X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

আমার কী লাভ?

হারুন উর রশীদ
২৭ অক্টোবর ২০১৮, ১৬:০৩আপডেট : ২৭ অক্টোবর ২০১৮, ১৬:২৩

হারুন উর রশীদ ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি নিজেই সংসদে বলেছেন, ‘এটা গণতন্ত্রের জন্য উপকারী’। তারপরও এই ফ্রন্টের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ ও সমমনা দলগুলো বিষোদগার করে যাচ্ছে। আর কিছু কলাম লেখক ও সুশীল ঐক্যফ্রন্টের বিরুদ্ধে আদাজল খেয়ে লেগেছেন। তারা যেন এই ফ্রন্টকে ঘরে তুলে না দিয়ে লেখা থামাবেন না।
যে যার অভিমত দিতেই পারেন। কারণ বাক-স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ তো সংবিধানবিরোধী। কিন্তু যারা আওয়ামী লীগের চেয়ে বড় ‘আওয়ামী লীগার’, শেখ হাসিনার চেয়ে তারা বড় বঙ্গবন্ধুপ্রেমী হতে চান, তাদের ‘এই মায়ের চেয়ে মাসির দরদ’ উদ্দেশ্যহীন বলে আমার কাছে মনে হয় না। সেই উদ্দেশ্য কী হতে পারে, তারাই ভালো বলতে পারবেন। তবে সাধারণ বিবেচনায় কিছুটা আঁচ করা যায়। গায়েপড়ে যেচে গিয়ে আওয়ামী লীগের ‘উপকার’ যারা করছেন, তাদের উদ্দেশ্যে একটাই কথা আমার–আওয়ামী লীগ কি এতটাই দুর্বল যে, আপনাদের উপকার ছাড়া তারা চলতে পারে না? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও মাঝেমধ্যে দেখেছি সংবাদ সম্মেলনে এই ‘উপকারীদের’ প্রশ্নের ধারা বর্ণনার মাঝে থামিয়ে দিয়ে আসল প্রশ্ন করতে বলেন।
যারা ঐক্যফ্রন্টের সমালোচনা করেন, তারা দুই ধারায় করেন। ১. পুরো ফ্রন্টের সমালোচনা করেন এবং ২. ড. কামাল হোসেনকে ব্যক্তিগতভাবে তুলোধুনো করেন। এই দুই ধারায় সমালোচনাকারীদের কথার মূল সুর একই রকম।

ক) ড. কামাল হোসেন ষড়ন্ত্রকারীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন।

খ) ড. কামাল হোসেন স্বাধীনতাবিরোধীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন।

গ) ড. কামাল হোসেন জামায়াতের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন।

ঘ) ড. কামাল হোসেন একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলাকারীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন।

ঙ) এক/এগারোর কুশীলবরা আবার সক্রিয় হয়েছেন।

চ) ঐক্যফ্রন্ট নতুন কোনও ষড়যন্ত্র করছে।

এই অভিযোগগুলো যারা তুলছেন, তারাই আবার বলছেন, ‘ড. কামাল কেন বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কথা বলছেন? ড. কামাল কেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলছেন? ড. কামালের কেন গণতন্ত্রের কথা বলছেন?’ কেউ কেউ বলছেন, ‘ড. কামালের বুড়ো বয়সে মতিভ্রম হয়েছে’।  ‘ড. কামাল এক বিভ্রান্ত সৈনিক’। বিএনপি ঐক্যফ্রন্টে যুক্ত হওয়ার পর এই সমালোচনার ধারা আরও তীব্র হয়েছে। এই  সমালোচনার তীরের উদাহরণ আরও বাড়ানো যায়। সেদিকে নাই বা গেলাম।

আমার কথা হলো, যেসব তথ্য ঐক্যফ্রন্ট ও ড. কামালের ব্যাপারে দেওয়া হচ্ছে, তা সাধারণ মানুষ কীভাবে নিচ্ছে। আমরা তো সবাই জানি, বিএনপি’র সঙ্গে জামায়াত আছে। আমরা তো সবাই জানি, একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলায় বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত। আমরা তো সবাই জানি, বিএনপি’র চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দুর্নীতির মামলায় পাঁচ বছরের দণ্ড নিয়ে কারাগারে আছেন। আরেকটি মামলার রায় হওয়ার কথা ২৯ অক্টোবর।

কিন্তু এরপরও বিএনপি নির্বাচনে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে। ড. কামাল হোসেন সেই ব্যানারের নেতৃত্ব দিয়ে হয়তো বিএনপিকে সহযোগিতা করছেন। বিএনপি’র যে নেতৃত্ব সংকট, তা কাটিয়ে ওঠার জন্য হয়তো এটাকেই সবচেয়ে সহজ পথ মনে করেছে। কারণ, বিএনপিতে এখন তৃতীয় নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে গেলে দল আরও সংকটের  মুখে পড়তে পারে। আর ড. কামাল হয়তো চান, জাতীয় সংসদের সদস্য হতে। সেটা নিজের ভোটে না হলেও বিএনপি’র ভোটে হবে বলে তার আশা বলে আমি মনে করি। আরও যারা এই ফ্রন্টে যুক্ত হয়েছেন, তাদের মূল উদ্দেশ্য ওই সংসদে যাওয়া বলেই আমার মনে হয়।

বিএনপি  পাঁচ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করে সংসদের বাইরে আছে প্রায় পাঁচ বছর। ক্ষমতার বাইরে আছে দশ বছরেরও বেশি সময়। রাজনৈতিক দল হিসেবে সে তার ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে চাইবে, এটাই স্বাভাবিক। আর ক্ষমতায় যাওয়া তো যেকোনও রাজনৈতিক দলের লক্ষ্য। বিএনপি তার বাইরে থাকবে কেন?

এখন কথা হলো, বিএনপি’র সঙ্গে জামায়াত থাকবে কেন? ড. কামাল কেন একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলাকারীদের সঙ্গে হাত মেলাবেন? যাদের সঙ্গে তিনি ঐক্য করেছেন, তাদের নিয়ে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার সম্ভব কিনা। আমার মনে হয় এটা নির্বাচনি  জোট। আসন ভাগাভাগির জোট। ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টার জোট। যার বড় প্রমাণ হলো, বিকল্প ধারা। ড. বদরুদ্দোজা চৌধুরী তার কাঙ্ক্ষিত আসনের নিশ্চয়তা না পাওয়ায় জোটে যাননি। সেটা তিনি নিজেও স্বীকার করেছেন। যদিও আসনসংখ্যা নিয়ে বিতর্ক আছে। আর জোটে না যাওয়ার অজুহাত হিসেবে তিনি ও তার পুত্র মাহি বি চৌধুরী জামায়াতকে ব্যবহার করেছেন। অথচ বি চৌধুরী যখন রাষ্ট্রপতি, জামায়াত নেতারা তখন মন্ত্রী। তাই তাদের এই হঠাৎ জামায়াতবিরোধিতার কারণ সহজেই বোঝা যায়।

জামায়াতের  এখন নিবন্ধন নেই। তাদের নির্বাচনি প্রতীকও নেই। জামায়াত হিসেবে তারা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। তবে তারা স্বতন্ত্র বা  অন্য দলের প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে। আমি এখন পর্যন্ত কোনও সমালোচনা দেখিনি যে, যুদ্ধাপরাধীদের সংগঠন জামায়াতে ইসলামীর লোকজন কেন ভিন্ন উপায়ে নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে। কেন তারা প্রার্থী হতে পারবে? দল হিসেবে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার দাবি শোনা গেলেও সরকার সে ব্যাপারে কোনও উদ্যোগ নেয়নি। আর ভবিষ্যতে নেবে বলেও আমার মনে হয় না। তাহলে সমস্যা হলো জামায়াত কার সঙ্গে আছে তা নিয়ে। জামায়াত থাকা নিয়ে কোনও সমস্যা কেউ দেখছেন বলে আমরা মনে হয় না।

আমার আরও একটি  কথা হলো, দল হিসেবে বিএনপি থাকবে কিনা, সে ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে। ‘সন্ত্রাসী’ সংগঠন হিসেবে বিএনপিকে নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ নেওয়াই যায়। আমরা সে ব্যাপারে কোনও উদ্যোগ দেখি না। শুধু বিএনপি একটু নড়েচড়ে বসলেই যত অসুবিধা। বিএনপি ঐক্যফ্রন্টের কারিগর হলেই অসুবিধা। ড. কামাল আইন ব্যবসা করলে অসুবিধা নাই। রাজনীতি করলেই অসুবিধা। রাজনীতি করলেই মনে হয় বুড়ো বয়সে তার ‘মতিভ্রম’ হয়েছে।

আমি মনে করি, রাজনৈতিক নেতারা প্রতিপক্ষকে তাদের মতো ঘায়েল করার চেষ্টা করবেনই। তাদের মতো সমালোচনা পাল্টা সমালোচনা করবেনই। সেটা প্রচলিত ধারা। তাদের উদ্দেশ্যও আমাদের কাছে স্পষ্ট।  সাধারণ মানুষও সেটা দেখতে অভ্যস্ত। তবে তাদের এই চেহারার বাইরেও একটা উদার চেহারা আছে। আর সে কারণেই বাংলাদেশে রাজনৈতিক নেতারাই হিরো। কিন্তু কিছু সুশীল আর সাংবাদিকের রাজনীতি বড় ভয়ঙ্কর। তারা রাজনীতির কারণে নিরপেক্ষতার লেবাস পরে। গায়ে পড়ে ‘উপকার’ করতে যান। আসলেই কি তারা নিঃস্বার্থ উপকার করেন? তাদের উদ্দেশ্য কী?

বিএনপি’র কেন ঐক্যফ্রন্ট প্রয়োজন। আর ড. কামাল হোসেনদেরই বা কেন প্রয়োজন? আশা করি আমার মতো করে আমি স্পষ্ট করতে পেরেছি। কিন্তু এই ঐক্যফ্রন্ট যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জন্যও প্রয়োজন এবং উপকারী তা কি ভেবে দেখেছেন?

এবার বিএনপি যে নির্বাচনে যাচ্ছে, সে ব্যাপারে আমার কোনও সন্দেহ নেই। তাদের একটা অসুবিধা ছিল যে, খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে তারা নির্বাচনে যাবেন কীভাবে? সেই অসুবিধা কেটে গেছে। কারণ তারা ঐক্যফ্রন্টের সিদ্ধান্তে নির্বাচনে যাবে। ফলে তখন কেউ যদি বলে খালেদা জিয়াকে ছাড়া কীভাবে নির্বাচনে গেলেন? এর জবাব হবে, আমরা তো এককভাবে নয়, ফ্রন্টের সিদ্ধান্তে ও ব্যানারে নির্বাচন করছি। সবাই যে সিদ্ধান্ত দিয়েছে, তার বাইরে তো আমরা যেতে পারি না। এতে বিএনপি’র মুখ রক্ষার পাশাপাশি নির্বাচন হবে অংশগ্রহণমূলক।

পাঁচ জানুয়ারির নির্বাচনের পর এবারের নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করা এই সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আমি মনে করি, সরকার সেই চ্যালেঞ্জে পাস করতে যাচ্ছে। আর তাতে ঐক্যফ্রন্টই সরকারকে সহযোগিতা করছে। সরকারও তাই যেকোনও ফর্মে হোক ফ্রন্টকে সমাবেশ-মিছিল-মিটিং করতে দিচ্ছে। সিলেটের পর চট্টগ্রামেও সমাবেশ করলো ঐক্যফ্রন্ট। আমার ধারণা, নির্বাচন পর্যন্ত ঐক্যফ্রন্টের এই ধরনের রাজনৈতিক কার্যক্রমে সরকার অনুমতি দেবে। কারণ পাঁচ জানুয়ারির নির্বাচন প্রতিহতের নামে বিএনপি-জামায়াতের বিরুদ্ধে যে সন্ত্রাসের অভিযোগ আছে, তা থেকে বেরিয়ে আসতে চায় বিএনপি ড. কামালের নেতৃত্বে। আর সরকারের ওপর অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের যে চাপ শুরু থেকেই আছে, সেই চাপ থেকে বেরিয়ে এসে নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করার দায়ও আছে সরকারের।

রাজনীতিতে আদর্শের লড়াই আছে। আছে ভোটের লড়াই। এই দু’টি লড়াইয়ে সব পক্ষই চায় জয় লাভ করতে। এখানে নীতিহীনতাও দেখা যায়। আবার নীতির কথাও বলা হয়। যেমন, নির্বাচনে ধর্মের ব্যবহার করে প্রায় সব রাজনৈতিক দল। ব্যবহার করে নানা ধরনের ইস্যু। কারণ নির্বাচনে জয়ই থাকে প্রধান লক্ষ্য। আর সেকারণেই কারও কাছে স্বাধীনতাবিরোধী ‘হালাল’, কারও কাছে স্বৈরাচার ‘হালাল’। রাজনীতির এই ‘হারাম-হালাল’ আবার  সময় বুঝে বদলে যায়।

কিন্তু আমি কোন পক্ষে যাবো? আমি কী বলবো? রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে কি কণ্ঠ মেলাবো! তাতে আমার কী লাভ? আপনার কী লাভ?

লেখক: সাংবাদিক

ইমেইল:[email protected]

 

/এসএএস/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
দলের সিদ্ধান্ত না মেনে ভোটে আছেন মন্ত্রী-এমপির যেসব স্বজন
উপজেলা নির্বাচনদলের সিদ্ধান্ত না মেনে ভোটে আছেন মন্ত্রী-এমপির যেসব স্বজন
টিভিতে আজকের খেলা (২৪ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২৪ এপ্রিল, ২০২৪)
চেলসিকে গুঁড়িয়ে দিলো আর্সেনাল
চেলসিকে গুঁড়িয়ে দিলো আর্সেনাল
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ