X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

তাহলে কি জজ মিয়ারই ফাঁসি হওয়া উচিত ছিল?

প্রভাষ আমিন
১৪ অক্টোবর ২০১৮, ১৪:৩৪আপডেট : ১৪ অক্টোবর ২০১৮, ১৪:৩৭

প্রভাষ আমিন ২১ আগস্ট মামলার রায় ঘোষণার আগে থেকেই বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা আশা করে আসছিলেন, এই মামলায় সবাই খালাস পাবেন। আসামিপক্ষের আইনজীবীরাও আসামিদের বেকসুর খালাস চেয়েছিলেন। রায় ঘোষণার পর বিএনপি নেতারাও বলছেন, এটি ফরমায়েশি রায়। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণেই এ রায় দেওয়া হয়েছে। আমি বিএনপি নেতা ও আইনজীবীদের দাবিকে সত্য বলে ধরে নিচ্ছি। কিন্তু তার আগে আমার কিছু প্রশ্ন আছে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে গ্রেনেড হামলা হয়েছিল; এটা তো সত্যি? হামলার মূল টার্গেট ছিলেন তখনকার বিরোধীদলীয় নেতা, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা; এটাও তো সত্যি? ভাগ্যগুণে শেখ হাসিনা বেঁচে গেলেও আইভি রহমানসহ ২৪ জনের মারা যাওয়ার খবরও তো মিথ্যা নয়? এখনও যে শত শত মানুষ মনে আতঙ্ক আর শরীরে স্প্লিন্টার নিয়ে বেঁচে আছেন; তাও তো মিথ্যা নয়? তাহলে বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের দাবি অনুযায়ী যদি সব আসামিকে বেকসুর খালাস দিয়ে দেওয়া হয় তাহলে প্রশ্ন হলো–২১ আগস্টের হামলাটা করলো কারা? এই হামলার জন্য তাহলে কারা দায়ী?

বিএনপি নেতাদের দাবি অনুযায়ী যদি তাদের দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ দলের নেতাদের রাজনৈতিক কারণে আসামি করা হয়; তাহলে হামলাটা কারা করেছিল, সে প্রশ্নের উত্তর কিন্তু বিএনপিকেই দিতে হবে। কারণ, হামলার সময় বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় ছিল। ক্ষমতায় থাকলেই বিএনপিকে হামলার দায়িত্ব নিতে হবে এমন সরলীকরণের সঙ্গেও আমি একমত নই। যেমন এখন অনেকে বলছেন, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার দায় যদি বিএনপিকে নিতে হয়; তাহলে বিডিআর বিদ্রোহ, হলি আর্টিজানের দায়ও আওয়ামী লীগকে নিতে হবে। অবশ্যই আওয়ামী লীগকে নিতে হতো, যদি তারা বিচার না করতো। কিন্তু ২১ আগস্টের দায় বিএনপিকে নিতে হবে; কারণ, গ্রেনেড হামলার পরও বছরদুয়েক তারা ক্ষমতায় ছিল, কিন্তু বিচার করা তো দূরের কথা, সুষ্ঠু তদন্তও তারা করেনি। বরং বিএনপি সরকার শুরু থেকেই ঘটনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে সচেষ্ট ছিল। তাদের চেষ্টা ছিল যত দ্রুত সম্ভব সব আলামত সরিয়ে ফেলা যায়। প্রথমে তারা শৈবাল সাহা পার্থ নামে নিরীহ এক ছাত্রকে বলির পাঁঠা বানানোর চেষ্টা করে। তারপর ধরা হয় আওয়ামী লীগ নেতা ওয়ার্ড কমিশনার মোখলেসুর রহমানকে। সেটাও না পেরে মঞ্চে আনা জজ মিয়াকে। জালাল নামে এই ভবঘুরেকে ধরে এনে জজ মিয়া নামে জাতির সামনে হাজির করা হয়। তাকে আসামি করে তার পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিয়েছিল সিআইডি। তখন তিন তদন্ত কর্মকর্তার সব ব্যস্ততা ছিল মূল অপরাধীদের আড়াল করায়। এমনকি বিচারপতি জয়নুল আবেদিনের নেতৃত্বে গঠিত বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশনও হাজির করে নতুন আষাঢ়ে গল্প–পাশের দেশ থেকে সন্ত্রাসীরা এসে নাকি গ্রেনেড মেরেছে। সঠিক তদন্ত তো করেইনি, বরং তখন সরকার বারবার বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছে। এমনকি শেখ হাসিনা ভ্যানিটি ব্যাগে করে গ্রেনেড নিয়ে এসেছিলেন, এমন অভিযোগও করা হয়েছে। মুক্তাঙ্গন থেকে কেন সমাবেশ বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে সরিয়ে নেওয়া হলো, এ কথা বলে সন্দেহের তীর আওয়ামী লীগের দিকে ছোড়া হয়েছে। আওয়ামী লীগ নাকি নিজের নাক কেটে বিএনপির যাত্রাভঙ্গের চেষ্টা করেছে। তাছাড়া বিএনপি সরকার কেন এমন হামলা চালিয়ে নিজেদের অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করবে। এসব যুক্তি দিয়ে দায় আওয়ামী লীগের ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা হয়েছে। আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড কমিশনারকে রাজসাক্ষী বানানোর চেষ্টা হয়েছে। কোনও চেষ্টাই সফল হয়নি। কারণ, সত্যকে বেশি দিন ঢেকে রাখা যায় না। বিএনপির দাবি যদি সত্য হয়, যদি সত্যিই তাদের নেতাদের রাজনৈতিক কারণে জড়ানো হয়ে থাকে; সেই সত্যও একদিন উন্মোচিত হবে।

বিএনপি সরকারের কেউ যদি গ্রেনেড হামলায় জড়িত নাও থাকতেন, তাহলেও আলামত নষ্ট করা, ভুল ও বিভ্রান্তিকর তদন্ত, ভুল বক্তব্য দেওয়ার দায় হলেও তাদের নিতে হবে। বিএনপি সমর্থকরা বলছেন, যে মুফতি হান্নানের সাক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করে পুরো বিচার হলো, তাকে তো বিএনপি আমলেই গ্রেফতার করা হয়েছিল। সরকার যদি মুফতি হান্নানকে দিয়ে গ্রেনেড হামলা ঘটিয়েই থাকে–তাহলে তো তাকে আড়ালে রাখার কথা, গ্রেফতার করলো কেন? একই যুক্তি তারা দেয় চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্র আটক নিয়েও। সরকার যদি এ অস্ত্র আনার সঙ্গে জড়িতই থাকবে, তবে আটক করলো কেন? অকাট্য যুক্তি, সন্দেহ নেই। কিন্তু এখন এটা দিবালোকের মতো সত্য যে এ দুটি ঘটনাতেই বিএনপি রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করেছিল। তবে কখনোই পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করা হয় না বা যায় না। একটা অংশকে ব্যবহার করা হয়েছিল। এই অংশের বাইরে থাকা র‌্যাব আর পুলিশের ‘বোকা’ সদস্যদের ভুলে চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্র এবং মুফতি হান্নান আটক হয়েছিল। আর ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর হামলার ঘটনায় মুফতি হান্নানকে গ্রেফতারের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক চাপ ছিল। এখন এও জানা যাচ্ছে, গ্রেফতারের পর মুফতি হান্নান গোয়েন্দাদের কাছে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় রাষ্ট্রযন্ত্রের জড়িত থাকার কথা ফাঁস করে দিয়েছিলেন। গোয়েন্দারা বিষয়টি তখনকার প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে জানিয়েছিলেনও। তার মানে গ্রেনেড হামলার বিষয়টি আগে না জানলেও পরে জেনেছিলেন খালেদা জিয়া। কিন্তু সন্তান, দল ও সরকারকে বাঁচাতে বিষয়টি নিয়ে আর এগুতে দেননি তিনি। তখন বেগম খালেদা জিয়া যদি এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করতেন তাহলে তখন তার সরকার হয়তো বিপাকে পড়তো, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে দলটি বেঁচে যেতে পারতো। বিএনপি নেতারা এখনও সেই অস্বীকার প্রবণতা, সেই ধামাচাপা, সেই আষাঢ়ে গল্পেই ডুবে আছেন। কার্পেটের নিচে চাপা দিয়ে রাখলেই ময়লা আড়াল করা যায় না। তেমনি বিএনপিও স্রেফ অস্বীকার করে এ দায় এড়াতে পারবে না। সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে আদালতে-রাজপথে।

গ্রেনেড হামলার পরও বছরদুয়েক ক্ষমতায় ছিল বিএনপি। কিন্তু তারা তখন সঠিক তদন্ত না করে ছেলেখেলা করেছে। এই অন্ধকারে প্রথম আলো ফেলতে শুরু করে ১/১১ সরকার। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে নতুন করে তদন্ত করেছে। বিএনপির অভিযোগ, অবসরে যাওয়া পুলিশ কর্মকর্তা আব্দুল কাহার আকন্দকে ফিরিয়ে এনে লোক দেখানো তদন্ত করা হয়েছে। অবসরের পর কাহার আকন্দ আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছিলেন। অভিযোগ একদম সত্যি এবং যৌক্তিক। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশে সব পেশার মানুষই দ্বিদলীয় রাজনৈতিক ধারায় বিভক্ত। আওয়ামী লীগ সরকার ২১ আগস্ট মামলার তদন্তের জন্য বিএনপিপন্থী কোনও পুলিশ কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেবে, এমন আশা করা বোকামি। বিএনপি আমলে যে তিন কর্মকর্তা এ মামলা তদন্ত করেছেন, তারা কেউ নিশ্চয়ই আওয়ামীপন্থী ছিলেন না। বিড়াল সাদা না কালো, সেটা প্রশ্ন নয়–প্রশ্ন হলো বিড়াল ইঁদুর মারে কিনা? কাহার আকন্দ আওয়ামী লীগ না বিএনপি সেটা না খুঁজে বলুন তার তদন্ত ঠিক আছে কিনা? নাকি তিনিও আগের মতো আষাঢ়ে গল্প ফেদেছেন? আব্দুল কাহার আকন্দের তদন্ত আমার কাছে অন্তত আষাঢ়ে গল্প মনে হয়নি। উনি বিশ্বাসযোগ্যভাবেই ঘটনা পরম্পরার মালা গাঁথতে পেরেছেন। তারেক রহমানের উপস্থিতিতে হাওয়া ভবনে বসে মূল পরিকল্পনা অবিশ্বাস্য মনে হয়নি। বরং ঘটনার পর একে ভিন্নখাতে নিতে বিএনপির প্রাণান্তকর চেষ্টাই এ অভিযোগকে আরও বেশি বিশ্বাসযোগ্যতা দেয়। তারপরও আমি বিএনপিপন্থী আইনজীবী ও বিএনপি নেতাদের দাবি মেনে নিতে তৈরি। রাজনৈতিক হয়রানির জন্য দায়ের করা হলে এ মামলার সব আসামিকে উচ্চ আদালতে খালাস দেওয়া হোক। কিন্তু তাহলে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলাটা কে করলো, সে প্রশ্নের উত্তর তাদের দিতে হবে। আপনারা বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত করতে পারেননি, আবার আরেকজনের তদন্তকেও বিশ্বাস করছেন না; তাহলে কি ঘৃণ্য এই হামলার বিচার হবে না? নাকি তারেক রহমান, লুৎফুজ্জামান বাবর, আব্দুস সালাম পিন্টু, হারিছ চৌধুরীকে বেকসুর খালাস দিয়ে জজ মিয়ার ফাঁসি হলেই আপনারা খুশি হতেন? ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে গলা ফাটাতেন?

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
কান উৎসব ২০২৪জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ