগ দিয়েছেন। রতনে রতন চিনে। তার বিরুদ্ধে ক্রিস্টিনা নামের জনৈক মহিলা যৌন কেলেঙ্কারির অভিযোগ উত্থাপন করেছেন। বেশ ক’দিন ধরে এ বিষয়ে সিনেটের বিচারপতি নিয়োগ কমিটি উভয়কে মুখোমুখি করে তদন্ত করেছেন। শেষ পর্যন্ত ১ ভোটে কাভানা জিতলেও ক্রিস্টিনা বলেছেন বিষয়টা এফবিআইকে দিয়ে তদন্ত করালে ভালো হতো। এখন (৩০/০৯/২০১৮) প্রেসিডেন্ট এফবিআইকে দিয়ে তদন্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন। ডেমোক্র্যাটরা এ তদন্ত নিয়ে সন্তুষ্ট নন। তারা এ তদন্তের বস্তুনিষ্ঠতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। ডেমোক্র্যাটেরা বলছেন, এফবিআইর তদন্তে কোন কোন বিষয় থাকবে আর কারা সাক্ষী দেবে তা হোয়াইট হাউস সীমা বেঁধে দিয়েছে। এটা সঠিক হয়নি।

কাভানার বিরুদ্ধে ক্রিস্টিনা ছাড়াও এখন নতুন করে দুই নারী যৌন কেলেঙ্কারির অভিযোগ তুলেছেন। আবার সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরা কাভানার নিয়োগ নিয়ে সমালোচনায় মুখর হয়েছেন। কারণ, কাভানা নিয়োগ পেয়েই ট্রাম্পের উচ্চসিত প্রশংসা করেছেন। শেষ পর্যন্ত কাভানাকে নিয়োগ দেওয়া ট্রাম্পের পক্ষে সম্ভব হয় কিনা সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে।

আগামী ৬ নভেম্বর কংগ্রেসের মধ্যবর্তী নির্বাচন। বিভিন্ন জনমত জরিপে ডেমোক্র্যাটরা ১২ শতাংশ এগিয়ে আছে। নির্বাচনে যদি জরিপের ফলাফল প্রতিফলিত হয় তবে ডেমোক্র্যাটরা কংগ্রেসে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন দখল করে নেবেন। অনুরূপ পরিস্থিতিতে তারা কখনো ট্রাম্পের রাষ্ট্র পরিচালনার বর্তমান পদ্ধতি মেনে নেবেন না। সুতরাং, তখন ডেমোক্র্যাটরা প্রেসিডেন্টকে অভিশংসনের উদ্যোগ নেবেন।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
উত্তরাসহ দেশের চার পাসপোর্ট অফিসে দুদকের অভিযান
উত্তরাসহ দেশের চার পাসপোর্ট অফিসে দুদকের অভিযান
রনির ব্যাটে প্রাইম ব্যাংককে হারালো মোহামেডান
রনির ব্যাটে প্রাইম ব্যাংককে হারালো মোহামেডান
কুড়িগ্রামে বৃষ্টির জন্য নামাজ, এপ্রিলে সম্ভাবনা নেই বললো আবহাওয়া বিভাগ
কুড়িগ্রামে বৃষ্টির জন্য নামাজ, এপ্রিলে সম্ভাবনা নেই বললো আবহাওয়া বিভাগ
‘উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হবে’
‘উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হবে’
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ