X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

কূটনৈতিক রাজনীতি দিয়ে ঐক্যফ্রন্টের যাত্রা

মোস্তফা হোসেইন
২৩ অক্টোবর ২০১৮, ১৬:২৬আপডেট : ২৩ অক্টোবর ২০১৮, ১৬:৩৫

মোস্তফা হোসেইন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম নেতা মইনুল হোসেনকে নিয়ে যখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তোলপাড় চলছে, তখন ঐক্যফ্রন্টের নেতারা অভিজাত এলাকার একটি হোটেলে বিদেশিদের শোনাচ্ছিলেন তাদের দাবি-দাওয়ার কথা। অবশ্য বৈঠকের পর মির্জা ফখরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেছেন, আমরা কূটনীতিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছি, এর বেশি কিছু বলা যাবে না। তো গোপন কথাটি যে কী হতে পারে তা সাধারণ মানুষের বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়। কারণ, ক্ষমতা পাওয়ার জন্য বিদেশমুখী হওয়ার বিষয়টি তো তাদের নিত্য ঘটনার মতোই।
২০১৪ সালের নির্বাচনের আগেও তারা ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিকদের সহযোগিতা চেয়েছেন। গত পাঁচ বছরে জনগণের কাছে যাওয়াটাকে গুরুত্ব না দিলেও বিদেশিদের দ্বারস্থ হতে কুণ্ঠাবোধ করেননি তারা। গত ২ অক্টোবরও তারা ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত রেনজি তিরিংকের সঙ্গে বৈঠক করেছেন গুলশান কার্যালয়ে। সেখানে তারা আগামী নির্বাচন নিয়ে কথা বলেছেন। কথা বলেছেন একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার বিষয়েও।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উপ-সহকারী ও জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের জ্যেষ্ঠ পরিচালক লিসা কার্টিসের সঙ্গেও ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বাসায় গিয়ে বৈঠক করেন। ওই বৈঠকেও তাদের একই এজেন্ডা ছিল। এটাও মার্চ মাসের ঘটনা।

৪ সেপ্টেম্বরও তারা বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হয়েছে। এর আগে ৭ আগস্টও তারা বৈঠক করেছে কূটনীতিকদের সঙ্গে।

জুন মাসে তারা তাদের চিরবৈরী ভারতের সহযোগিতা চাইতে গিয়েছিলেন দিল্লিতে। বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমদু চৌধুরী, হুমায়ূন কবীর ও আব্দুল আওয়াল মিন্টু দিল্লি থেকে ফিরে মুখ খুলতে না চাইলেও মানুষ বুঝতে পেরেছে কী কারণ ছিল তাদের ভারত সফরের। এর পরপরই ভারতের কাছ থেকেই জবাবও পাওয়া যায়, স্বল্পসময়ের ব্যবধানে। ভারত বলে দিয়েছে বিএনপিকে ক্ষমতায় আনার জন্য তারা কিছু করতে পারবে না।

আওয়ামী লীগ ভারতের সহযোগিতায় ক্ষমতায় এসেছে এই দুর্নাম দেওয়ার পর তারা যখন ভারতের সহযোগিতা চায়, তখন সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন আসে, তারা কি মনে করেন যে বাংলাদেশের নির্বাচনটা ভারত সরকার করে দেয়?

ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য ভারতের সহযোগিতা চাওয়ার এই নেতিবাচক আবদারের সমালোচনা শেষ না হতে হতেই মির্জা ফখরুল ইসলাম গেলেন জাতিসংঘে। প্রচার করা হলো তিনি জাতিসংঘের মহাসচিবের আমন্ত্রণে সেখানে যাচ্ছেন। সেখানেও লুকোচুরি খেলা দেখা গেলো। নিউ ইয়র্ক পৌঁছানোর পর সাংবাদিকরা যখন তাকে জিজ্ঞেস করেন, তিনি নিউ ইয়র্ক এসেছেন কেন? জবাব দিয়েছিলেন, তিনি তার কাজে এসেছেন। এদিকে দেশে মওদুদ আহমদ বললেন, আগামী নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু হয় এবং নির্দলীয় সরকারের অধীনে যাতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, সেই জন্য জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ চাইতেই তার জাতিসংঘে গমন। কিন্তু বিধি বাম, পরে জানা গেলো, জাতিসংঘের মহাসচিব কেন জাতিসংঘের কেউই তাদের আহ্বান জানাননি। এমন অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের বিএনপি নেতাকর্মীরাও ক্ষেপে যায়। তাদের কথা, মির্জা ফখরুল ইসলাম ঢাকা থেকে নিউ ইয়র্ক গিয়ে যে কাজটি করেছেন সেটা করা তাদের জন্য ওয়ান-টু’র ব্যাপার মাত্র।

কিন্তু ততক্ষণে জানাজানি হয়ে যায় এটা পুরোপুরিই ভুয়া একটি বিষয়। যেমনই ভারতীয় জনতা পার্টির সাধারণ সম্পাদক বেগম খালেদা জিয়াকে ফোন করেছিলেন বলে প্রচার করা হয়েছিল, সেটিও যেমন মিথ্যা বলে প্রমাণ হয়েছিল, এটাও তাই প্রমাণ হলো।

হয়তো মিথ্যাচার থেকে রক্ষার জন্যই মির্জা ফখরুল ইসলামও বৃহস্পতিবার বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে কী আলোচনা হয়েছে, তা লুকিয়ে রেখেছেন।

নির্বাচন ও ক্ষমতার প্রশ্নে এত বেশি বিদেশবিমুখিতার কারণে মানুষ প্রশ্ন করতেই পারে– তাহলে কি জনগণের ওপর তাদের কোনও আস্থা নেই?

যুক্তরাষ্ট্রের সাময়িকী পলিটিকোতে সংবাদ হয়েছে বিএনপির পক্ষ থেকে সেদেশে লবিস্ট নিয়োগ করেছে। যাতে করে ট্রাম্প প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে নির্বাচনে কিছু একটা করা যায়। জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে দেখা করে সহানুভূতি আদায়ের জন্যও বিএনপি লবিস্ট নিয়োগ করেছিল বলে সংবাদে প্রকাশ হয়েছে। আমছালা দুই-ই গিয়েছে সেই মিশনে। লবিস্ট কিছু টাকা হাতিয়ে নিলেও জাতিসংঘের মহাসচিবের দেখা পায়নি বিএনপি নেতা।

নয়াপল্টনে টেলিভিশনের সামনে বসে পাঁচ বছর কাটিয়ে দিলেন বিএনপি নেতারা। জনগণকে পাওয়ার জন্য তাদের কখনও জনগণের কাছে যেতে দেখা যায়নি। তো শেষ পর্যন্ত গেলেন ড. কামাল হোসেন ও আ স ম আব্দুর রবের কাছে। ঢাকঢোল পিটিয়ে মহানগর নাট্যমে  তাদের জমায়েত করা হলো। একপর্যায়ে নানা নাটকীয়তার পর গঠিত হলো জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। কিন্তু এরমধ্যে দেখা দিল ফাটল। সেই ফাটলকে জোড়া লাগানোর চেষ্টায় ব্যর্থ হলেন তারা।

এমন তিনটি দলকে তারা সহযোগী হিসেবে গ্রহণ করলো যাদের কোনও সাংগঠনিক ভিত্তি নেই বললেই চলে। এক নেতাকেন্দ্রিক এই দলগুলো মাধ্যমে যে তাদের পক্ষে জনগণের কাছে যাওয়া সম্ভব হবে না তারা বুঝতে পেরে বিদেশিদের দ্বারস্থ হলেন। যাতে বিদেশিরা ক্ষমতায় যাওয়ার পথটা করে দিতে পারে। তারা যে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য জনগণের সমর্থন পাবে না কিংবা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য জনগণের প্রয়োজন বোধ করে না তেমনি মনে হলো এই কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকটি।

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতারা যুক্তভাবে কর্মসূচি দেওয়ার কথা ছিল ১ অক্টোবর থেকে। ১৮ দিন অতিবাহিত হওয়ার প্রথম কর্মসূচি হিসেবে তারা তাদের দেখা গেলো বিদেশিদের সাহায্য প্রার্থনার বিষয়টি।

কিন্তু বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন বিষয়ে বিদেশিদের মতামত এতদিনে স্পষ্ট হয়ে গেছে। ভারতের হাইকমিশনার একাধিকবার বলেছেন বাংলাদেশের নির্বাচনে তাদের কিছু করণীয় নেই। তারা চান সবার অংশগ্রহণে সুন্দর ও সুষ্ঠু একটি নির্বাচন হোক। গত সপ্তাহেই আমেরিকার রাষ্ট্রদূত বার্নিকাট আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে দেখা করে তাদের মতামত তুলে ধরেছেন। তিনিও বলেছেন, বাংলাদেশের নির্বাচন সুষ্ঠু, সুন্দর এবং সবার অংশগ্রহণমূলক হোক এটা তাদের প্রত্যাশা। তবে বিএনপির পিলে চমকে যাওয়ার মতো আরেকটি কথাও তিনি সেদিন বলে ফেলেছেন। তার কথা–দুয়েকজন নেতাকর্মী যদি নির্বাচনে অংশ না নেন তাহলে নির্বাচন অশুদ্ধ হবে না। কিংবা নির্বাচনেও এতে বাধা আসবে না। তার মানে ধরেই নেওয়া যায়, বেগম খালেদা জিয়া যদি কারাগার থেকে বের না হতে পারেন কিংবা কোনও কারণে যদি তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে না পারেন তাতেও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।

সবশেষে ঐক্যজোটের কর্মসূচিতে যা দেখা গেলো সেটাও বিএনপি’র কর্মসূচিরই ধারাবাহিকতা। বিএনপি যেমন জনগণের পরিবর্তে বিদেশমুখী নীতি গ্রহণ করে চলেছে। ঐক্যজোটও তা-ই করছে। ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারও চলছে, বিএনপি আসলে বিদেশ বিশেষজ্ঞা ড. কামালকে সঙ্গে নিয়েছে তাদের অসমাপ্ত কাজটি সুসম্পন্ন করার মানসে। ড. কামাল হোসেন ও কূটনীতিকদের সঙ্গের বৈঠক নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের একটি বিশ্লেষণ স্মরণীয়। একজন লিখেছেন, অঘোষিত যুক্তফ্রন্ট নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না কয়েকদিন আগে বলেছেন, ড. কামাল হোসেন যেন আন্দোলন রেখে হুট করে বিদেশ যাওয়া বন্ধ করেন। ড. কামাল সেই কথাটিই রেখেছেন, কিন্তু বিদেশ বিদেশ করতে অভ্যস্ত মানুষটি তো আর বিদেশিদের বাদ দিতে পারেন না। তাই বিদেশিদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছেন বাংলাদেশের নির্বাচন বিষয়ে শলাপরামর্শ করতে।

আগামী মাসে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা। যতদূর জানা যায় আগামী বিজয় দিবসের পরপরই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সেক্ষেত্রে এই মুহূর্তে প্রার্থীদের ঘুম হারাম হয়ে যাওয়ার কথা। তাদের গ্রামে গ্রামে চষে বেড়ানোর কথা ভোট চাওয়ার কাজে। কিন্তু নেতারা নিজেরা টেলিভিশনে দুই স্লিপ পড়ে শোনানোটাকেই বড় প্রয়োজনীয় মনে করছেন। এরপরও যাতে বিদেশিরা তাদের সহযোগিতা করে সেই আলোকেই জাতীয় ঐক্য ফ্রন্টের প্রথম কর্মসূচি অভিজাত হোটেল থেকে শুরু হলো। প্রশ্ন হচ্ছে তারা জনগণের কাছে যাবে কখন? বিদেশমুখী রাজনীতি আখেরে কী ফল বয়ে আনবে তাই দেখার বিষয়।

 লেখক: সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বিএসএমএমইউ’র দায়িত্ব নিয়ে যা বললেন নতুন ভিসি
বিএসএমএমইউ’র দায়িত্ব নিয়ে যা বললেন নতুন ভিসি
বাজেটে শিক্ষা খাতে ১৫ শতাংশ বরাদ্দের দাবি
বাজেটে শিক্ষা খাতে ১৫ শতাংশ বরাদ্দের দাবি
ডিএনসিসির কাওরান বাজার আঞ্চলিক অফিস যাচ্ছে মোহাম্মদপুরে
ডিএনসিসির কাওরান বাজার আঞ্চলিক অফিস যাচ্ছে মোহাম্মদপুরে
ভাতা বাড়ানোর আশ্বাসে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের কর্মবিরতি প্রত্যাহার
ভাতা বাড়ানোর আশ্বাসে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের কর্মবিরতি প্রত্যাহার
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ