X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

অংশগ্রহণমূলক-গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হলেই বা কী?

ডা. জাহেদ উর রহমান
১১ অক্টোবর ২০১৮, ১৯:৫১আপডেট : ১১ অক্টোবর ২০১৮, ২০:২৫

ডা. জাহেদ উর রহমান শিরোনামের প্রশ্নটি ইদানিং বেশ শোনা যায়। শোনা যায় এই সম্পূরক প্রশ্নও—গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হলে সেই নির্বাচনে কে ক্ষমতায় আসবে? প্রশ্নগুলো এই রাষ্ট্রের কিছু নির্দিষ্ট ‘সুশীল’ বাজারে ছেড়েছিলেন। এই দৌড়ে রাজনৈতিক নেতারাও যে খুব পিছিয়ে আছেন, তা নয়। আমরা মনে করতে পারবো, একটি বড় বাম দলের একজন খুব বড় নেতাও কয়েক মাস আগে ঠিক একই প্রশ্ন করেছিলেন। এখন যেই একটা অংশগ্রহণমূলক, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবিতে মাঠের সব বিরোধী দল একজোট হয়ে আন্দোলন করার আহ্বান জানাচ্ছে তখন আবার এই প্রশ্ন আগের চাইতে অনেক বেশি জোরেশোরে আলোচিত হচ্ছে।
যে প্রশ্নটি তোলা হচ্ছে আমাদের দেশে, সেই প্রশ্ন কি তোলা হচ্ছে ভারতে? বর্তমান সরকারের আগে সেখানে ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস সরকার। ২০১৪ সালের আরেকটি নির্বাচন যখন এগিয়ে আসছিল তখন নানা জনমত জরিপে এটা প্রায় স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছিল সেই নির্বাচনে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল বিজেপি ক্ষমতায় আসতে যাচ্ছে। ভারতের সাংবিধানিক যে মূল চেতনা, তার সঙ্গে বিজেপির নানান দিক থেকে খুব বড় বৈপরীত্য আছে। ভারতের বর্তমান সরকারটি দেখে আমাদের কাছে এই ধারণা আরও স্পষ্ট হওয়ারই কথা। মজার ব্যাপার, ২০১৪ সালে ভারতে বাংলাদেশের মতো কেউ প্রশ্ন তোলেননি,  গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে ভালো কথা, কিন্তু সেই নির্বাচনে কে ক্ষমতায় আসবে? তাই নির্বাচন হলেই বা কী লাভ?

ত্রুটিমুক্ত কোনও সিস্টেমের অস্তিত্ব পৃথিবীতে নেই। মানে আমরা যখন একটা সিস্টেম গ্রহণ করি সেটা সেই সিস্টেমের ত্রুটিসহই  গ্রহণ করতে হয়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার ত্রুটির শক্ত প্রবক্তারাও স্বীকার করেন। এমনকি অত্যন্ত উন্নত, পরিণত গণতান্ত্রিক দেশে গণতান্ত্রিকভাবে নেওয়া সিদ্ধান্ত ভুলও হতে পারে। কিছুদিন  আগে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার প্রশ্নে (যা প্রচলিত কথায় ‘ব্রেক্সিট’ বলেই বেশি পরিচিত) বেরিয়ে যাওয়ার পক্ষে ভোট দিয়ে ব্রিটিশরা ভুল করেছে, এমন আলোচনা খুব জোরেসোরে হয়েছে। ঠিক একইভাবে জনগণের ভোটেই এমন কোনও শক্তি ক্ষমতায় আসতে পারে, যেটা মানুষের জন্য কল্যাণকর হয় তো হবে না। কিন্তু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তেমন একটা শক্তিকেও গ্রহণ করতে হবে এবং অপেক্ষা করতে হবে আবার গণতান্ত্রিক পথে, ভোটের মাধ্যমেই সেই ভুলের সংশোধন করার।

অনেকেই বলেন, একটি ভালো নির্বাচন মানেই গণতন্ত্র নয়। খুব সত্যি কথা। একটা সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হলেই একটা রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এগিয়ে যাবে, দেশের মানুষ খুব ভালো থাকবে, এই নিশ্চয়তা নেই। এই সত্য মাথা পেতে স্বীকার করে নিয়েও বলছি, একটি ভালো নির্বাচন ছাড়া গণতন্ত্রের প্রথম পদক্ষেপটি দেওয়াও সম্ভব নয়। ‌অধিকন্তু ভালো নির্বাচনকে আমরা যেভাবে ছোট করে দেখার চেষ্টা করি, একটা ভালো নির্বাচনের প্রভাব, আমি বিশ্বাস করি, তার চাইতে অনেক অনেক বেশি।

জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত একটা সরকারের নৈতিক ভিত্তি শক্তিশালী হয়। সেই কারণে তেমন সরকার জনগণের স্বার্থরক্ষার প্রশ্নে দেশের ভেতরের এবং দেশের বাইরের যেকোনও শক্তির সঙ্গে দৃঢ়ভাবে যুদ্ধ করতে পারে। সেই সরকারকে এমনকি ইচ্ছা না থাকলেও জনগণের স্বার্থের পক্ষে দাঁড়াতে হয়, কারণ মেয়াদান্তে তাকে আবার ভোট চাইতে জনগণের কাছেই যেতে হবে। ঠিক একই কারণে প্রতিনিধিত্বশীল সরকার জনগণের ন্যায্য দাবি দাওয়ার প্রতি সংবেদনশীল থাকে। সম্ভব হলে দাবি মেনে নেওয়ার চেষ্টা করে। জনগণের ওপর নিপীড়ন চালায় না। তেমন সরকার প্রতিপক্ষের ওপরও বিভৎস রকম অত্যাচার চালায় না। কারণ সে জানে পরবর্তী নির্বাচনে সে যদি ক্ষমতাচ্যুত হয়, তাহলে তার ওপর একই রকম নিপীড়ন নেমে আসতে পারে। আজ যখন ক্ষমতাসীন দল বলছে ক্ষমতার পালাবদল হলেই এক লক্ষের মতো মানুষ মারা যাবে, তখন আমাদের বুঝতে হবে, তারা নিশ্চয়ই প্রতিপক্ষের কিছু একটা করেছেন, যেখানে তাদের মতে এই ভীতি বা আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। তারা যদি তাদের সামনে একটা নির্বাচন দেখতেন তাহলে এই পরিমাণ নিপীড়ন তারা প্রতিপক্ষের ওপরে চালাতেন না।

রোহিঙ্গা সংকটে সরকারের তিন ‘বন্ধু রাষ্ট্র’ ভারত, চীন ও রাশিয়া বাংলাদেশের পক্ষে না থেকে আছে মিয়ানমারের পক্ষে। অথচ ওই তিনটা রাষ্ট্র আমাদের দেশের সঙ্গে নানা রকম ব্যবসা করছে এবং নানান রকম কৌশলগত সুবিধা আদায় করে নিচ্ছে। ২০১৪ এরপর যে সরকারটি গঠিত হয়েছে সেটির নৈতিক ভিত্তি একেবারেই দুর্বল থাকার কারণে ওই রাষ্ট্রগুলো জানে ক্ষমতায় থাকার স্বার্থে বর্তমান সরকার তাদের এমনিতেই তোয়াজ করবে। বাংলাদেশের স্বার্থ দেখার কোনও প্রয়োজন তাদের নেই।

ওদিকে প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত না হওয়া সরকার ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে রাষ্ট্রের ভেতরের যেকোনও শক্তিশালী গ্রুপের পক্ষে থাকে। বর্তমান বাংলাদেশে যে নোংরা ‘ক্রনি ক্যাপিটালিজম’ চালু আছে, তাতে আমলা, ব্যবসায়ী ও ক্ষমতাসীন দলের সদস্যদের মধ্যে এক ধরনের নেক্সাস তৈরি হয়েছে এবং সরকার আপামর কোটি কোটি মানুষের স্বার্থ না দেখে দেখে থাকে মূলত সেই মানুষগুলোর স্বার্থ। তাই তো কমপক্ষে ২৫০ কোটি টাকার মালিক অতি ধনীদের সংখ্যা বৃদ্ধির হার এই বিশ্বে বাংলাদেশেই সর্বোচ্চ। এছাড়া সরকারি-পর্যায়ে দেখি, অবিশ্বাস্য পরিমাণ বেতন বৃদ্ধি, পদ না থাকার পরও যুগ্ম-সচিব, অতিরিক্ত সচিব এবং সচিব পদে পদোন্নতি ইত্যাদি। ওদিকে সরকার কিন্তু গার্মেন্ট শ্রমিকদের দাবিকৃত ন্যূনতম ন্যায্য মজুরি, ১৬ হাজার টাকা স্থলে এর অর্ধেক নির্ধারণ করেছে। ক্ষমতায় থাকার জন্য মানুষের ভোটের প্রয়োজন না থাকলে এভাবেই কৃষক-শ্রমিকের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে পুঁজিপতি এবং প্রভাবশালী আমলাদের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য রাষ্ট্রের যাবতীয় নীতি পরিচালিত হয়।

এদিকে মানুষ যখন তার কোনও গণতান্ত্রিক ন্যায্য অধিকার নিয়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামের জন্য মাঠে নামতে চায়, তখন সরকার নিপীড়ক হয়ে ওঠে। কারণ সরকার সারাক্ষণ ক্ষমতা হারানোর ভয়ে ভীত থাকে। সম্প্রতি কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং নিরাপদ সড়কের দাবিতে কিশোরদের আন্দোলনের সময় আমরা দেখেছি সেই আন্দোলনেও সরকার প্রচণ্ড ভীত হয়ে তাদের ওপরে প্রচণ্ড রকম মারমুখী আচরণ করেছে। হেলমেট বাহিনী, পুলিশের পিটুনি, মামলা সব রকম নিপীড়ন চাপিয়ে দেওয়া হয় আন্দোলনকারীদের ওপর।

এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ যে গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা বাংলাদেশের শুরু হয়েছিল, তাতে পরপর দু’টি সরকার ১৯৯১ সালে বিএনপি এবং ১৯৯৬ সালের আওয়ামী লীগ সরকার নানা রকম বিচ্যুতি সত্ত্বেও যথেষ্ট ভালো ছিল। ভালো নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত হওয়া আরও দু’টি সরকার ২০০১ সালের বিএনপি ২০০৯ সালের আওয়ামী লীগের সরকার দু’টি আগের সরকার দু’টির তুলনায় অনেক নিম্নমানের ছিল। এই উদাহরণ দিয়ে অনেকেই বলতে পারেন ভালো নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকার তো নিম্নমানেরও হতে পারে।

আমি ২০০১ ও ২০০৯-এর বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সরকার দু’টিকে একটু ভিন্নভাবে দেখতে চাই। এই সরকার দু’টি প্রত্যক্ষ ভোটে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হলেও আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, ওই সরকারগুলো অত্যন্ত বাজে শাসন করার কারণ হচ্ছে, এই দু’টি সরকার তাদের সামনে নির্বাচন দেখছিল না। ২০০১ সালে বিএনপি সরকার শুরু থেকেই জানতো বিচারপতির বয়স বাড়িয়ে ২০০৬ সালে গিয়ে  তত্ত্বাবধায়ক সরকারটা কব্জায় এনে তারা ক্ষমতায় থেকে যাবে। আর ২০০৯ সালের আওয়ামী লীগ সরকারও জানতো, তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে আবার ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে নির্বাচন করে ক্ষমতায় থেকে যাবে। জানি তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল নিয়ে অনেকেই ‘হাইকোর্ট’ দেখাবেন, পরিসরের স্বল্পতার জন্য সেই তর্কে আমি এখন ঢুকছি না। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি ২০০১ আর ২০০৯ এর সরকার দু’টি তাদের সামনে একটা অংশগ্রহণমূলক, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেখছিল না, তাই তারা মানুষকে মোটা দাগেও খুশি না রেখে খুব অপশাসন চালিয়েছে।

আসুন, এবার ২০০৯ সালের আর ২০১৪ সালের আওয়ামী লীগ মধ্যে তুলনা করি। দেখা যাবে, নানা অপশাসন সত্ত্বেও ২০০৯ সালে জনগণের ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত সরকারটি ২০১৪ সালের সরকারটির চাইতে ‘কম খারাপ’ ছিল।

খুবই দুঃখজনক ব্যাপার হলো, আর তিন বছর পরই স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করতে যাওয়া এই জাতি এখনও একটা নির্ঝঞ্ঝাট ক্ষমতার পরিবর্তনের পথ নিশ্চিত করতে পারেনি। সেটা নিশ্চিত করতে পারলে এমনকি আমাদের অনেকেরই ক্ষুব্ধতা তৈরি করা ‘বড় দল’ দু’টিও মানুষকে অনেক কম দুর্নীতিপরায়ণ, বেশি কল্যাণকর শাসন উপহার দিতে পারতো।

এই দেশে কে ক্ষমতায় থাকবে বা থাকবে না, ক্ষমতায় গিয়ে কী করবে বা করবে না, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য কার সঙ্গে জোট করবে বা করবে না, এই আলোচনা অপ্রয়োজনীয় নয়, কিন্তু একটা নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংস করে একটা দলের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার যৌক্তিকতা দেওয়ার জন্য উল্লিখিত আলোচনা করাটা এই রাষ্ট্রের জন্য ভয়ঙ্কর ক্ষতিকর। সেই উদ্দেশ্য মাথায় রেখে এই সব আলাপ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ‘ব্ল্যাসফেমি’ হিসাবে বিবেচিত হওয়া উচিত। একটার পর একটা জনগণের প্রতিনিধিত্বহীন সরকারের শাসন এই রাষ্ট্রে চলতে থাকলে সেটা রাষ্ট্র ব্যবস্থাটিকেই ভেঙে ফেলবে।

অনেকটা ভেঙে পড়া রাষ্ট্র ব্যবস্থাটি পুরো ভেঙে পড়া থেকে বাঁচাতে সামনের সবগুলো নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক, গ্রহণযোগ্য করার কোনও বিকল্প নেই আমাদের সামনে। তাই আমরা যারা স্বীয় জায়গা থেকে এমন একটা নির্বাচন নিশ্চিত করার সংগ্রাম করছি না, তারা প্রকারান্তরে এই রাষ্ট্র-ব্যবস্থাটিকে পুরোপুরি ভেঙে ফেলায় অংশ নিচ্ছি।

লেখক: সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, নাগরিক ঐক্য

 

/এসএএস/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ইউক্রেনের শান্তি পরিকল্পনা অর্থহীন: ল্যাভরভ
ইউক্রেনের শান্তি পরিকল্পনা অর্থহীন: ল্যাভরভ
বিএনপির নিগৃহীত নেতাকর্মীদের তালিকা চাইলেন ওবায়দুল কাদের
বিএনপির নিগৃহীত নেতাকর্মীদের তালিকা চাইলেন ওবায়দুল কাদের
৭ বছর পর নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নতুন কমিটি
৭ বছর পর নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নতুন কমিটি
‘ভারতের কঠোর অবস্থানের কারণেই পিটার হাস গা ঢাকা দিয়েছেন’
‘ভারতের কঠোর অবস্থানের কারণেই পিটার হাস গা ঢাকা দিয়েছেন’
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ