X
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

নির্বাচনি ব্যবস্থার পরিবর্তন কেন জরুরি

আমীন আল রশীদ
০৭ অক্টোবর ২০১৮, ১৪:৩৬আপডেট : ০৭ অক্টোবর ২০১৮, ১৭:২৭

আমীন আল রশীদ সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ডিসেম্বরের শেষ অথবা জানুয়ারির শুরুর দিকে একাদশ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ৩০০ আসনের ভোটে যে দল বেশি আসন পাবে, সেই দলের নেতৃত্বে সরকার গঠিত হবে।
বেশি প্রার্থী জেতার পরেও এটাকে আমি 'সংখ্যালঘিষ্ঠের সরকার' বলতে পারি। কারণ অতীত অভিজ্ঞতা তা-ই বলে। অনেক নির্বাচনেই দেখা গেছে, ৩০ শতাংশ বা তার কিছু বেশি ভোট পাওয়া দলও সরকার গঠন করেছে। অর্থাৎ বাকি ৭০ শতাংশ ভোটারের প্রতিনিধিরা থেকে গেছেন বিরোধী শিবিরে। মানে নীতিনির্ধারণের বাইরে।
১৯৭৯ সালে বিএনপি ৪১ দশমিক ২ শতাংশ, ১৯৮৬ সালে জাতীয় পার্টি ৪২ দশমিক ৩৪ শতাংশ, ১৯৯১ সালে বিএনপি ৩০ দশমিক ৮১ শতাংশ, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ৩৭ শতাংশ ৪৪ এবং ২০০১ সালে বিএনপি ৪১ দশমিক ৪০ শতাংশ ভোট পেয়ে সরকার গঠন করে।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ১৯৭৩ সালে প্রথম যে সংসদ নির্বাচন হয়, সেখানে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল হিসেবে আওয়ামী লীগের ল্যান্ডস্লাইড বিজয় ছিল স্বাভাবিক। ওই নির্বাচনে তারা ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৩টিতেই জয় পায়। তাদের ভোটপ্রাপ্তির হার ছিল ৭৩ দশমিক ২০ শতাংশ। এর বাইরে মাত্র একটি করে আসন পায় জাসদ ও বাংলাদেশ জাতীয় লীগ। আর স্বতন্ত্র ৫ জন। দেখা যাচ্ছে, জাসদ ৬ দশমিক ৫২ শতাংশ ভোট পেয়ে একটি আসন পেলেও ৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ ভোট পেয়ে কোনও আসন পায়নি ন্যাপ (মোজাফফর)।

দেখা যাচ্ছে,১৯৯১ সালের নির্বাচনে ৩০ দশমিক ৮১ শতাংশ ভোট পেয়ে বিএনপি আসন পায় ১৪০টি, অথচ মাত্র ০ দশমিক ৭৩ শতাংশ কম ভোট পেয়ে আওয়ামী লীগ আসন পায় ৮৮টি। অর্থাৎ ভোটের ব্যবধান এক শতাংশেরও কম, অথচ আসনের ব্যবধান ৫২। ওই নির্বাচনে ১ দশমিক ৮১ শতাংশ ভোট পেয়ে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ ৫টি আসন পেলেও ১ দশমিক ২২ ভাগ পেয়ে একটি আসনও পায়নি জাকের পার্টি। ভোটের শতকরা হারের এই ব্যবধানের কারণ জাকের পার্টি প্রার্থী দিয়েছিল ২৫১টি আসনে। আর কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিল ৬৮টি আসনে।

১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের চেয়ে বিএনপির মোট ভোটের শতকরা ব্যবধান ছিল মাত্র ৩ দশমিক ৮৪ শতাংশ। অথচ আসনের ব্যবধান ৩০। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের আসন ছিল ১৪৬ আর বিএনপির ১১৬।

২০০১ সালের নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ভোটের ব্যবধান ছিল মাত্র ১ দশমিক ৩৮ শতাংশ। অথচ বিএনপি আসন পায় ১৯৩টি, আর আওয়ামী লীগ ৬২টি। ভোটের শতকরা হার বিবেচনায় আসন বণ্টন করা হলে এ দু’টি দলের আসন সংখ্যা হতো কাছাকাছি। অর্থাৎ উনিশ-বিশ। কিন্তু বিদ্যমান নির্বাচনি ব্যবস্থায় একটি দল আরেকটি দলের চেয়ে পপুলার ভোটে সামান্য পিছিয়ে থাকলেও মোট আসন সংখ্যায় পিছিয়ে অনেক।

এই পদ্ধতির সবচেয়ে অদ্ভুত ঘটনা ঘটে ২০০৮ সালের নির্বাচনে। এই নির্বাচনে ৪৯ শতাংশ ভোট পেয়ে আওয়ামী লীগ আসন পায় ২৩০টি, অথচ ৩৩ দশমিক ২ শতাংশ ভোট পেয়ে বিএনপির আসন শুধু ৩০টি। ভোটের সংখ্যানুপাতিক বিচারে আসন বণ্টন হলে ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির আরও বেশি আসন পাওয়ার কথা।

আমাদের দেশে এখন যে পদ্ধতিতে নির্বাচন হয়, সেটিকে বলা হয় ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট (এফপিটিপি)। অর্থাৎ যিনি বেশি ভোট পাবেন (তিনি যদি প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর চেয়ে এক ভোটও বেশি পান) তিনিই জয়ী ও বাকিরা সবাই পরাজিত।

এই পদ্ধতির নির্বাচনের আরেকটা বড় দুর্বলতা সমাজের সব শ্রেণিপেশার মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত না হওয়া। যখন সবচেয়ে বেশি ভোট পাওয়া প্রার্থীই বিজয়ী হন এবং বাকিরা সবাই গৌণ—তখন বিজয়ী হওয়ার জন্য সব ধরনের কায়দা-কানুন, অনিয়ম ও অরাজকতা চলে। যখন ব্যক্তির জয়ই এখানে মুখ্য, তখন সমাজের পিছিয়ে পড়া বা প্রান্তিক মানুষের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হয় না। এই পদ্ধতিতে এমন সুযোগও আছে যে, কোনও দলের তাদের সামগ্রিক ভোটের সংখ্যা বা পপুলার ভোট পরাজিত দলের চেয়ে কম হলেও বেশি আসনে জয়ী হওয়ায় তারা সরকার গঠন করতে পারে।

মূলত এ কারণেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন (Proportional Representation) পদ্ধতি চালু আছে। এই পদ্ধতিতে ব্যক্তি নয়, বরং দলকে নির্বাচনে অংশ নিতে হয়। সারা দেশের গণনায় একটি দল যে সংখ্যক ভোট পায়, আনুপাতিক হারে সংসদে সে সেই পরিমাণ আসন পায়। এটা ইলেকটোরাল কলেজ পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে প্রতিটি ভোটই মূল্যায়ন করা হয় এবং যে দল কম ভোট পায়, সংসদে তাদেরও প্রতিনিধিত্ব থাকে। আমাদের সংসদে এখন সংরক্ষিত নারী আসনের বণ্টনও এই আনুপাতিক হারে হয়। অর্থাৎ মূল নির্বাচনে সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলো যে আসন পায়, সেই অনুপাতে ৫০ জন সংরক্ষিত আসনের এমপি নির্বাচিত হন।

সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে প্রতিটি দলই সমাজের সর্বস্তরের মানুষের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে একটি প্রার্থী তালিকা নির্বাচন কমিশনে দেয় এবং তালিকাটি গোপন রাখা হয়। প্রতিটি দল যে পরিমাণ ভোট পায় সেই আলোকে ওই তালিকা থেকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রতিনিধি পায়। অর্থাৎ এই পদ্ধতিতে ভোটাররা ভোট দেন দলকে, কোনও ব্যক্তিকে নয়। কিন্তু সমস্যা হলো, আমাদের রাজনীতি যেহেতু ব্যবসায়ী তথা ‘পয়সাওয়ালা’ এবং ‘পেশীশক্তিওয়ালাদের’ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত; ফলে তারা এরকম একটি অধিকতর গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে যেতে চায় না। কারণ, আনুপাতিক হারে সংসদ সদস্য নির্বাচিত করতে গেলে সংসদে ছোট বড় মাঝারি সব দলেরই সদস্য থাকবে। এতে অনেক শক্তিমান প্রার্থী বাদ পড়বেন। তখন নির্বাচনে টাকার খেলা বন্ধ হবে। ব্যক্তির চেহারা দেখে মানুষ যেহেতু ভোট দেবে না—ফলে অযোগ্য লোকের পক্ষে শুধু টাকা আর পেশিশক্তি দিয়ে ভোটে জয়ী হওয়ার সুযোগ থাকবে না।

বিদ্যমান এফপিটিপি পদ্ধতিতে ভোট হওয়ায় দলগুলো প্রতিটি আসনে এমন সব প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয়, যাদের নির্বাচিত হয়ে আসার সম্ভাবনা বেশি; সেটি যেভাবেই হোক। এ কারণে বেছে বেছে শক্তিশালী প্রার্থীদেরই মনোনয়ন দেওয়া হয়। দল ও কমিউনিটিতে কার গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু, জনগণের সঙ্গে কার যোগাযোগ বেশি, কার শিক্ষাদীক্ষা ও সংস্কৃতি কেমন, এসব বিবেচনায় আসে না। বরং যিনি যে করেই হোক নির্বাচনি বৈতরণী পার হয়ে আসতে পারবেন বলে দল  মনে করে, তাকেই মনোনয়ন দেওয়া হয় বলেই আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি।

যেহেতু এই পদ্ধতিতে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর চেয়ে একভোট বেশি পেলেও তিনি জয়ী। সুতরাং এই একটি ভোট বেশি পাওয়ার জন্য তিনি সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন এবং নানারকম অপশক্তি প্রয়োগ করেন। মূলত এ কারণেই দেশের রাজনীতিও টু পার্টি পলিটিক্সে পরিণত হয়েছে। অর্থাৎ জাতীয় নির্বাচনে মানুষের ভাবনায় শুধুই নৌকা আর ধানের শীষ। কিন্তু আনুপাতিক পদ্ধতিতে ভোট হলে এই ‘অসুস্থ’ প্রতিযোগিতা কমে আসবে। ব্যক্তির বদলে মানুষ যখন দলকে ভোট দেবে,তখন স্থানীয় পর্যায়ে হানাহানি বন্ধ হবে। যে দল ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পাবে, তারা যেমন সংসদে থাকবে, তেমনি ১০ শতাংশ ভোট পেলে সেই দলেরও প্রতিনিধিত্ব থাকবে। অর্থাৎ সংসদ হয়ে উঠবে সর্বদলীয়। কিন্তু বর্তমান নির্বাচনি ব্যবস্থায় আমাদের সংসদ মূলত একদলীয় এবং কখনও-সখনও শক্তিশালী বিরোধী দল থাকলেও অধিকাংশ দলই থাকে সংসদের বাইরে। অথচ তাদেরও কমবেশি ভোট আছে। সুতরাং যে অল্প সংখ্যক মানুষও ওই দলগুলোকে ভোট দিয়েছে, সেই ভোটারদের মতামতের কোনও মূল্যই বিদ্যমান ব্যবস্থায় নেই।

আমাদের সংসদ যেহেতু এক কক্ষবিশিষ্ট, ফলে এখানে প্রত্যক্ষ ভোটের বাইরে গিয়ে সমাজের শিক্ষিত ও প্রান্তিক অংশ থেকে কাউকে প্রতিনিধি নির্বাচিত করে আনারও সুযোগ নেই। অথচ আমাদের প্রতিবেশী ভারত, এমনকি নেপালেও রাষ্ট্রের সর্বস্তরে প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার ব্যবস্থা রয়েছে। ফলে এক কক্ষবিশিষ্ট সংসদের ভাবনা থেকেও আমাদের বেরিয়ে আসার সময় হয়েছে।

সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনের পাশাপাশি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার বিধানও বন্ধ করা জরুরি। সংবিধানের ৬৫ (২) অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘একক আঞ্চলিক নির্বাচনি এলাকাসমূহ হইতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে আইনানুযায়ী তিন শত সদস্য লইয়া সংসদ গঠিত হইবে।’ প্রত্যক্ষ নির্বাচন মানে সেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকা আবশ্যক।

স্মরণ করা যেতে পারে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালের ১৭ ডিসেম্বর জাতীয় পার্টির ভাইস চেয়ারম্যান খন্দকার আব্দুস সালামের একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া সম্পর্কিত আরপিওর ১৯ ধারা কেন সংবিধান পরিপন্থী ঘোষণা করা হবে না, এই মর্মে একটি রুল জারি করেছিলেন হাইকোর্ট। কিন্তু যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে ২০১৪ সালের ১৯ জুন আদালত রিটটি খারিজ করে দেন। আদালত বলেন, সংবিধানের সাথে আরপিওর এই ধারাটি সাংঘর্ষিক নয়।

তবে নির্বাচনি ব্যবস্থার পরিবর্তন করে সংখ্যানুপাতিক আসন বণ্টনের ব্যবস্থা চালু করা গেলে এসব বিতর্ক স্বয়ংক্রিয়ভাবেই দূর হবে। এই ব্যবস্থা চালু হলে ভোটের সময় নির্বাচনকালীন সরকার, অন্তর্বর্তী নাকি তত্ত্বাবধায়ক—সেসব নিয়েও বিতর্কের অবসান হবে বলে আশা করা যায়।

লেখক: সাংবাদিক।

 

/এসএএস/এমএনএইচ/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
হেলমেটের মান নির্ধারণ হবে কবে?
হেলমেটের মান নির্ধারণ হবে কবে?
ঝালকাঠিতে নিহত ১৪ জনের পরিবার পাচ্ছে ৫ লাখ টাকা করে
ঝালকাঠিতে নিহত ১৪ জনের পরিবার পাচ্ছে ৫ লাখ টাকা করে
ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ নিয়ে জাতিসংঘে ভোট
ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ নিয়ে জাতিসংঘে ভোট
সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ‘আসমানে যাইও নারে বন্ধু’ গানের স্রষ্টা
সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ‘আসমানে যাইও নারে বন্ধু’ গানের স্রষ্টা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ