X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গা সমস্যা: চীনের হাতে সমাধানের চাবি

আনিস আলমগীর
২৩ অক্টোবর ২০১৮, ১৫:০৫আপডেট : ২৩ অক্টোবর ২০১৮, ১৫:০৬

আনিস আলমগীর চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রোহিঙ্গা সমস্যাটাকে আন্তর্জাতিক পরিসরে না টানার কথা বলেছে। অথচ সমস্যাটা ঝুলে আছে দীর্ঘদিন ধরে। আবার চীনের মতো বৃহৎ শক্তিশালী দেশ ইচ্ছা করলে বাংলাদেশ আর মিয়ানমারের মাঝে সমঝোতা স্থাপনের উদ্যোগ নিতে পারতো কিন্তু তা থেকেও তারা বিরত আছে। বরং কিছুদিন আগে চীনের পররাষ্ট্র দফতর বলেছে, রোহিঙ্গা বিষয়টা জাতিতাত্ত্বিক ব্যাপার। সুতরাং তারা এই দুরূহ বিষয়ে মাথা দেবে না।
নিজেও কোনও সমাধানের উদ্যোগ নেবে না আবার তৃতীয় পক্ষের উদ্যোগকে হতাশাব্যঞ্জক কথা বলে নিরুৎসাহিত করবে–তা তো সমাধানের পথে বৃহৎ একটা দেশের বাধাদানেরই শামিল। চীন-রাশিয়া নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো প্রয়োগ না করলে সমস্যাটার সমাধান বহুদিন আগেই হয়ে যেতো। কিন্তু চীন-রাশিয়া ভেটো প্রয়োগ করে মিয়ানমারকে সহায়তা প্রদানের কারণে বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের সম্পাদিত চুক্তিও কার্যকর হচ্ছে না।
কথা দিয়ে কথা না রাখা, চুক্তি করে চুক্তি কার্যকর না করা, কোনও বিষয়ে ‘হ্যাঁ’ ‘না’ কিছু না বলে দিনের পর দিন নীরবে বসে থাকা মিয়ানমারের দীর্ঘদিনের বদঅভ্যাস। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সদস্য হওয়ার পরও কথা শোনার কোনও বাধ্যবাধকতা আছে বলে মিয়ানমার সরকার মনে করে না। নির্বাচিত একটা সরকার অং সান সু চি’র নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হলেও এখনও পরিপূর্ণ ক্ষমতা সামরিক বাহিনীর হাতে। অং সান সু চি মেরুদণ্ডহীন। গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলনের সময় তাকে যা মনে করা হয়েছিল আসলে তিনি তা নন। আধুনিক চিন্তার কোনও রাজনীতিবিদ নন। সু চি পরিপূর্ণভাবে সাম্প্রদায়িক।

বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের সম্পূর্ণ প্রভাবাধীন এবং বৌদ্ধ ধর্মীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সন্ন্যাসীদের প্রচেষ্টার একান্ত সহযোগী তিনি। মিয়ানমারে এক লাখ মঠ রয়েছে, ৭/৮ লাখ সন্ন্যাসী আছে। মঠ আর সন্ন্যাসীদের বিরাট এক অবস্থান রয়েছে মিয়ানমারের সমাজে। তারা অং সাং সু চি’র বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠার পূর্বে সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে বহু আন্দোলন সংগ্রামে জড়িত ছিল। এমনকি গায়ে আগুন দিয়ে তারা আত্মাহুতিও দিয়েছিল।

সন্ন্যাসীরা মিয়ানমার সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। তারা সমাজের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত এবং সমাজের ওপর তাদের যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। রোহিঙ্গা বিতাড়নে সম্পূর্ণ উসকানি ছিল সন্ন্যাসীদের। গত ২৩ অক্টোবর নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় মিয়ানমারের ওপর একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, দুই বছর আগে সু চি যখন ক্ষমতায় আসেন তখন বিশ্বের অধিকাংশ মানুষই আশাবাদী হয়ে উঠেছিল। কিন্তু এখন অনেক কিছু বদলে গেছে। একসময়ে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক সু চি এখন পরিচিত হয়েছে জাতিগত নিধনযজ্ঞের হোতা হিসেবে। কানাডা তাকে সম্মানসূচক নাগরিকত্ব প্রদান করেছিল। রোহিঙ্গাদের বিষয়ে তার প্রকৃত পরিচয় বের হয়ে আসার পর কানাডা সরকার তার নাগরিকত্ব বাতিল করে দিয়েছে। নোবেল প্রাইজ কমিটিও তার কর্মকাণ্ডের নিন্দা করেছে এবং বলেছে নোবেল প্রাইজ ফেরত নেওয়ার রেওয়াজ নেই। সুতরাং সু চি’র নোবেল প্রাইজ ফেরত নেওয়া হবে না।

চীন মিয়ানমারের আকিয়াব উপকূলে বাণিজ্য ঘাঁটি স্থাপন করছে এবং বন্দর স্থাপন ও পাইপ লাইন বসানোর সব ব্যবস্থা সম্পন্ন করার কাজ এগিয়ে নিচ্ছে। এই বিষয়ে মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে তার চুক্তি সম্পাদনের কাজও শেষ করেছে। রোহিঙ্গারা যেসব এলাকায় থাকতো সেসব এলাকায় নাকি এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন স্থাপনের জন্য কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘেরাও করে রেখেছে। আর তার স্বার্থকে প্রোটেক্ট করার জন্য নিরাপত্তা পরিষদে বারবার ভেটো প্রদান করে মিয়ানমারকে সন্তুষ্ট রাখতে এবং মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসকে সমর্থন করছে। আবার বাংলাদেশকে রোহিঙ্গা বিষয়টি আন্তর্জাতিকীকরণ না করার পরামার্শ দিচ্ছে।

জাতিসংঘ, আমেরিকা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন রোহিঙ্গা বিতাড়নের সময় যে হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছে তাকে গণহত্যা বলে অভিহিত করছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন মিয়ানমানের ওপর বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জাতিসংঘের বর্তমান সেক্রেটারি জেনারেল পূর্বে উদ্বাস্তু বিষয়ক হাইকমিশনার ছিলেন। তখন থেকেই তিনি রোহিঙ্গা সম্পর্কে অবগত আছেন এবং রোহিঙ্গা বিষয়ে আকিয়াব সফর করে সবকিছু প্রত্যক্ষ করেছেন। তিনি বারবার বলেছেন মিয়ানমার সরকারের রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আচরণ পূর্ব থেকেই অমানবিক ছিল। তিনি এটাকে গণহত্যা বলতে দ্বিধা করেননি এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নও এটাকে গণহত্যা বলেছে খুবই সোচ্চার কণ্ঠে।

সুতরাং মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর যারা রোহিঙ্গা গণহত্যায় জড়িত ছিলেন তাদের বিচারের সম্মুখীন হওয়া স্বাভাবিক। শুধু চীন-রাশিয়ার নিরাপত্তা পরিষদে ভেটোর কারণে তা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ভারতের ভেটো পাওয়ার না থাকায় তার সমর্থনটা প্রকাশ্যে প্রত্যক্ষ করা না গেলেও কর্মকাণ্ডে তারাও রোহিঙ্গাদের সঙ্গে মিয়ানমারের অনুরূপ আচরণ করছে। যেসব রোহিঙ্গা ভারতে অনুপ্রবেশ করেছে তাদের মিয়ানমারের হাতে তুলে দিচ্ছে। বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ তেলেঙ্গানার এক জনসভায় তা প্রকাশ্যে ঘোষণাও দিয়েছেন।

জাতিসংঘ রোহিঙ্গা নির্যাতনের বিষয়ে যে তদন্ত দল গঠন করেছিল, তারা একটা প্রতিবেদন এরই মাঝে জাতিসংঘে পেশ করেছেন। আমেরিকাসহ ৯টি দেশ এ প্রতিবেদন শুনানির জন্য নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক ডাকার আবেদন জানিয়েছেন। তদন্ত দল তাদের প্রতিবেদনে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে নির্যাতন চালানোর জন্য দায়ী করেছেন। এই প্রতিবেদনে রোহিঙ্গা বিষয়টি নেদারল্যান্ডের হেগের আন্তর্জাতিক আদালতে তুলতে বা অ্যাডহক ভিত্তিতে পৃথক ট্রাইব্যুনাল গঠনের জন্য নিরাপত্তা পরিষদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। এই তদন্ত দল সুস্পষ্টভাবে বলেছে যে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা নির্যাতনের জন্য মিয়ানমারের সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইংসহ ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তারা দায়ী। সত্যানুসন্ধানী দলের প্রধানের ব্রিফিংয়ের জন্য নিরাপত্তা পরিষদের মিটিং ডাকতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্সহ নিরাপত্তা পরিষদের নয় সদস্য রাষ্ট্র পরিষদের বর্তমান সভাপতি বলিভিয়াকে চিঠি দিয়ে অনুরোধ জানিয়েছে।

বর্তমানে কক্সবাজার জেলার শুধু টেকনাফ-উখিয়া উপজেলায় প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে। সামান্য এলাকাজুড়ে এতো লোকের বসবাস দম বন্ধ হওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশের মতো একটা উঠতি অর্থনীতির দেশের জন্য এ বোঝা অসামান্য। বাংলাদেশ সরকার ২৫ হাজার পরিবারকে হাতিয়ার ভাসানচরে অস্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য পাঠাতে চায় এবং তাদের জন্য অবকাঠামোও তৈরি করেছে। কিন্তু রোহিঙ্গারা ভাসানচরে যেতে ইচ্ছুক নয়। তারা বর্তমান অবস্থান থেকে সরাসরি রাখাইনে ফিরে যেতে ইচ্ছুক। তবে তারা বলছে নাগরিকত্ব ছাড়া তারা যাবে না। নাগরিকত্ব ছাড়া তাদের যেতে বাধ্য করা হলে তারা বিষপানে আত্মহত্যা করবে।

বাংলাদেশ চুক্তি অনুযায়ী ১৬৭০টি পরিবারের ৮ হাজার ২ জন রোহিঙ্গার নাম পাঠিয়েছিল। গত ৮ মাসব্যাপী যাচাই বাচাই করার পর বর্তমান মিয়ানমার এই ৮ হাজার রোহিঙ্গাকে ফেরত নিতে সম্মত হয়েছে। আগামী ২৮ অক্টোবর বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের প্রতিনিধি দলের এ বিষয়ে চূড়ান্ত বৈঠক ঢাকায় অনুষ্ঠিত হবে। বৈঠকের পর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হবে বলে সংশ্লিষ্টরা আশা করে। ঢাকা বৈঠকের পর মিয়ানমারের প্রতিনিধিরা নাকি রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শনে যাবেন। মিয়ানমার প্রতিনিধির রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শনে যাওয়ার সিদ্ধান্তটি খুবই ভালো। আতঙ্কগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের ভয় ভাঙাতে তাদের ঘন ঘন ক্যাম্প পরিদর্শন জরুরি।

ভারত রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের জন্য ২৫০টি বাড়ি নির্মাণ করছে আর চীন রাখাইনে বাড়ি তৈরি করেছে ৪ হাজার। মিয়ানমার প্রত্যাবাসন শুরু হলে অস্থায়ীভাবে থাকার জন্য সীমান্তে বড় বড় শেড তৈরি করছে ২টি। সবই ভালো লক্ষণ। কিন্তু প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বছরের পর বছর বিলম্বিত হলে আঞ্চলিক নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে পড়বে। উখিয়া-টেকনাফ ক্যাম্প-এ ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সের যুবক আছে লক্ষাধিক। তারা এখন চঞ্চল হয়ে উঠছে। সঠিক নেতৃত্ব পেলে তারা অঘটন ঘটাতে প্রস্তুত হবে। তখন আঞ্চলিক নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। সুতরাং এখন চীনের উচিত মিয়ানমারকে বিষয়টি দ্রুত নিষ্পত্তিতে উৎসাহিত করা। রাখাইনে চীন ১৫/২০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। তার পুঁজির নিরাপত্তার জন্যও এটা প্রয়োজন। ভারত ৭ জন রোহিঙ্গাকে রাখাইন প্রাদেশিক সরকারকে ফেরত দিয়েছিল। মিয়ানমার সরকার তাদের যত্নসহকারে তাদের ভিটেমাটিতে পুনর্বাসন করেছে। এটা ভালো লক্ষণ।

চীন নিজে উদ্যোগী হয়ে উদ্বাস্তু ফেরত নেওয়ার বিষয়টি দ্রুত সম্পন্ন করতে অপারগ হলে হয়তো মিয়ানমারের সেনাবাহিনী আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের সম্মুখীন হবে। চীন তার ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড ইনিশিয়েটিভ কার্যকর করতে গেলে অনুরূপ বহু বাধার সম্মুখীন হবে। নিজেরা উদ্যোগী হয়ে এসব সমস্যার সমাধান না করলে তো ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড ইনিশিয়েটিভের অগ্রগতি স্থবিরতার সম্মুখীন হবে।

আমেরিকায় চীনের বাণিজ্য প্রবল বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড ইনিশিয়েটিভ দ্রুত সম্পন্ন করে সংশ্লিষ্ট ৬১টি দেশে চীনা বাণিজ্য সম্প্রসারণ করা ছাড়া চীনের শেষ পর্যন্ত বিকল্প কোনও ব্যবস্থা নেই। সুতরাং চীনের এখন থেকেই নিষ্ক্রিয়তা ছেড়ে রোহিঙ্গাসহ সব সমস্যা সমাধানে তৎপর হওয়া উচিত।

লেখক: সাংবাদিক ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক

[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
প্রথম ধাপে ভোটের হার ৬০ শতাংশ, সর্বোচ্চ পশ্চিমবঙ্গে
লোকসভা নির্বাচনপ্রথম ধাপে ভোটের হার ৬০ শতাংশ, সর্বোচ্চ পশ্চিমবঙ্গে
ইসরায়েলি বিমান কীভাবে এল বাংলাদেশে, প্রশ্ন নুরের
ইসরায়েলি বিমান কীভাবে এল বাংলাদেশে, প্রশ্ন নুরের
মিয়ানমারের ২৮৫ জন সেনা ফেরত যাবে, ফিরবে ১৫০ জন বাংলাদেশি
মিয়ানমারের ২৮৫ জন সেনা ফেরত যাবে, ফিরবে ১৫০ জন বাংলাদেশি
১৬ বছর ধরে পুনরুদ্ধার করা ‘নেপোলিয়ন’ দেখাবে কান
কান উৎসব ২০২৪১৬ বছর ধরে পুনরুদ্ধার করা ‘নেপোলিয়ন’ দেখাবে কান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ