X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

সবার সম্প্রীতিতেই শেষ হোক দুর্গাপূজা

চিররঞ্জন সরকার
১৯ অক্টোবর ২০১৮, ১৬:৪০আপডেট : ১৯ অক্টোবর ২০১৮, ১৬:৪৭

চিররঞ্জন সরকার দুর্গাপূজা মূলত বাঙালির বাৎসরিক পূজা। রামচন্দ্রের শরৎকালে অকালবোধন ও দেবী পূজা এবং মেধসমুনি তার শিষ্যদের কাছে সুরথ রাজা ও সমাধি বৈশ্য-এর দুর্গা পূজার আখ্যান দিয়ে এই পূজার মর্তে প্রচলনের কথা আমরা ছোটবেলা থেকেই জেনে এসেছি। স্তব স্তুতি পূজায় অর্পিত ভক্তিতে সন্তুষ্ট হয়ে দেবী যখন আবির্ভূতা হয়ে বর দিতে চাইলেন, রাজা সুরথ তখন হৃত রাজ্য ও সমৃদ্ধি ফিরে পেতে চাইলেন। সমাধি বৈশ্য দেবীর কাছে বর চাইলেন মুক্তি। দেবী প্রসন্ন হয়ে দুজনেরই ইচ্ছাপূরণ করেন।
‘শ্রীশ্রীচণ্ডি’তে বলা হয়েছে জগৎপ্রপঞ্চের অন্তরালে এক মহাশক্তি আছেন, যিনি মহামায়া। এই মহামায়াই জগৎ সৃষ্টি করেন, পালন করেন, আবার প্রলয়কালে সংহারও করেন। অসুরদের হাতে নির্যাতিত দেবতারা মহামায়া বা সেই মহাতেজসম্ভুতা দেবীর সহায়তায় অসুরদের পরাজিত করে স্বর্গরাজ্য পুনরায় অধিকার করে নেন।
দেবী দুর্গার পূজা ভারতবর্ষের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের বহু জায়গাতেই হয়ে থাকে। তবে অঞ্চলভেদে দেবীর নামের এবং রূপের বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়। এই বৈচিত্র্যের বিস্তার প্রাচীনকাল থেকেই। শক্তিই সবকিছুর আধার। এই নিখিল বিশ্বচরাচরে তাঁর উপস্থিতি সর্বত্র। সর্বশক্তিময়ী মহামায়ার মহালীলায় সবকিছু গতিশীল, চঞ্চল। তিনিই সব কিছুর অধিশ্বরী। তাঁর অস্তিত্ব স্থলে জলে অন্তরীক্ষে, প্রতি অণু-পরমাণুতে। তাঁর উপাসনা অনেক স্থানেই হয়। তবে এক এক জায়গায় তাঁর এক এক নাম, এক এক রূপ। যেমন— আমাদের দেশে ও পশ্চিমবঙ্গে দুর্গা, ভারতের উত্তর প্রদেশে বিন্ধ্যবাসিনী, গুজরাটে কল্যাণী, মহারাষ্ট্রে ভবানী, তামিলনাড়ুতে মীনাক্ষী, কেরলে ভগবতী, কর্ণাটকে চামুণ্ডেশ্বরী।

হিন্দুশাস্ত্রের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য এই যে, এতে ঈশ্বরকে অজস্র-অসংখ্য নামে ডাকা হয়েছে। নারায়ণের যেমন সহস্র নাম রয়েছে, দুর্গাকেও সহস্র নামে ডাকা হয়েছে। ভিন্ন সময়ে ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে একটি করে পৃথক নাম দেওয়া হয়েছে। ভিন্ন ভিন্ন অঙ্গ রক্ষার জন্য ভিন্ন ভিন্ন নাম দেওয়া হয়েছে। ভিন্ন ভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন নামে ঈশ্বরের অধিষ্ঠান কথিত হয়েছে। যথা— মানসহ্রদে মৎস্য, হস্তিনাপুরে গোবিন্দ, কুরুক্ষেত্রে কুরুধ্বজ, হিমাচলে শূলবাহু, অবন্তিনগরে বিষ্ণু, বারাণসীতে কেশব, মর্ত্যলোকে অগস্ত্য, ভুবর্লোকে গরুড়, স্বর্গলোকে বিষ্ণু, জম্বুদ্বীপে চতুর্বাহু ইত্যাদি। শিব ও রাধিকারও সহস্র নাম কথিত হয়েছে।

দুর্গাদেবীর কাহিনিটি রূপক মাত্র। মহিষাসুর ও মহিষাসুরমর্দিনীর সংগ্রাম এবং পরিশেষে মহিষাসুরমর্দিনী কর্তৃক মহিষাসুরের পরাভব প্রকৃতপক্ষে মানুষের অন্তরস্থিত দেবতা ও দানবের-শুভশক্তি ও অশুভশক্তির সংগ্রাম এবং পরিশেষে শুভশক্তির কাছে অশুভশক্তির পরাজয়ের প্রতীক।   

‘দানব’ কারা? আমার লোভ, আমার ভীরুতা, আমার স্বার্থপরতা, আমার সঙ্কীর্ণতা। তারাই দানব। তারাই আমার এবং আমাদের চিরন্তন শত্রু। শত্রু সমাজের, শত্রু সভ্যতার। তাদের জয় করবে কে? আমি এবং আমরা। আমাদের অন্তরের দেবশক্তি। কুরুক্ষেত্র আসলে মানবের হৃদয়রূপ চিরন্তন রণক্ষেত্র এবং কৃষ্ণ-নিখিল বিশ্বের সমষ্টিভূত শুভশক্তির প্রতীক। চণ্ডী ও গীতায় যে ঐশী অঙ্গীকার উচ্চারিত বস্তুতপক্ষে একই মুদ্রার উভয় পিঠ। উভয়েই এক অদ্বয় সত্যের নিত্য উচ্চারণ। অর্থাৎ পুরাণে-কাহিনীর অন্তরালে নিহিত এক পরম গভীর সত্যের মুখ।
সুতরাং কবে, কোথায় কেন, কিভাবে দেবী দুর্গার আবির্ভাব ও সংগ্রাম-সেসব প্রশ্ন অবান্তর। পুরাণের সংগ্রাম-কাহিনীর বাস্তবতা নিয়ে বিচার গবেষণার প্রয়োজন অবশ্যই চলতে পারে, কিন্তু আমাদের অন্তর্জগতে যে নিরন্তর শুভ ও অশুভের সংগ্রাম চলছে এবং সেই সংগ্রামে আমরা প্রতিনিয়ত ক্ষতবিক্ষত হচ্ছি তার বাস্তবতা আমরা কেমন করে অস্বীকার করবো? এই সংগ্রাম যেমন অনাদি, তেমনি আপেক্ষিক বিচারে তা অনন্তও এবং এই সংগ্রাম পুরাণ-কথিত সংগ্রামের চেয়েও কঠিনতর। যতদিন সৃষ্টি থাকবে— ততদিন মানুষের মধ্যে এই সংগ্রাম চলতে থাকবে। দুর্গা ও মহিষাসুরের যুদ্ধ যেমন মানুষের মধ্যে শুভ ও অশুভের চিরন্তন যুদ্ধের প্রতীক।

তবে আমাদের দেশে যে দুর্গাপূজা হয়, তা একেবারেই লৌকিক, পুরাণের সঙ্গে এর মিল যৎসামান্য। শরৎকালের মহাপূজাতে বাঙালির হৃদয়ে দেবীর অধিষ্ঠান হয় প্রধানত কন্যারূপে। কার্ত্তিক, গণেশকে দেবীর পরিবারভুক্ত মনে করা হয়। বাঙালি হিন্দুগণ মনে করেন, শারদোৎসবের মাধ্যমে কন্যাস্থানীয় দেবী সপরিবারে চারদিনের দিনের জন্য পিতৃগৃহে আগমন করেন।

মাছেভাতে থাকা বাঙালি তাঁর রণরঙ্গিনী অসুরদলনী রূপকে মণ্ডপে সাজালেও অন্তরের অন্তঃকোণে নিশ্চিতরূপে বিশ্বাস করে যে, একবছর পর উমা ফিরেছেন তাঁর পিতৃগৃহে মাত্র চারটি দিনের জন্যে। এই বিশ্বাসকে অবলম্বন করে দেবীর আগমন এবং প্রত্যাবর্তন নিয়ে শাক্ত পদাবলীতে রচিত হয়েছে বহু আগমনী ও বিজয়ার গান, যেখানে বাঙালি ভক্তের কল্পনায় ভগবান দুর্গা হয়ে উঠেছেন ঘরের মেয়ে উমা, একান্ত আপনজন। বাৎসল্যরসের সুমধুর ছোঁয়ায় দেবী হয়েছেন মানবী, আবার মানবী হয়েও তিনি রয়ে গেছেন দেবী।

দুর্গা- মাত্র দুই অক্ষরের একটি শব্দ হলেও গূঢ় এর অর্থ। পণ্ডিতেরা বলেন, “দ” অর্থাৎ দৈত্যনাশক, উকার-বিঘ্ননাশক, রেফ-রোগঘ্ন, গ- পাপঘ্ন, আ-কার ভয় এবং শত্রুঘ্ন। অর্থাৎ দৈত্য,বিঘ্ন,রোগ,পাপ, এবং ভয় ও শত্রু হতে যিনি রক্ষা করেন তিনিই দুর্গা।

সন্তান প্রতিনিয়ত মায়ের কাছে প্রার্থনা করছে, আমাকে জ্ঞানবান, যশস্বী এবং শ্রীমান কর। আমায় রূপ দাও, জয় দাও, যশ দাও এবং শত্রু নাশ কর। মা দুর্গা স্বয়ং সমস্ত শক্তির আধার, সর্ব শক্তির ঘনীভূতা মূর্তি সর্বশক্তি স্বরূপিনী। তিনি পরিবৃতা হয়ে রয়েছেন সর্বাত্মক বিকাশের অধিষ্ঠাত্রী দেবী লক্ষ্মী, বিদ্যাদায়িনী সরস্বতী, শৌর্য-বীর্যের প্রতীক কার্তিক এবং সর্ব বিঘ্ন বিনাশকারী সিদ্ধিদাতা গণেশের দ্বারা। কাজেই তাঁকে যে প্রসন্ন করতে পারবে বিদ্যা, যশ, শ্রী সকলই যে তাঁর করতলগত হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

তবে সবাইকে নিয়ে ধর্ম পালন করাই আমাদের কর্তব্য হওয়া উচিত। দেবী দুর্গার আদর্শই হচ্ছে, সমন্বয়, সবাইকে নিয়ে, সবার জন্য।

ধর্ম পালনই বলি আর, সবাইকে নিয়ে অশুভের বিরুদ্ধে লড়াই-ই বলি, সবাই মিলেই তা করতে হবে। যদি আমরা ধর্মই পালন করি, তবে সব ধর্মের, সব জাতির, সব মানুষকে আমরা আমাদের পাশে টেনে আনতে পারি না কেন? ‘ধর্ম' শব্দের উৎপত্তি সংস্কৃত ‘ধৃ' ধাতু থেকে যদি হয়ে থাকে, তবে তার অর্থ তো ‘ধারণ করা। ‘যাহা সবাইকে ধারণ করে, তাহাই ধর্ম৷’ তবু সেই ব্যুৎপত্তিগত অর্থকে অমান্য করে আমরা ধর্মের নামেই সমাজে সবচেয়ে বড় বিভাজন রেখাটা টেনে দিয়ে বসে আছি৷ আর ধর্মাচরণ মুখ্য না হয়ে যদি উৎসবটাকেই প্রধান বলে বিবেচনা করে থাকি, তবে তো আবারও সেই একই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক— উৎসবের অঙ্গনে আবারও ধর্মের বিভাজন কেন? উৎসবে তো সবার আমন্ত্রণই কাম্য।

আমাদের এই পৃথিবী, এই প্রকৃতি এবং এই সমাজটাও এরকমই যে, আমরা যতই ধর্মের নামে গণ্ডি কেটে রাখার চেষ্টা করি, ‘আমার ধর্ম, তোমার ধর্ম' বলে বিভাজন রেখা টানি, কোথাও একটা অদৃশ্য বন্ধন আমাদের সবার মধ্যে থেকেই যায়, যাকে অগ্রাহ্য করার কোনও সাধ্য আমাদের কারও নেই৷

যে উৎসব সবরকম গ্লানি থেকে আমাদের মুক্তি দিয়ে থাকে, সাম্প্রদায়িক বিভাজন রেখা মুছে দেওয়ার ক্ষমতাও তার রয়েছে অবশ্যই৷ শুধু প্রয়োজন একটু সচেতন উদ্যোগের৷ এত দশকের এই ধর্মীয় ভেদবুদ্ধি রাতারাতি ঘুচে যাওয়ার নয়৷ সময় দিতে হবে অনেক৷ মানুষের মনকে, মানুষের চোখকে, মানুষের সহনশীলতাকে তৈরি হওয়ার মতো সময় দিতে হবে৷ মানুষকে নতুন করে বোঝাতে হবে–মানবতাই শ্রেষ্ঠ ধর্ম, বাকি সবই তাকে খণ্ড-খণ্ড করে আমাদের সামনে হাজির করা হয় মাত্র৷

ঈশ্বরে যাঁদের গভীর বিশ্বাস, তা তাঁরা যে ধর্মেরই মানুষ হোন না কেন, তাঁদেরও বুঝতে হবে সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে চলাটাই আসল মানবতা৷ ঈশ্বরে যিনি সত্যিই ভরসা করেন, তিনি সবাইকেই ডেকে আনবেন তাঁর পাশে, তাঁর উৎসবের অঙ্গনে৷ ‘এ আমার ঈশ্বর’ বলে তাঁকে ছোট করবেন না।

লেখক: কলামিস্ট

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
লখনউর কাছে হারলো চেন্নাই
লখনউর কাছে হারলো চেন্নাই
পশ্চিমবঙ্গে প্রথম দফার ভোট শেষেই বিজয় মিছিল
পশ্চিমবঙ্গে প্রথম দফার ভোট শেষেই বিজয় মিছিল
পোশাকশ্রমিককে ডেকে নিয়ে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ
পোশাকশ্রমিককে ডেকে নিয়ে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ