X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

স্মৃতি 'পুজো মুবারক'

দাউদ হায়দার
১৭ অক্টোবর ২০১৮, ১৯:৫২আপডেট : ১৭ অক্টোবর ২০১৮, ২০:০০

 

দাউদ হায়দার আমাদের বিলাভেড পাবনার দোহারপাড়ায় কোনও হিন্দুর বাড়ি, বাস ছিল না। পাশের গ্রাম আরিফপুরে দুই ঘর ছিল। দোহারপাড়ার তিন সীমান্তের তিন গ্রামই হিন্দু অধ্যুষিত। নামেই পরিচিত, মহেন্দ্রপুর, বিজেন্দ্রানাথপুর, লক্ষ্মীপুর। আরেকটু এগিয়ে গেলেই হরিতলা। পদ্মা ঘেঁষে।
দোহারপাড়ায় হিন্দু না থাকলে ফুটবল খেলার বহু সঙ্গী হিন্দু। কেউ মহেন্দ্রপুরের, কেউ বজেন্দ্রনাথপুরের, কেউ আবার জোলাপাড়ায়। গত শতকের উনিশ শ ষাট দশকের গোড়ার কথা বলছি।
যেহেতু খেলার সঙ্গী এবং বন্ধু, নাম ধরে ডাকাডাকি, তুইতুকারি, মনে হয়নি কখনও, ওরা হিন্দু। বন্ধু কি কখনও হিন্দু হয়? নিশ্চয় না। ওরাও যা, আমরাও তাই। অর্থাৎ প্রত্যেকে মানুষ। কোনও ভেদাভেদ নেই। আমরা সবসময়ই বন্ধুদের বাড়ি যাই। ওরাও আসে। বন্ধুর বাবাকাকারাও আমাদের বাড়িতে আসেন। এমনকি ঈদেও। অগ্রজদের অধিকাংশ বন্ধু হিন্দু, তারাও আসেন।
একবার জীবন কাকাকে (জীবনকৃষ্ণ ঘোষ) জিজ্ঞেস করি, ‘হিন্দুরা কেমন দেখতে কেমন?’ অমায়িক হেসে উত্তর, ‘এই আমার মতো।’ খুব মজা পাই। তার মানে রসিকতা করছেন। কাকা আরও বলেন, ‘যার পৈতে আছে গলায়, সেই হিন্দু।’

প্রশ্ন করি: ‘পৈতে কাকে বলে?’

কাকা: যার গলায় দড়ি দেখবে। কেন গলায় দড়ি পরে জানো? যেকোনও সময় ফাঁসিতে ঝোলার ইচ্ছে। বজেন্দ্রনাথপুরের কৈলাস চক্রবর্তীকে দেখেছ, বুড়ো খাঁটি হিন্দু, বৌর সঙ্গে ঝগড়া করে গলায় দড়ি ঝুলিয়ে মরেছে। এই দ্যাখো আমার গলায় পৈতে নেই, তোমার কাকির সঙ্গে কত ঝগড়া করি, মাঝে-মাঝে খেতেও দেয় না, কিন্তু গলায় দড়ি দেই না।’ তার রসিকতায় সন্দেহ থাকে না, তিনি হিন্দু নন।

দোহারপাড়ার ভূগোল রহস্যময়। পাবনা শহরের পুরসভার যেখানে শেষ, পাকা রাস্তা (শের শাহ গ্র্যান্ড ট্রাংক রোড) আরও ৩০ মেইল লম্বা, শহর থেকেই সোজা চলে গেছে দোগাছি ছাড়িয়ে, কিন্তু দোহারপাড়ার শুরুতে কেন ইতি টানা, ১৯৬৪ সালে পাবনা ছেড়েছি, পুরসভার কর্তাদের জিজ্ঞেস করা হয়নি।

বিলাভেড আব্বা জান মোহাম্মদ হাকিমউদ্দিন শেখ কেন দোহারপাড়ায় নিশাল বাড়ি তৈরি করেন, পরে জেনেছি। শহরের ট্যাক্স দিতে হয় না। অথচ শহরের সমস্ত সুবিধাভোগী। পায়ে হেঁটে শহরের স্কুলে যাই, (ভাইবোন/অগ্রজকুল কলেজে)। পায়ে হেঁটেই শহরের বাজারে। সিনেমা-থিয়েটার হল। লাইব্রেরিসহ সব কালচারাল অনুষ্ঠানে। দোহারপাড়া আর শহরের কোনও পার্থক্য নেই।

আব্বাজান মোহাম্মদ হাফিজউদ্দিন শেখ কতটা ধুরন্ধর, পাক্কা হিসেবি, রাজা চতুর্থ লুই, বলা দরকার। পাবনা শহরের সবচেয়ে দামি, দ্রষ্টব্য এলাকায় বড়ো-বড়ো চোখ ধাঁধানো বাড়ি করেছেন। একাধিক। দোহারপাড়ায় বাড়ি করে শহরের বাড়িগুলো ভাড়া দিয়েছেন, লিজ দিয়েছেন। তো, মাসে-মাসে আয়। দোহারপাড়ার বাড়ির ট্যাক্স নেই (পুরসভার)।

দোহারপাড়ার বাড়ি থেকেই ভাইবোন ( যৌথ পরিবারের ভাইবোন। তথা ‘কাজিন’।) শহরের, বিশেষত কালাচাঁদপাড়া, রাধানগরে দল বেঁধে পুজো দেখতে যাই। সপ্তমী থেকে নবমী। বিকেল থেকে রাতে (আমরা ‘ছাওয়াপল’, তাই রাত ন’টায় বাড়ি ফেরা)। দশমীতে, অর্থাৎ বিসর্জনের (বিসর্জন ইছামতি নদীতে) দুপুর থেকেই পুজামণ্ডপে। ভাসানে যোগদান। বন্ধুদের সঙ্গে।

বলতে ভুলে গেছি, আমাদের মা-চাচিরাও পুজো দেখতে যেতেন (রিকশা চড়ে), পরনে বোরখা বা হিজাব ছিল না।

পুজোমণ্ডপে মেলা। বাহারি জিনিস, তৈজস থেকে নানা পোশাক। খেলনা। আমাদের জন্য কিনতেন। আমাদের ছোট চাচিমা একবার দুর্গার প্রতিমা (ছোট) কিনে উপহার দিয়ে বলেন, ‘আমার বৌমা, তোর বৌ, এরকম সুন্দরী হবে।’

বলতে এও ভুলে গেছি, জীবনকাকার সঙ্গে যাওয়া দারুন ব্যাপার। বলেন, ‘দুই হাত তুলে দুর্গাকে সালাম করবি (‘পেন্নাম’ বলতেন না), কপালে হাত রেখে। তা হলে প্যারা, বাতাসা, রসকদম্ব, জিলিপি (অর্থাৎ ভোগ) বেশি পাবি।’ বলেই, ‘এখানে দাঁড়া, যাবি না।’ কিছুক্ষণপরেই প্যাকেটে (আজকের ভাষায় ‘ঠোঙ্গা’) ‘ভোগ’ নিয়ে হুকুম, ‘খায়ে (খেয়ে) শ্যাষ কর, আবার আনবোনে।’

পুজো নিয়ে কেন এই অতীত স্মৃতি?—পুজোর স্মৃতি সতত সুখের।—এই স্মৃতি পাবনার।

ঢাকার পুজোর স্মৃতি শাহরিক। আমাদের বাস যদিও মালিবাগে ছিল, কিন্তু সিদ্ধেশ্বরী এলাকারই (সিদ্ধেশ্বরী হাইস্কুলে ছাত্র ছিলুম), ষাটের দশকে সিদ্ধেশ্বরী কালীবাড়ির পুজোর মস্তানি না করলে কি রাধিকা ঘোষালের সঙ্গে ‘ইয়েটিয়ে’ হতো? রাধিকা জিজ্ঞেস করেননি, ‘তুমি কি মুসলিম?’

ঢাকার (পুরনো) পুজোয় কলতাবাজার-বক্সিবাজার-শাখারপট্টি- এগারোজন বন্ধুকে নিয়ে (প্রত্যেক মুসলিম)কে মস্তানি করেছিল, পাহারা দিয়েছিল? ১৯৬৭-১৯৬৮ সালে? থাক সেসব।

ঢাকা-কলকাতার বিস্তর বন্ধুবান্ধব, পত্রপত্রিকার সম্পাদকের তাগাদা, দুই বাংলার পুজোর স্মৃতি নিয়ে লিখুন। বলি, ‘ধেৎ।’ কেন বলি? ১৯৭৪ থেকে ১৯৮৭ পর্যন্ত কলকাতায়। ১৯৭৪-৭৮ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন হোস্টেলে আবাসিক, পুজোর ছুঁতোয় হোস্টেলেই থাকতুম (বাংলাদেশে যাওয়া নিষেধ, সরকারি নিষেধাজ্ঞা)। পুজোর দিনগুলোই একমাত্র আনন্দের।

যাদবপুরের পুজো, বাঘাযতীন বা গড়িয়ার পুজো পাত্তাই দেই না। হোস্টেলের সামনে আনোয়ার শাহ রাস্তা পেরুলেই যোধপুর পার্কের জাঁকজমক পুজো। সেক্রেটারি হয়ে গেলুম। চ্যালেঞ্জ টাকুরিয়া, একডালিয়া (সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের পুজো। তখন তিনি পশ্চিমবঙ্গ কংগ্রেস সরকারের মন্ত্রী। এখন আবার তৃণমূল সরকারের।) ডোভারলেন, পার্ক সার্কাস, ভবানীপুর, মানিকতলা, বেলেঘাটা, টালিগঞ্জসহ আরও অনেক। পুজোমণ্ডপ, সাজসজ্জা, দেবদেবীর শৈল্পিক কারুকর্মে যোধপুর দ্বিতীয় পুরস্কারে ভূষিত।

আনন্দবাজার পত্রিকার রিপোর্ট: ‘সার্বিক কর্মকাণ্ডে একজন, তিনি কবি, তিনি বাংলাদেশের, তিনি মুসলিম।’

পাবনার পুজো, ঢাকার পুজো, কলকাতার পুজো (পশ্চিমবঙ্গের), পুজো এখন ‘মিস’ করি। পুজোর আনন্দে মশগুল ছিলুম। ধর্মীয়বোধে নয়। মানুষের সার্বিক সম্মিলনে। সীতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে সারারাত্রি এ-মণ্ডপ-ও মণ্ডপ (উত্তর-দক্ষিণ কলকাতায়) ঘোরাঘুরি, কেউ প্রশ্ন করেনি, ‘মশাই, আপনি কি মোছলমান?’

পুজো নিয়ে, পুজোর আনন্দ নিয়ে কলকাতাসহ পশ্চিমবঙ্গে, ভারতের নানা প্রদেশে (যেখানে বাঙালি অধ্যুষিত) প্রশ্ন তুলছেন, ‘পুজোর আনন্দে কেন মুসলিম?’ খবর নর্দান ইন্ডিয়ান পত্রিকার (১৪ অক্টোবর)।

- হিন্দুত্ববাদীদের প্রশ্ন যতই থাক, ভারতের অগুনতি মানুষ সেক্যুলার। প্রমাণ, কলকাতা-ওড়িশা-ব্যাঙ্গালোর-বিহার-দিল্লি-মুম্বাই-আসাম, উত্তর-দক্ষিণ ভারত ও দক্ষিণ ভারতের মানুষ (বন্ধুরা) ‘পুজো মুবারক’ জানিয়ে লিখেছেন, ‘আমরা একাত্ম। পুজো মুবারক, ঈদ মুবারক, বড়োদিন মুবারক, সবদিনের মুবারকই আত্মিকতা। পুজো মুবারক উপলক্ষ মাত্র।’

কী আশ্চর্য! অষ্টমীর সন্ধ্যায়, হিন্দুর চেয়ে, বার্লিনের পুজামণ্ডপে বাংলাদেশি মুসলমানের সংখ্যা নজর কাড়ার। বলছে, পুজামুবারক।

লেখক: কবি ও সাংবাদিক

 

 

/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ