X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

ট্রাম্প-স্টাইল: কাছে ও দূরে

শুভ কিবরিয়া
০৫ অক্টোবর ২০১৮, ১৫:১৯আপডেট : ০৫ অক্টোবর ২০১৮, ১৫:৩১

শুভ কিবরিয়া ক্ষমতায় আসার প্রায় দুই বছর পেরিয়ে গেছে ট্রাম্পের। খুব একটা নড়চড় হয়নি তার কথা-কাজে। যেসব কথা আর আওয়াজ তুলে ভোটের মাঠ গরম করেছিলেন সেসব কথা কাজে পরিণত করতে চেয়েছেন। বাধা পেয়েছেন অনেক ক্ষেত্রেই কিন্তু তার শাসন ধরনের খুব একটা বদল হয়নি। ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতিতে তিনি প্রথম পদক্ষেপ নিয়েছেন সে দেশে বসবাসরত অভিবাসীদের বিরুদ্ধে। বাইরে থেকে আসা এসব মানুষ খোদ আমেরিকান নাগরিকদের সুযোগ-সুবিধাতে ভাগ বসাচ্ছে, তাই তাদের জীবন যতটা অতিষ্ঠ করা যায়, সেটা বাস্তবায়নে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন ট্রাম্প। একসময় সারা পৃথিবীর মানুষ যেতে চাইতো আমেরিকায় বসবাসের জন্য। হালে সেই সুযোগ যথেষ্টই বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এরপর ট্রাম্প, বাণিজ্যে আমেরিকার ভাগ এককভাবে নিশ্চিত করতে চেয়েছেন। সেটা করতে তার প্রথম পরিকল্পনা হচ্ছে আমেরিকায় আসা বিভিন্ন দেশের পণ্যে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ। সেটাও তিনি করেছেন। বিশেষ করে চীনের ব্যাপারে তিনি কঠোর হয়েছেন। চীনও পাল্টা ব্যবস্থা নিয়েছে। আমেরিকার এই শুল্ক শাস্তি শেষাবধি সে দেশের অর্থনীতিকে কতটা শান্তি দেয় সেটাই এখন দেখার বিষয়।

ট্রাম্প নিজের দেশেও নানারকম বিতর্ক তৈরি করেছেন বিভিন্ন পদে নিয়োগদানের ক্ষেত্রে। যাদের বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনের অভিযোগ আছে সেরকম অনেককেই তিনি ঊর্ধ্বতন পদে নিয়োগের জন্য বাছাই করে যথেষ্ট বাধা ও সমালোচনার মুখে পড়েছেন। কিন্তু ট্রাম্প থামেননি। সম্প্রতি বিচারপতি পদে কাভানির মনোনয়ন নিয়েও তৈরি হয়েছে সেই ধরনের বিতর্ক। কিন্তু ট্রাম্প শক্ত হাতে ধরে আছেন কাভানিকেই। তার বিরুদ্ধে ওঠা যৌন নির্যাতনের অভিযোগ সত্ত্বেও। এটাই ট্রাম্প-স্টাইল।

এই ঘরানাতেই তিনি বেরিয়ে এসেছেন প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে। একইভাবে ইউরোপীয় মিত্রদের পথে ছুড়ে তিনি বেরিয়ে এসেছেন ইরানের সঙ্গে করা পারমাণবিক চুক্তি থেকেও। ট্রাম্পের এই নীতি-আচরণ আমেরিকার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে। বিশ্বনেতা হিসেবে যে মর্যাদা আর সম্মান ছিল আমেরিকার, তা খুইয়েছেন তিনি যথেষ্টই। ফলে আমেরিকা অনেক ক্ষেত্রেই বিরুদ্ধপক্ষের কাছে জয়ী হতে পারছে না। মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকা তার একক ক্ষমতা হারিয়েছে ইতোমধ্যেই। সিরিয়ায় আমেরিকার প্রতিপক্ষ ঐক্যবদ্ধ হয়েছে শক্তভাবেই। ইরান-তুরস্ক-রাশিয়ার জোট এক অর্থে সিরিয়ায় আমেরিকার নীতি ও শক্তিকে পরাভূতই করেছে। কিন্তু ট্রাম্প অনড়। সম্প্রতি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে বক্তব্য দিতে গিয়ে ট্রাম্প যেসব কথা বলেছেন, যেসব সাফল্য দাবি করেছেন, তা বিশ্বনেতাদের হাসির খোরাক জুগিয়েছে। কিন্তু তাতেও দমেন নাই ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি বিশ্বনেতাদের ‘গুড টাইম’ বা ‘ভালো সময়’ উপহার দিয়েছেন বলে দাবিও করেছেন এই হাস্যকর ঘটনার পর।

দুই.

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে কী বলেছেন, কী করেছেন ট্রাম্প!

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে দেওয়া বক্তব্যে ট্রাম্প ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানিকে ‘একনায়ক’ বলে আক্রমণ করেছেন। পাল্টা রুহানির কাছ থেকে ‘বুদ্ধির দীনতায়’ ভুগছেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট- একথাও শুনেছেন।

‘আমেরিকা ফার্স্ট’ এই উচ্চারণ করে তিনি জাতিসংঘে দাঁড়িয়ে বলেছেন, বিশ্বায়ন তার পছন্দ নয়। তিনি যেকোনও মূল্যে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থই দেখবেন।

বহুপক্ষীয়তার সমালোচনা করেছেন ট্রাম্প। জাতিসংঘের মঞ্চে  দাঁড়িয়ে গোটা বিশ্ববাসীকে তিনি জানান, ‘আমরা কখনও অনির্বাচিত ও জবাবদিহিহীন বৈশ্বিক আমলাতন্ত্রের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতাকে সঁপে দিতে পারি না। যুক্তরাষ্ট্রকে শাসন করে যুক্তরাষ্ট্রই। আমরা বিশ্বায়নের আদর্শকে প্রত্যাখ্যান করি। আমরা দেশপ্রেমের মতবাদকে আলিঙ্গন করি।’

আমেরিকার প্রেসিডেন্টের এই বক্তব্য শুনতে শুনতে উপস্থিত বিশ্বনেতাদের অনেকেই যখন কিছুটা অবাক ও বিস্মিত,বিরক্ত, তখন তিনি বলে ওঠেন, ‘মাত্র দুই বছর আগে ক্ষমতা গ্রহণের পর আমার প্রশাসন যা অর্জন করেছে, যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে আর কোনও প্রশাসন তা করতে পারেনি।’

তার এই কথা শুনে সশব্দে হেসে ওঠেন বিশ্বনেতাদের অনেকেই।

তিন.

ট্রাম্পের এই আচরণের মধ্যে এক ধরনের দাম্ভিকতা আছে। আছে সবাইকে অগ্রাহ্য করার একমাত্রিক কর্তৃত্ববাদিতাও। গণতন্ত্রে যে ধরনের সহনশীল, বহুমাত্রিক বিবেচনাকে প্রাধান্য দিতে হয়, ট্রাম্পের শাসন-মডেল বা স্টাইল তার সম্পূর্ণ বিপরীত। আচরণে, অঙ্গভঙ্গিতে যে রাষ্ট্রনৈতিক শিষ্টাচার গণতন্ত্রের সৌন্দর্য বলে বিবেচিত, ট্রাম্প তার বিপরীত মেরুর মানুষ। বিশ্বায়ন যুগের নেতা বলে বিবেচিত আমেরিকার প্রেসিডেন্টের এই আচরণ ও কর্তৃত্ববাদী মনোভাব গোটা বিশ্বব্যবস্থাকে তাই অস্থিতিশীল ও বিপদাপন্ন করে তুলছে। ট্রাম্প-মডেল অনেককেই প্রভাবিত করছে। লাতিন আমেরিকা থেকে এশিয়া, আফ্রিকার অনেক দেশে গণতন্ত্র বিপদে পড়ছে। এক ধরনের চরমপন্থী রাজনীতি শক্তিমান হয়ে উঠছে। দেশে দেশে বছরের পর বছর বসবাস করা অভিবাসীদের জীবন বিপন্ন হয়ে উঠছে। ধর্মবাদী চরমপন্থার উত্থান ঘটছে। কোথাও কোথাও গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে কর্তৃত্ববাদী শাসন বিরোধীদের কণ্ঠরোধ করছে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত হচ্ছে। স্বাভাবিক আইনের বদলে আক্রমণাত্মক জঙ্গিবাদী আইন প্রণয়ন করে ক্ষমতাবানরা তাদের স্বৈরাচারী শাসনকে সুরক্ষা দিতে চাইছে। দেশে দেশে আদালত স্বৈরাচারী, কর্তৃত্ববাদী শাসনকে সহায়তা দিয়ে জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলতেও কার্পণ্য বোধ করছে না।  জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস তাই সাধারণ পরিষদের ৭৩তম অধিবেশনের উদ্বোধনী ভাষণে আতঙ্কিত হয়ে বলছেন, ‘অবিশ্বাসের ব্যাধিতে ভুগছে গোটা বিশ্ব। যার পরিণতি ভোগ করছে নিরীহ সাধারণ মানুষ। বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো নষ্ট হচ্ছে। গণতন্ত্র ও আইনের শাসন হুমকির মুখে পড়ছে।’

ট্রাম্প মডেলের এই বিস্তার তাই আজ বিশ্বকে এক অনিরাপদ বাসস্থানে পরিণত করতে চলেছে।

চার.

কিন্তু গণতন্ত্র কি এরকম নিয়ন্ত্রণহীন ‘ট্রাম্প-মডেল’ অনুসরণ করে টেকসই হবে?

এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে আমরা গণতন্ত্রের বিধিব্যবস্থা সম্পর্কে বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের একটা বক্তব্য জেনে আসতে পারি। তিনি বলেছেন, ‘গণতন্ত্রের মূল কথা হলো আমি যদি জনগণকে সাথে নিতে না পারি, আমার দোষের জন্যই হোক বা জনগণের ভুল বোঝার জন্যই হোক, যে জন্যই হোক, জনগণ যদি আমাকে না চায় তবে আমি নির্ধিদ্বায় বিরোধী দলে বসব। এটা হলো গণতন্ত্রের মূলকথা। যে গণতন্ত্রকে আমরা সংবিধানে রেখেছি।’ তাজউদ্দীন আহমদ এই কথা বলেছিলেন ২০ জানুয়ারি ১৯৭৪ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক কাউন্সিলের সমাপনী অধিবেশনে।

অগণতান্ত্রিকতা যে টেকসই হয় না, কেবল জনগণের দুর্ভোগই বাড়ায়, এটা আরও ভালো করে বলে গেছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু। পাকিস্তান সৃষ্টির পর তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের কর্মকাণ্ড নিয়ে তার অভিজ্ঞতা ও অভিজ্ঞানের কথা লিখেছেন ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইয়ে।

বঙ্গবন্ধু লিখছেন, ‘আশ্চর্যের বিষয় সরকারি দল প্রকাশ্যে গুণ্ডাদের সাহায্য করত ও প্রশ্রয় দিতো। মাঝে মাঝে জগন্নাথ কলেজ, মিটফোর্ড ও মেডিকেল স্কুলের ছাত্ররা শোভাযাত্রা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে রওনা করলেই হঠাৎ আক্রমণ করে মারপিট করত। মুসলিম লীগ নেতারা একটা ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করতে চেষ্টা করছিল, যাতে কেউ সরকারের সমালোচনা করতে না পারে। মুসলিম লীগ নেতারা বুঝতে পারছিলেন না, যে পন্থা তারা অবলম্বন করছিলেন সেই পন্থাই তাদের ওপর একদিন ফিরে আসতে বাধ্য। ওনারা ভেবেছিলেন গুণ্ডা দিয়েই মারপিট করেই জনমত দাবাতে পারবেন। এ পন্থা যে কোনও দিন সফল হয়নি, আর হতে পারে না- এ শিক্ষা তারা ইতিহাস পড়ে শিখতে চেষ্টা করেননি।’

বঙ্গবন্ধুর এই ভাষ্য দেশে দেশে আজও কার্যকর। কেননা, ক্ষমতাবানরা এখন ইতিহাস থেকে শেখেন না। তারা বর্তমানের ক্ষমতায় যে কোনোভাবেই টিকে থাকতেই চান। তাই জনমত অগ্রাহ্য করে  আদালত, পুলিশ, রাষ্ট্রশক্তির সব অঙ্গকে কাজে লাগিয়ে, শক্তি প্রয়োগকেই ক্ষমতায় থাকার একমাত্র পথ বলে মনে করেন। তাতেই তারা আত্মতুষ্টিতে ভোগেন।

‘ট্রাম্প-মডেল’কে কাজে লাগিয়ে কাছের ও দূরের অনেক দেশেই তাই আজ চলছে গণতন্ত্রের নামেই গণতন্ত্র ধ্বংসের খেলা।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক

.

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ