X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

শিক্ষাঙ্গনের বিচিত্র সব ‘ব্যাপার’

মো. সামসুল ইসলাম
২১ অক্টোবর ২০১৮, ১৭:২৫আপডেট : ২১ অক্টোবর ২০১৮, ১৭:২৬

মো. সামসুল ইসলাম বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড নিয়ে পত্রপত্রিকায় প্রতিনিয়ত যেসব খবর বের হয়, সেগুলো আমার কাছে রীতিমতো বিস্ময়কর মনে হয়। আমি জানি না, পৃথিবীর আর কোনও দেশে শিক্ষাঙ্গন সম্পর্কিত এত খবর প্রতিদিন মিডিয়ায় প্রকাশিত হয় কিনা। প্রশ্নফাঁস বলুন, শিক্ষার মান বা দুর্নীতিই বলুন, প্রাইমারি থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের বিচিত্র সব খবর আমাদের সত্যিই অবাক করে। মাঝেমাঝে তা বিনোদনেরও খোরাক জোগায়।
যেমন, পত্রিকা পড়েই জানলাম, গত ১৫ অক্টোবর নাকি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে নতুন এক পাঠদান পদ্ধতির নির্দেশনা দেশের সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ভাষাজ্ঞান বাড়ানোর জন্য প্রতিদিন বাংলা ও ইংরেজি বই থেকে একটি পৃষ্ঠা পঠনের জন্য বাড়ির কাজ দিতে হবে। একপৃষ্ঠা হাতের লেখা বাড়ি থেকে লিখে আনতে হবে। প্রতিদিন শিক্ষার্থীদের ন্যূনতম একটি বাংলা ও একটি ইংরেজি শব্দ পড়া, বলা ও লেখা শেখাতে হবে। এর ফলে নাকি শিক্ষার্থীদের ভাষার দক্ষতা বাড়বে এবং তারা বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় কথা বলতে ও লিখতে পারবে।
সত্যিই অবাক করা ব্যাপার! ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজে পড়াশোনা, চাকরি, শিক্ষা নিয়ে গবেষণার কারণে দেশে বিদেশের গোটা দশেক বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থান করেছি; কিন্তু এ রকম এক গণনির্দেশনা দিয়ে একসঙ্গে পুরো দেশের শিক্ষার্থীদের ভাষাজ্ঞান আদৌ বাড়ানো সম্ভব কিনা, তা আমি কখনও শুনিনি বা জানি না।

যতটুকু জানি ভাষা শেখানো একটি টেকনিক্যাল ব্যাপার। এর জন্য বিশেষ দক্ষতা প্রয়োজন। নিশ্চয়ই নির্দেশনায় বর্ণিত এ রকম পদ্ধতি পণ্ডিত ব্যক্তিরাই বাতলে দিয়েছেন। দেখা যাক এতে কী ফল হয়। তবে এটা তো নতুন নির্দেশনা। আগের নির্দেশনাগুলোর ফল তাদের মুখেই শোনা যাক।   

মাসখানেক আগে সেপ্টেম্বরেই এক কর্মশালায় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব জানান যে, বিভিন্ন জেলার ৫ম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ওপর চালানো তাদেরই এক জরিপে উঠে এসেছে যে, ২০ শতাংশ শিক্ষার্থী ইংরেজি ও বাংলায় নিজের নাম ও ঠিকানা লিখতে পারে না। আরও হতাশার ব্যাপার তিনি জানান, তা হলো শতভাগ শিক্ষার্থী ইংরেজিতে ‘ফরটি’ আর ‘ফরটিন’ এর পার্থক্য নির্ণয় করতে পারেনি।

সুতরাং একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে তো সবার জানার অধিকার আছে যে, বিভিন্ন শিক্ষক, বইপত্র, কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ ইত্যাদির মাধ্যমে আসলে শিশুদের এতদিন কী শেখানো হয়েছে? দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বা গবেষণা ছাড়া কিছুদিন পরপর এ রকম নির্দেশনা দিয়ে কি শিক্ষার্থীদের জ্ঞান বাড়ানো সম্ভব?

এ তো গেলো প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার কথা। এবার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে দৃষ্টি ফেরানো যাক। সম্প্রতি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ঘ’ ইউনিটের প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ উঠেছে, তখন পত্রিকা মারফত আমরা জানলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের  উপাচার্য বলেছেন, প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ উঠলেই ফল প্রকাশ কোনোভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ হয় না বরং এটি আরও বিশ্বস্ত হবে।
এ রকম এক পরিস্থিতিতে যখন দেশের হাজার হাজার ছেলেমেয়ের শিক্ষাগত ভবিষ্যৎ বিপন্ন, তখন উপাচার্যের এ ধরনের কথায় আপনি দুঃখের মধ্যেও হয়তো হাসবেন। জাতির না হলেও নিজের বিবেক-বুদ্ধিকেই হয়তো প্রশ্নবিদ্ধ করবেন।
বোধ করি, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এ সব বেহাল অবস্থার কারণে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু শিক্ষক গত ১৭ অক্টোবর ঢাকায় এক মতবিনিময় সভায় বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বায়ত্তশাসন ও সর্বজনীনতার সামান্য অংশটুকুও শেষ হতে যাচ্ছে। অনিয়ম-দুর্নীতিসহ নানা কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন মৃত্যুশয্যায়। 

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের একাংশ যখন একথা বলে, তখন তো আমাদের পরিস্থিতির ভায়াবহতা উপলব্ধি করতেই হবে। এতে অভিভাবকরা হন আরও শঙ্কিত। তাদের সন্তানরা আসলে কি পড়াশোনা করছে? তারা কি আদৌ চাকরি পাবে?
এটা ভাবার যথেষ্ট কারণও আছে। গত ১৭ অক্টোবরের পত্রিকাতেই জানলাম, গত বছর এই অক্টোবরেই নাকি যশোরের শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনিক্যাল পার্কে দিনব্যাপী এক জব ফেয়ার অনুষ্ঠিত হয়। দেশ-বিদেশের ৩০টি প্রতিষ্ঠান এতে যোগ দিয়েছিল এবং তাদের মূল ইচ্ছে ছিল অন্তত ১০ হাজার সফটওয়্যার কর্মী নিয়োগ দেওয়া।
গ্রাজুয়েট, মাস্টার্স মিলে প্রায় ৩৩ হাজার সেখানে আবেদন করেন। কিন্ত পরীক্ষানিরীক্ষা করে চাকরি দেওয়ার মতো মাত্র ১৭ জনকে নাকি পাওয়া যায়। যে ধরনের দক্ষতা থাকলে একটি সফটওয়্যার কোম্পানিতে চাকরি পাওয়া যেতে পারে, তা নাকি মাত্র এই ১৭ জনেরই ছিল!

এটি বহুল আলোচিত একটি চিত্র। পড়াশোনার সঙ্গে চাকরিকে সম্পর্কিত করা বা দক্ষ কর্মীর অভাবে বাংলাদেশে বিপুল সংখ্যক বিদেশিদের চাকরিপ্রাপ্তি নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে। আমি নিজেও বাংলা ট্রিবিউনসহ অন্যান্য পত্রিকায় লিখেছি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাই যখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিয়মনীতির ব্যত্যয় দেখে হতাশা ব্যক্ত করেন, সেখানে রাতারাতি এ অবস্থার উন্নয়ন তো অসম্ভব একটি ব্যাপার।

সহজ ভাষায় বলতে গেলে, প্রতিটি দেশে শিক্ষার একটি দর্শন থাকতে হবে। শিক্ষার উদ্দেশ্য যদি হয় নৈতিক জ্ঞান সম্পন্ন দক্ষ মানব সম্পদ সৃষ্টি, তাহলে শিক্ষাব্যবস্থাকে আধুনিকীকরণ করতে হবে। আর এ কাজটি পারবেন শুধু শিক্ষা ও গবেষণায় নিয়োজিত শিক্ষকরা। কিন্তু শিক্ষার উদ্দেশ্য যদি হয় শুধু ডিগ্রি বিতরণ, তাহলে তো কিছু বলার নেই। অথচ বছরের পর বছর ধরে এরকমই হয়ে আসছে।

এরই মধ্যে আগামী মাসেই দেশে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির পিইসি ও জেএসসি পরীক্ষা। এই দুই পাবলিক পরীক্ষার প্রয়োজনীয়তা বা এগুলো ঘিরে নোট, গাইড, কোচিং সেন্টার আর স্কুলগুলোর কোচিং ব্যবসা নিয়ে তো কম বিতর্ক হয়নি। আমি নতুন করে আর এই পুরনো বিতর্ক টেনে আনতে চাইছি না। আমি শুধু একটি ভিন্ন বিষয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই।

পিইসি বা জেএসসি পরীক্ষা অন্যসব পাবলিক পরীক্ষার মতোই ভিন্ন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হয়। এসএসসি বা এইচএসসি পরীক্ষার মতো ছাত্রছাত্রীদের বাসার কাছে নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রেখে অপেক্ষাকৃত দূরে অন্য স্কুলে গিয়ে পরীক্ষা দিতে হয়। পিইসি পরীক্ষার্থীদের বয়স হবে গড়ে ১০ বছর, আর জেএসসি পরীক্ষার্থীদের গড়ে ১৩ বছর। আমি আমার আশেপাশে দেখি এই পরীক্ষা নিয়ে শিক্ষার্থী আর অভিভাবকদের মধ্যে মহাআতঙ্ক কাজ করে।

আর এ আতঙ্ক বিভিন্ন কারণে। অনেক পরিবারে বাবা-মা দুজনেই চাকরিজীবী। আবার সিঙ্গেল প্যারেন্ট ফ্যামিলি কম নয়। চাকরি বাদ দিয়ে সন্তানদের সেখানে নিয়ে অপেক্ষা করে আবার নিয়ে আসতে হয়। তারা কি এতদিন ছুটি পান? ঢাকাসহ বড় শহরে শিশুদের হারিয়ে যাওয়াসহ বিভিন্ন দুর্ঘটনার আশঙ্কা আছে। নিজের স্কুল বাদ দিয়ে হঠাৎ করে হাজার হাজার শিশুকে একত্রিত করে সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশে পরীক্ষা নেওয়ার এ পদ্ধতি মেনে নেওয়া অভিভাবকদের জন্য কঠিন ব্যাপার। নীতি-নির্ধারকরা কি এসব চিন্তা করেন? 

পুরো পৃথিবীতে শিক্ষা ব্যবস্থা কিন্তু দ্রুত পরিবর্তনশীল। জ্ঞান-বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় বিভিন্ন পরিবর্তন আর উদ্ভাবনী চিন্তাভাবনা অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে। যেমন আমাদের দেশে নকল বা প্রশ্নফাঁসের ব্যাপ্তির এক বড় কারণ ইন্টারনেট, মোবাইলসহ নিত্য নতুন ডিভাইস আর যোগাযোগ প্রযুক্তির বিস্তার। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা, নতুন কারিক্যুলাম প্রণয়ন বা শিক্ষাকে চাকরির সঙ্গে সম্পর্কিত করা ইত্যাদির জন্য দরকার সৎ, অরাজনৈতিক, উদ্যমী আর মেধাবী শিক্ষা প্রশাসক।

আমাদের দেশে প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় সব পর্যায়ে এখনও এরকম অনেক শিক্ষক আছেন। কিন্তু ক্ষমতার ভরকেন্দ্র থেকে দূরে থাকায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তারা কোনও অবদান রাখতে পারেন না। যতদিন না তাদের বক্তব্য প্রাধান্য পাবে, ততদিন আমরা শিক্ষাঙ্গনে এরকম বিচিত্র ব্যাপারস্যাপার অবলোকন করতে থাকব।

লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট
ইমেইল: [email protected]

/এসএএস/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
কান উৎসব ২০২৪জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ