X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

মিয়ানমারের সেন্ট মার্টিন দাবি: ‘মামার বাড়ির আবদার’

আহমেদ আমিনুল ইসলাম
০৭ অক্টোবর ২০১৮, ১৫:৫১আপডেট : ০৭ অক্টোবর ২০১৮, ১৯:৫৩

আহমেদ আমিনুল ইসলাম মিয়ানমার ইনফরমেশন ম্যানেজমেন্ট ইউনিটের ২০১৫-২০১৮ সালের মানচিত্রে বাংলাদেশের দ্বীপ সেন্ট মার্টিনকে নিজেদের সীমানার অংশ হিসেবে দেখানো হচ্ছে। বিষয়টি বাইরের মানচিত্রে অস্পষ্টতা থাকলেও ভেতরে ঢুকলে স্পষ্টভাবেই বোঝা যায়। মিয়ানমারের এই অপপ্রয়াস স্পষ্টতই বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত। নিকট অতীতে মিয়ানমার বিভিন্ন সময়ে স্থলসীমান্ত নিয়েও এমন বিভ্রান্তিকর অপপ্রয়াস চালিয়েছে।
আন্তর্জাতিক ও প্রতিবেশীসুলভ শিষ্টাচার ভুলে মিয়ানমার বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশকে নানাভাবে  উসকানি দিলেও বাংলাদেশ অত্যন্ত সহনশীলতার সঙ্গে সেসব উপদ্রব মোকাবিলা করে আসছে। বাংলাদেশ সব সময়ই আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে সব সমস্যার সমাধান চায়। এজন্যই বিপুল-সংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থীর বোঝা ঘাড়ের ওপর থাকলেও তা নিয়ে মারমুখী আচরণ কিংবা উসকানিমূলক বক্তব্য দেওয়ার মাধ্যমে কাউকে উত্তেজিত করা থেকে সর্বত্রই বিরত থেকেছে বাংলাদেশ। কিন্তু মিয়ানমার অনেকটা পায়ে পা লাগিয়েই যেন ‘ফ্যাসাদে’ জড়াতে তৎপর। সম্প্রতি সেন্ট মার্টিন নিয়ে ঘটে যাওয়া এ ঘটনা তারই আরেকটি নমুনা। আসলে বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমার কেমন সম্পর্ক চায়, তা আমরা কি বুঝতে সমর্থ হয়েছি? নাকি কেবল ‘শান্তির অমিয় বাণী’ শুনিয়ে শুনিয়ে আমরা মিয়ানমারের সব অন্যায় আবদার ও অমানবিক কর্মকাণ্ড মেনে নেবো–প্রত্যক্ষ করে যাবো? কোন পথে হাঁটতে চায় মিয়ানমার–তা উপলব্ধি করে আমাদেরও কর্মপন্থা নির্ধারণ জরুরি হয়ে পড়েছে। 

‘বাড়ির পাশে আরশিনগর সেথায় এক পড়শি বসত করে/ আমি একদিনও না দেখিলাম তারে!’ লালনের এই গানের বাণীর একটি শব্দ পরিবর্তন করে অর্থাৎ ‘দেখিলাম’ শব্দটি বাদ দিয়ে সেখানে ‘চিনিলাম’ শব্দটি প্রতিস্থাপন করলে মিয়ানমার সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া সম্ভব। মিয়ানমার ভৌগোলিকভাবে আমাদের খুব কাছের ও নিকটতম প্রতিবেশী। প্রতিবেশীর সঙ্গে সদ্ভাব ও সদাচারের কথা বাল্যশিক্ষাকালেই আমরা রপ্ত করেছি। সামাজিক ও ধর্মীয় বিধানে প্রতিবেশীর সঙ্গে শিষ্টাচার রক্ষা করে চলার মূল্যবোধও আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যেই বিদ্যমান। কিন্তু বিগত কয়েক দশক ধরে মিয়ানমার আমাদের সঙ্গে প্রতিবেশীসুলভ আচরণ থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। শুধু প্রতিবেশীসুলভ আচরণই নয়, সাম্প্রদায়িক কট্টর মনোভাবের কারণে মিয়ানমারের সামরিক সরকার ও সেদেশের উগ্র বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের প্ররোচনায় সামগ্রিকভাবে দেশটি এখন মুসলমান অধিবাসীদের ওপর অমানবিক আচরণ ও নিষ্ঠুরতা প্রদর্শনে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। অথচ দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশই কেবল নয়, ভারতবর্ষের সব অঞ্চলের মানুষের ব্যবসায়িক ও মানবিক যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল প্রাগৈতিহাসিককাল থেকেই। মধ্যযুগ থেকে আরম্ভ করে আধুনিক যুগের সূচনাপর্বেও রেঙ্গুনের সঙ্গে বাংলাদেশ তথা ভারতবর্ষের এক গভীরতর মেলবন্ধনের আভাস পাওয়া যায়। মিয়ানমার ও তার তৎকালীন রাজধানী রেঙ্গুনের অজস্র স্মৃতিচিহ্নের সন্ধান পাওয়া যায় বাংলা শিল্পসাহিত্যেও। কিন্তু মিয়ানমার তথা বার্মায় সামরিক শাসন প্রবর্তনের পর শাসকগোষ্ঠী রাজধানী ও দেশটির নাম পরিবর্তন করে ফেলে। পাশাপাশি, সামরিক শাসকদের ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করার লক্ষ্যে ছড়িয়ে দেয় ধর্মীয় বিদ্বেষের বিষবৃক্ষের বীজ বিভিন্ন জাতিসত্তার মধ্যে। উপরন্তু, নির্দিষ্ট কিছু জাতিসত্তার মধ্যে দেশটির স্থায়ী বা আদি নিবাসীর অহংবোধ জাগ্রত করার কূটপন্থাও অবলম্বন করে তারা। ফলে তথাকথিত স্থায়ী বা আদি অধিবাসী হিসেবে দাবি করা বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মধ্যে এরূপ বিশ্বাস দৃঢ়তর করে তোলে যে তারা ছাড়া অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মানুষ মিয়ানমার তথা বার্মায় ভুঁইফোড়, অস্থায়ী কিংবা অভিবাসী। ফলে, তাদের সেই ভূখণ্ড থেকে বিতাড়ন করতে পারলেই যথাযথ বৌদ্ধত্ব রক্ষা পাবে। মূলত সামরিক স্বৈরশাসকের ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই মিয়ানমারে রোহিঙ্গাসহ অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অস্তিত্বের ওপর আঘাত আসে। সেনাবাহিনীর হাতে ক্ষমতা যত দীর্ঘস্থায়ী হয়, ততই বৃদ্ধি পেতে থাকে মুসলমানসহ অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ওপর অত্যারের মাত্রা। নিষ্ঠুর অত্যাচারের ব্যাপকতায় দেশত্যাগে বাধ্য হয় তারা। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইন রাজ্যে মুসলমান সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ওপর হত্যাযজ্ঞ শুরু হলে হাজার হাজার রোহিঙ্গা নারীপুরুষ শিশু নিহত হয়। তাদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ এবং নারীদের ধর্ষণ শুরু হলে জীবন রক্ষার্থে বাংলাদেশ সীমান্তে লাখ লাখ রোহিঙ্গা ভিড় জমায়। মানবিক বিপর্যয় থেকে রোহিঙ্গাদের রক্ষার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সীমান্ত খুলে দেওয়ার ঘোষণা দেন। তার এই মানবিক ঘোষণায় সে বছর প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণের ফলে জীবনরক্ষায় সমর্থ হয়। আমরা আশা করেছিলাম পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের বিষয়ে তৎপর হবে। কিন্তু মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ বারবার প্রতিশ্রুতি দিয়েও সেই প্রতিশ্রুতি এড়িয়ে গিয়েছে। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগদানের সময় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সম্পর্কে রয়টার্সকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানান, ‘তারা সব বিষয়ে রাজি হচ্ছে, কিন্তু সে অনুযায়ী কাজ করছে না। এটাই হলো সমস্যা। সবকিছু ঠিকঠাক থাকে কিন্তু সব সময় তারা কোনও না কোনও অজুহাত হাজির করে।’ বিশ্ববাসীও দেখছে, মিয়ানমার বলছে, তারা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে প্রস্তুত। তাদের ফিরিয়ে নেওয়ার পর প্রাথমিকভাবে তাদের আবাসনের ব্যবস্থা করতে রাখাইনে ট্রানজিট কেন্দ্র তৈরি করা হয়েছে। আবার তারা এমন অভিযোগও করছে বাংলাদেশ তাদের সহযোগিতা করছে না। মিয়ানমার এমন কথা বললেও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা বলছে এখনই রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য রাখাইন প্রস্তুতও নয়–নিরাপদও নয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দৃঢ়কণ্ঠে বলেছেন, ‘বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের জন্য স্থায়ী আবাসন নিশ্চিত সম্ভব নয়, তাছাড়া দেশের মানুষও তা মেনে নেবে না। তারা মিয়ানমারের নাগরিক এবং তাদের অবশ্যই ফিরে যেতে হবে।’ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে মিয়ানমার বরাবরই বাংলাদেশের সঙ্গে বিভিন্ন চুক্তি ও সমঝোতায় স্বাক্ষর করছে, আবার সুযোগ বুঝে তা অবহেলায় এড়িয়েও যাচ্ছে। মিয়ানমারের এই দ্বিচারী ভূমিকা কেবল বাংলাদেশই নয়, বাংলাদেশের অনেক বন্ধু রাষ্ট্রকেই বিভ্রান্ত করছে। এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি কানাডা মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি’কে দেওয়া সে দেশের সম্মানসূচক নাগরিকত্ব বাতিল করে দিয়েছে।

মিয়ানমার আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী। কিন্তু আমরা দেশটিকে সঠিকভাবে এখনও চিনতে পারিনি, বুঝতে পারিনি। রোহিঙ্গা ইস্যুতে নানা রকমের টালবাহানার পর সম্প্রতি ভৌগোলিক শিষ্টাচার লঙ্ঘনের ঘটনাও ঘটিয়েছে তারা। বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিনকে মিয়ানমার তার নিজ ভূখণ্ড বলে দাবি করেছে। যদিও এ ঘটনা জানার সঙ্গে সঙ্গে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত উ লুইন ও-কে তলব করে তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। ৬ সেপ্টেম্বর শনিবার দুপুরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিটের প্রধান রিয়ার অ্যাডমিরাল (অবসরপ্রাপ্ত) মো. খুরশেদ আলমের দফতরে তাকে ডেকে আনা হয়। সেন্ট মার্টিন দ্বীপ বাংলাদেশের সম্পদ। তার পুঙ্খানুপুঙ্খ প্রমাণও আছে। সেন্ট মার্টিনের কিছু অংশ দাবি করার মধ্য দিয়ে মিয়ানমার আবার নতুন বিতর্ক সৃষ্টি করলো। এই বিতর্কের মধ্য দিয়ে সকলের মনোযোগ ও দৃষ্টি কোনদিকে ঘুরিয়ে নিলো–বিশ্লেষকদের তা গভীরভাবে খতিয়ে দেখতে হবে।

গত বছর প্রাণভয়ে রাখাইনের রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের লাখ লাখ মানুষ যখন সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে এসে জীবন বাঁচাতে তৎপর তখন সেদেশের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কেউ কেউ বাংলাদেশের ফেনী পর্যন্ত মিয়ানমারের অংশ বলে দাবি ও তা দখলের জন্য জনমত গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছিল। এসব দেখে শুনে তাদের প্রকৃতপক্ষে মগের মুল্লুকের মানুষ বলেই মনে হয়।

রাষ্ট্রদূত উ লুইন ও-কে তলব করলে মৌখিকভাবে তিনি দুঃখ প্রকাশ করলেও রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে স্বাক্ষরিত নানা চুক্তি ও সমঝোতা নিয়ে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ যেভাবে চুক্তিভঙ্গ করেছে, প্রকৃত ঘটনা আড়াল করেছে, সেন্ট মার্টিন ইস্যুতে তার ব্যতিক্রম কিছু করবে, তা ভেবে আমরা আশ্বস্ত হতে পারি না, বিশ্বাসও করতে পারি না। এ বিষয়ে আরও কঠোর ভূমিকা নিয়ে বাংলাদেশকে মিয়ানমারের মুখোমুখি হতে হবে। আলোচনার টেবিল থেকে সর্বত্র। কারণ, আমরা জানি ব্রিটিশ-ভারত থেকে মিয়ানমার (তৎকালীন বার্মা) আলাদা হওয়ার সময় সেন্ট মার্টিন ভারতের অংশ ছিল। এরপর ১৯৪৭ সালে দেশ-ভাগের সময় সেন্ট মার্টিন তৎকালীন পাকিস্তানের এবং ১৯৭১ সালে তা স্বাভাবিকভাবেই তা স্বাধীন বাংলাদেশ ভূখণ্ডের অংশ হয়। এ নিয়ে কারও হস্তক্ষেপ মানেই বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের ওপর হস্তক্ষেপ। যা এদেশের কোনও নাগরিকই মেনে নিতে পারে না। মেনে নেবেও না।

লেখক: অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

/এসএএস/এমএনএইচ/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু
চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু
রাজশাহীতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো বিভাগীয় সর্বজনীন পেনশন মেলা
রাজশাহীতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো বিভাগীয় সর্বজনীন পেনশন মেলা
রুবেলকে শোকজ দিলো উপজেলা আ’লীগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ পলকের
নাটোরে উপজেলা নির্বাচনরুবেলকে শোকজ দিলো উপজেলা আ’লীগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ পলকের
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ