X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

‘পলিটিক্সে এরকম অজস্র হয়’

আমীন আল রশীদ
২১ অক্টোবর ২০১৮, ১৫:০৬আপডেট : ২১ অক্টোবর ২০১৮, ১৫:০৮

আমীন আল রশীদ নবঘোষিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ইস্যুতে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না এবং বিকল্পধারার ‘সদ্য বহিষ্কৃত’ যুগ্ম মহাসচিব মাহী বি. চৌধুরীর যে ফোনালাপ প্রকাশিত (কেউ কেউ বলছেন ফাঁস) হয়েছে, সেখানে মাহীর একটি কথার জবাবে মান্না বলেছেন, ‘পলিটিক্সে এরকম অজস্র হয়’।
পলিটিক্সে আসলেই এরকম অনেক কিছু হয়, যা অনেক সময় ধারণা করা যায় না। সে কারণেই বলা হয়, রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। যেমন মান্না-মাহীর এই ফোনালাপ ফাঁসের ৫ দিনের মাথায় বিকল্পধারা বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, মহাসচিব মেজর (অব.) আবদুল মান্নান এবং যুগ্ম মহাসচিব মাহী বি. চৌধুরীকে দল থেকে বাদ দিয়ে নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। ১৯ অক্টোবর সকালে জাতীয় প্রেসক্লাব চত্বরে সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেন ড. নুরুল আমিন ব্যাপারী। তিনি নিজেকে বিকল্পধারা বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করেন। তার সঙ্গে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে শাহ আহম্মেদ বাদলের নাম ঘোষণা করেন।
অর্থাৎ পলিটিক্সে এরকম অনেক কিছুই হয়। হয় বলেই কে কখন কার সঙ্গে জোটবদ্ধ হবে, আবার সুবিধামতো বেরিয়ে যাবে—তা সব সময় সরলরৈখিক নিয়মে চলে না। যে কারণে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও সামাজিক ন্যায়বিচারের পক্ষে কথা বলার পরও স্বৈরাচার ও যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে আঁতাতও পলিটিক্সের অংশ। একসময় বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত সহচরও বঙ্গবন্ধুর খুনিদের প্রশ্রয়দাতাদের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার। ফলে পলিটিক্সে এরকম অনেক কিছুই হয়।  

একাদশ জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বিভিন্ন দল-উপদল (যাদের নিবন্ধন নেই,তাদের উপদল বলছি) যে ঐক্য বা জোট করেছে, করছে এবং করবে—তাদের এই পুরো প্রক্রিয়াকে এককথায় ‘ঐক্যবাজি’ বলাই সঙ্গত। কারণ, রাজনীতি ও ভোটের মাঠে ঐক্যের নেপথ্যে যখন নীতি-আদর্শও আর বিবেচ্য থাকে না, যখন বিতর্কিত লোকেরাও ‘জাতির বৃহত্তর স্বার্থের’ কথা বলেন, তখন সেই ঐক্য প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক।

নতুন জোট গঠনের পরদিনই মান্না-মাহীর ফোনালাপ ফাঁসও আলোচনার জন্ম দিয়েছে। সব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরই ফোনকল রেকর্ড বা ট্র্যাক হয়। কিন্তু সবারটা ফাঁস হয় না। রাজনীতিবিদরা পরস্পরের সঙ্গে অনেক কথাই ফোনে বলেন। অনেক পরিকল্পনা করেন। তার সবকিছু সবার জানা সম্ভব হয় না। কিন্তু মাঝেমধ্যেই আমরা দেখি বিশেষ বিশেষ ফোনকল ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। এটি কতটা নৈতিক এবং এর আইনি ভিত্তি কতটুকু—তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। অনেক সময় নিজেদের ভেতর থেকেও এসব ফোনালাপ ফাঁস করে দেওয়া হয়। এখন সব স্মার্টফোনেই ভয়েস কল রেকর্ড হয়। সুতরাং যে দুজনের মধ্যে কথা হয়, তাদের একজন অন্যজনকে ছোট বা হেয় করা কিংবা নিজেকে হিরো বানানোর জন্যও কথোপকথন সোশ্যাল মিডিয়ায় ছেড়ে দিতে পারেন। আবার খুব সহজেই যে এসব কথোপকথন নিজের সুবিধামতো এডিট করা যায়—সে কথাও সবার জানা। সুতরাং এসব ফোনালাপ ফাঁস হয়তো এখন খুব বড় বিষয় নয়। কে কী বললেন তাও খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়। বরং কে কী লুকাচ্ছেন বা লুকালেন, সেটিই হচ্ছে ভয়ের।

এবার বিএনপি, ড. কামাল হোসেনের ঐক্য প্রক্রিয়া, মান্নার নাগরিক ঐক্য এবং আ স ম রবের জেএসডি মিলে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নামে নতুন যে জোটের ঘোষণা দিলেন, সেটি শুরু থেকেই কিছু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।

১. শুরু থেকে এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত হওয়ার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত বিকল্পধারা কেন বাদ পড়লো? শুধু কি জামায়াত ইস্যু নাকি তারা জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির কাছে দেড়শ’ আসন চেয়েছিল এবং তাতে বিএনপি রাজি হয়নি বলে এই প্রক্রিয়ায় তারা যুক্ত হয়নি? যদিও মাহমুদুর রহমান মান্নার সঙ্গে ফোনালাপে মাহী চৌধুরী যা বলেছেন তাতে মনে হয়, তারা (বিকল্পধারা) এই ঐক্য প্রক্রিয়াকে ‘চক্রান্ত’ হিসেবে দেখছেন। প্রশ্ন হলো, কী সেই চক্রান্ত? মাহী সুস্পষ্টভাবে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন এবং বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের নাম উল্লেখ করে বলেছেন, তারা সচেতনভাবেই এই প্রক্রিয়ায় বি. চৌধুরীকে বাদ দিয়েছেন। ফোনালাপে মাহী বি. চৌধুরী বলেছেন, ‘সকাল থেকে মইনুল হোসেন সাহেব কামাল হোসেন সাহেবকে সরিয়ে নিয়ে গেলেন ওনার বাসা থেকে এবং চিন্তাটা আগেই ছিল মওদুদ হোসেন সাহেবের যে বি. চৌধুরী এবং কামাল হোসেনকে একা বসতে দেওয়া যাবে না। এবং বি. চৌধুরী সাহেবকে সম্পূর্ণভাবে একটু অপমান করে দেওয়ার এই যে একটা পরিকল্পনা, এই একটা চক্রের মধ্য তো আপনারা পড়ে গেলেন, মান্না ভাই।’

২. বিকল্পধারার নতুন এই জোটে না থাকা এবং সভাপতি, মহাসচিব ও যুগ্ম মহাসচিবকে বাদ দিয়ে নতুন কমিটি ঘোষণার ফলাফল কী হবে? তারা এখন কি অন্য কারও সঙ্গে জোট করবেন নাকি বিকল্পধারা দুটি অংশই কার্যকর থাকবে? একই প্রতীকে দুটি দল নির্বাচনে অংশ নিতে পারে না। ফলে বিকল্পধারার প্রতীক আইনত কার থাকবে? আবার কোনও জোটের সঙ্গে না গিয়ে এককভাবে নির্বাচন করলে বি. চৌধুরী তার ব্যক্তিগত ইমেজে নিজের আসনের বাইরে আর কোনও আসনে তার দল কি জয়ী হবে বা ভোটের রাজনীতিতে সেই বাস্তবতা আছে? বিএনপির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং বিএনপি আমলের সাবেক রাষ্ট্রপতি কি আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ হবেন? রাজনীতিতে শেষ কথা বলে তো কিছু নেই।

৩. তিনটি দলের সঙ্গে বিএনপি জোটবদ্ধ হয়েছে। কিন্তু ২০ দলীয় জোটেরও নেতৃত্বে বিএনপি। এখন প্রশ্ন হলো, বিএনপি নেতৃত্বাধীন এই ২০ দলীয় জোটের কী হবে? আগামী নির্বাচনে এই জোটে থাকা বাকি দলগুলোর অবস্থান কী হবে? এরই মধ্যে দুটি দল জোট থেকে বেরিয়ে গেছে। যদিও তাদের কোনও ভোটব্যাংক নেই। তাদের জোটে থাকা না থাকায় বিএনপির খুব বেশি ক্ষতি হবে বলে মনে হয় না। আবার জামায়াতের নিবন্ধন না থাকলেও ২০ দলীয় জোটে বিএনপির প্রধান শরিক জামায়াত। এই দলটির বিষয়ে বিএনপি কখনও তাদের অবস্থান পরিষ্কার করে না। এবারও যখন ঐক্য প্রক্রিয়ার কথা শুরু হয়, তখনও জামায়াত ইস্যুটি সামনে আসে। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, বিএনপির ২০ দলীয় জোটে জামায়াত থাকা অবস্থায় জামায়াতবিরোধী বলে পরিচিত ড. কামাল, মান্না বা আ স ম রব কী করে বিএনপির সঙ্গে সংসার করবেন? নাকি নির্বাচনের আগে আরও অনেক খেলা হবে? মি. মান্না যেটি বলেছেন যে, রাজনীতিতে এরকম অনেক কিছুই হয়। অর্থাৎ আরও অনেক কিছু হবে...।

৪. নতুন এই ঐক্যফ্রন্টের ভবিষ্যৎ কী? বিএনপি ছাড়া নতুন এই জোটে যে তিনটি দল, তার মধ্যে একটি দলের (নাগরিক ঐক্য) নিবন্ধনই নেই। একটি দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদের ভেঙে যাওয়া অংশ। জাসদের সব অংশ একত্র করলেও কোনও বড় ভোটব্যাংক হয় না। সুতরাং একটি ছোট দলের খণ্ডিত অংশের বড় নেতার ব্যক্তিগত ইমেজ যাই থাকুক, ভোটের মাঠের হিসাব ভিন্ন। বাকি দলের (গণফোরাম) প্রধানও বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত সহচর এবং তার আমলের মন্ত্রী। সংবিধান প্রণয়ন কমিটির প্রধান এবং আইনজীবী হিসেবেও খ্যাতিমান। কিন্তু ভোটের মাঠে তার অবস্থান কী? কত শতাংশ মানুষ তার দলের সঙ্গে আছেন? সুতরাং এই জোটে বিএনপি ছাড়া আর কারোরই গণভিত্তি নেই। জনপ্রিয়তা নেই। ভোটব্যাংক নেই। তারা আওয়ামী লীগের মতো শক্তিশালী দলের বিপরীতে দাঁড়িয়ে শেষমেশ আসলে কী করবে বা করতে পারবে—তা দেখার জন্য আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।

৫. আগামী জাতীয় নির্বাচনে এরশাদ কী করবেন? ২০০৭ সালের বাতিল হওয়া সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটে যোগ দিয়েছিল তার দল জাতীয় পার্টি। বিএনপির বর্জনের মধ্যে ২০১৪ সালের নির্বাচনে আলাদাভাবে অংশ নিলেও পরে সরকারে যোগ দেয় জাতীয় পার্টি। এরপর গত বছরের ৭ মে মাসে মহাজোট থেকে বেরিয়ে ৫৮টি দল নিয়ে সম্মিলিত জাতীয় জোট নামে একটি নতুন জোটের ঘোষণা দেন তিনি। যদিও এই ৫৮টি দলের মধ্যে ৫৬টি দলেরই নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন নেই। আবার মহাজোট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিলেও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হিসেবে এরশাদ এখনও বহাল। আগামী নির্বাচনে তার দল ৩০০ আসনে প্রার্থী দেবে বলে এরশাদ একাধিকবার ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু তিনি যে শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সঙ্গেই থাকবেন, সে বিষয়ে সন্দেহ কম। বিশেষ করে এরশাদ যদি নিশ্চিত হন আগামী নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগই আবার সরকার গঠন করবে, তাহলে তিনি আওয়ামী লীগ ছেড়ে গিয়ে পুরনো মামলায় জেলে যাওয়ার ঝুঁকি নেবেন বলে মনে হয় না। কারণ, তার সাবেক স্ত্রী বিদিশা ‘শত্রুর সঙ্গে বসবাস’ বইতে (পৃষ্ঠা ১৫৮) লিখেছেন, ‘আমি যতদিন এরশাদকে কাছে থেকে দেখেছি মনে হয়েছে এই পৃথিবীতে জেলের চেয়ে বেশি ভয় সে আর কিছুকে পায় না।’

লেখক: সাংবাদিক

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘আ.লীগকে বর্জন করলেই অন্য পণ্য বর্জনের প্রয়োজন হয় না’
‘আ.লীগকে বর্জন করলেই অন্য পণ্য বর্জনের প্রয়োজন হয় না’
বিজিএপিএমইএ’র নির্বাচনের প্যানেল ঘোষণা, শাহরিয়ার নতুন প্যানেল নেতা
বিজিএপিএমইএ’র নির্বাচনের প্যানেল ঘোষণা, শাহরিয়ার নতুন প্যানেল নেতা
রাশিয়ার হামলায় ইউক্রেনের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত
রাশিয়ার হামলায় ইউক্রেনের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত
২৪ ঘণ্টার মধ্যে মেট্রোরেল লাইনের ওপর থেকে ক্যাবল সরানোর অনুরোধ
২৪ ঘণ্টার মধ্যে মেট্রোরেল লাইনের ওপর থেকে ক্যাবল সরানোর অনুরোধ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ