X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

হাওরের উন্নয়ন রাজনীতি এবং কিছু কথা

মো. আনোয়ার হোসেন
২৭ অক্টোবর ২০১৮, ১৬:৪৭আপডেট : ২৭ অক্টোবর ২০১৮, ১৬:৫০

মো. আনোয়ার হোসেন বাংলাদেশের একটি অনন্য প্রাকৃতিক স্বাদুপানির জলাভূমি হাওর, যার মতো বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন জলাভূমি পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যায় না। নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার জলা ও কৃষিভূমি নিয়ে হাওর গঠিত। এই অঞ্চলের ভূমি বর্ষা মৌসুমে ছয় মাস পানিতে ডুবে থাকে এবং শুষ্ক মৌসুমে পানি নেমে গিয়ে কৃষির উপযোগী হয়ে যায়। আসন্ন ভোটের মৌসুমে হাওরে চলছে উন্নয়ন রাজনীতি, জনগণের মধ্যে আছে উন্নয়ন প্রত্যাশা, আবেগ ও উচ্ছ্বাস। হাওরের বিভিন্ন অঞ্চল সফরের সময় জনসাধারণের সঙ্গে আলাপের পরিপ্রেক্ষিতে উপলব্ধি হওয়া বিষয়গুলোর ভিত্তিতে এই লেখা। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও পরিবেশ প্রকৌশল বিশেষজ্ঞ হিসেবে হাওর নিয়ে বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে বিষয়গুলো বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন করবো।
টাঙ্গুয়ার হাওরের চারদিকে বিভিন্ন জনপদে ভ্রমণের সময় আমার সাধারণ জিজ্ঞাসা ছিল—আগামী সাধারণ নির্বাচনে জনপ্রতিনিধিদের কাছে আপনাদের চাওয়া কী? তার পরে বিভিন্ন সম্পূরক প্রশ্ন করা হয়, উত্তরদাতার জবাবের পরিপ্রেক্ষিতে যেমন—কেন এই উন্নয়ন চান, হাওরের ক্ষতি হবে কিনা, মৎস্যসম্পদ, কৃষি তথা ধান, পানির গুণাগুণসহ হাওরের প্রাণ-প্রতিবেশের ক্ষতি, পেশার ক্ষতি হবে কিনা—এমন অনেক প্রশ্ন। এই অভিমত গবেষণার ফলের মতো সব হাওরের জনগোষ্ঠীর অভিমত নয়। তবে আংশিক প্রতিফলন তো অবশ্যই।

হাওরের প্রায় সবাই হাওরে রাস্তা চায় যদিও প্রবীণরা অন্যমত দিয়েছেন। ডাঙাতে যেমন শুকনো খটখটে রাস্তা হয়, তেমন রাস্তা চায় কারণ জল-কাদাপানিতে হাঁটতে হাঁটতে তারা বিরক্ত, নিজেদের অবহেলিত ও অবজ্ঞা করা অধিবাসী মনে করেন।

প্রার্থীদের মধ্যে যারা আগামী জাতীয় সংসদে লড়বেন তাদের মধ্যে যারা হাওরে রাস্তা তৈরির নিশ্চিত ওয়াদা করবেন, তাদেরই ভোট দেবে বলে জানিয়েছেন অধিকাংশ মানুষ। জনগণের এই অভিমতের কারণ কী? হাওর যে একটি অবহেলিত জনপদ ছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সেই বঞ্চনা ও অবহেলা থেকে আক্ষেপ করে অনেকে মন্তব্য করেছেন। মাটি দিয়ে তৈরি উঁচু শুকনো রাস্তার কথা বলার পেছনে অনেক কারণ আছে। তারমধ্যে প্রধান কারণ ইটনা-মিঠামইন ‘আভুরা সড়ক’ নির্মাণ করা হাওরের সকল জনগণকে আশাবাদী ও উদ্বুদ্ধ করেছে। কিশোরগঞ্জ থেকে আসা রাষ্ট্রপতির বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড হাওরের প্রতিটি জনগণকে আশাবাদী করেছে। সেজন্য এই রাস্তার খারাপ দিকের কথা বললে তারা অনেক অসৌজন্যমূলক মন্তব্য ও আচরণ করেছে। এছাড়া হাওর থেকে ডাঙাতে কাজ করতে যাওয়া জনমানুষের যোগাযোগের অভিজ্ঞতা, ধর্মীয় শিক্ষা প্রসারে হাওরের যাওয়া মানুষের বিভিন্ন কাজ-কর্ম, এনজিওকর্মীদের নিত্য মোটিভেশান, হাওর বিষয়ক বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের প্রচারণা, সরকারি কর্মকর্তাদের রাস্তার জন্য কর্ম এলাকায় না যাওয়া, সরকারি সুযোগসুবিধা না পাওয়াসহ অনেক কারণ হাওরের জনগণকে ‘আভুরা সড়ক’ তৈরি করার অভিমত দেওয়ার অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে। তবে কিছু মানুষ বলেছে, যারা আগে ওয়াদা ভঙ্গ করেছে বা রাস্তা ও ব্রিজ ভোটের জন্য অর্ধেক নির্মাণ করে আটকে রেখেছেন, তাদের বয়কট করবেন।

আভুরা সড়ক নির্মাণ করলে হাওরের ক্ষতি হবে না, ধান চাষের, মাছের তথা হাওরের প্রাণ-প্রতিবেশের ক্ষতি হবে না? এমন প্রশ্নের জবাবে যেমন তীব্র মন্তব্য পাওয়া গেছে, তেমনি গঠনমূলক কথাও বলেছেন অনেকে। এ প্রশ্নের জবাবে তরুণ শ্রেণির উত্তরদাতারা তীব্র কটাক্ষমূলক মন্তব্য করেছেন। তাদের মন্তব্যগুলো এমন যারা এজাতীয় প্রশ্ন করে তারা উন্নয়নবিরোধী, হাওরের উন্নয়ন চায় না। তুমি হাওরের মানুষ না, বাইরের মানুষ,  হাওর আমাদের, আমাদের উন্নয়ন আমরা যেভাবে খুশি করবো, তুমি বাধা দেওয়ার কে? বলে রাখি, শুধু হাওরে নয়, ঢাকাতেও একই মানসিকতার সম্মুখীন হয়েছি আমি। বয়স্কশ্রেণির মানুষের কথাবার্তা ছিল গঠনমূলক। কেন তরুণ শ্রেণির এমন গরম মন্তব্য? এর পেছনের প্রধান কারণ তাৎক্ষণিক রাজনীতিক প্রাপ্তি, রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের প্রচার ও বঞ্চনা। তাদের অনেকেই জানেন না রাস্তা হলে কৃষি, মাৎস্য ও পানিসম্পদের ব্যাপক ক্ষতি হবে। তারা মনে করেন, ধান ও মাছ হাওরের অফুরান সম্পদ, যা কখনও শেষ হবে না। তারা রাস্তার তাৎক্ষণিক প্রাপ্তি অর্থাৎ পায়ে কাদা-পানি না লাগিয়ে চলাচলের সুযোগকে বড় করে দেখছেন, ডাঙার মানুষের সমান হচ্ছেন ভেবে একধরনের আত্মতৃপ্তি অনুভব করছেন। সম্ভবত বয়সে তরুণ হওয়ায় অনভিজ্ঞতা এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক দুর্বৃত্তায়ন এ জাতীয় মন্তব্য করার কারণ হতে পারে।       

বয়স্করা তাদের অভিজ্ঞতার আলোকে অনেক সুন্দর আলোচনা করেছেন। আলোচনার ভেতরে হাওরের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে বিভিন্ন তথ্য ও অভিমত দিয়েছেন। হাওরের উন্নয়ন নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জনপ্রতিনিধি, সরকারি কর্মকর্তা, এনজিও, সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের আশ্বাস এবং কিছুসময় পর আশ্বাস বাস্তবায়িত না হওয়ায় হাওরের মানুষ আশাহত ও ক্ষুব্ধ। এভাবে উন্নয়নের আশ্বাস দেওয়া ও পরবর্তী সময়ে আশাহত করার একটি দুষ্টুচক্র দশকের পর দশক চালু আছে হাওরে। তাই উন্নয়ন নিয়ে যুবকরা যেমন আগ্রাসী, তেমনি বয়স্করা সংগঠিত ও গঠনমূলক। যুবকরা বলছেন, হাওরের উঁচু-উঁচু রাস্তা করে হাওরকে, হাওরের পানিকে জয় করা উচিত। কারণ হাওরের বিপুল পানিই তাদের প্রধান সমস্যা। এছাড়া বিশাল হাওরকে জয় করার একটা পাশবিক আনন্দ কাজ করে যুবক মনে। বয়স্করা বলছেন,  না রাস্তা নয়, অন্য কিছু করতে হবে দ্রুত যোগাযোগের জন্য। হাওরের মাছ ও ধান তাদের প্রধান সম্পদ। আর সে কারণেই বাইরের মানুষের কাছে হাওরের গুরুত্ব রয়েছে। উঁচু ‘আভুরা সড়ক’ করলে হাওরের ধান ও মাছ দুই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে কমে যাবে এবং হাওর গুরুত্বহীন হয়ে যাবে। তখন গুরুত্বহীন হাওরের উন্নয়নে কেউ আগ্রহী হবে না। কয়েকজন তাদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করে বললেন, এখন হাওরের প্রান্ত দিয়ে যে ‘আভুরা সড়ক’গুলো রয়েছে, এগুলো তৈরি হওয়ার আগে সব জমির পানি কৃষি মৌসুমের আগেই নেমে যেতো। সেখানে ধানসহ বিভিন্ন রবিশস্য আবাদ করা যেতো। বর্তমানে রাস্তায় ছোট ব্রিজ বা কালভার্ট থাকলেও পানি পুরাপুরি মৌসুমের আগে নামে না। ফলে আগের মতো অনেক জমিতে বিভিন্ন কৃষি ফসল করা যায় না। পানি বের হয়ে না যাওয়ায় কলমি, শেওলা, কচুরিপানা, ঢোল কলমিসহ বিভিন্ন জলজ আগাছা জমিকে ঢেকে ফেলে অনাবাদী করেছে। এছাড়া এই প্রান্তগুলোতে আগে বিভিন্ন প্রজাতির বড় মাছ পাওয়া যেতো, এখন যায় না। সম্ভবত রাস্তার ফলে পানি প্রবাহে বাধার কারণে বড় মাছেরা এসব এলাকায় বিচরণ করা বন্ধ করেছে।  বড় রাস্তা হলে হাওরের বেশিরভাগ এলাকা ওই একইরকম ভাগ্য বরণ করবে। বয়স্করা বলেছেন দেশের আগামী নির্বাচনে যে প্রতিনিধিরা হাওরের ধান ও মাছকে বাঁচিয়ে উন্নয়নের কথা বলবেন, তাদের ভোট দেবেন।

হাওরের উন্নয়ন মানেই যোগাযোগ বা রাস্তা—এমন একটি রাজনৈতিক অভিমত চলছে। হাওরের ধান ও মাছ নষ্ট করে, প্রাণ প্রতিবেশ নষ্ট করে, জলপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত করে এই উন্নয়নকে কি সাধারণ জনগণের ও রাজনৈতিক নেতাদের রাজনৈতিক অভিমতের ওপর ছেড়ে দেওয়া উচিত? বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে মনে করি, জনগণ ও রাজনৈতিক নেতা নয়, যারা হাওরের প্রাণ-প্রতিবেশ বোঝে না—এ রকম সব মানুষকে হাওরের বিষয়ে যেকোনও সিদ্ধান্ত নিতে দেওয়া উচিত নয়। কারণ সাধারণ মানুষ নগদ লাভ খোঁজে, তলিয়ে না ভেবে হুজুগে সিদ্ধান্ত নেয়, রাজনৈতিক নেতাদের সিদ্ধান্ত ভোটের ওপর নির্ভরশীল সে ভালো বা মন্দ যাই হোক। সরকারি কর্মকর্তাদের সিদ্ধান্ত হয়, সাধারণত প্রাপ্তিনির্ভর। সমকাকর্মীদের সিদ্ধান্ত ইস্যুভিত্তিক প্রাপ্তিতে সীমাবদ্ধ। তাই তাদের দিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন। সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য হাওরের প্রাণ-প্রতিবেশ বিষয়ে বাস্তব অভিজ্ঞতা আছে, পানিপ্রবাহ বোঝে, ক্ষতিকর প্রভাব বুঝবেন, ভাড়াটে এক্সপার্ট বা বোঝার ভান করা ব্যক্তিদের নয়, সর্বোপরি টোটাল হাওরের পরিবেশ-জীবন-জীবিকা বোঝেন, এমন মানুষদের সন্নিবেশিত করা উচিত বলে মনে করি। হাওরের সেই রাজনৈতিক নেতৃত্বকে নির্বাচিত করা, যারা হাওরকে বাঁচিয়ে রেখে উন্নয়ন করবেন, হাওরের জনগণের এমনই প্রত্যাশা।

লেখক: অধ্যাপক, ফার্ম স্ট্রাকচার অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি)।

/এসএএস/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত সাংবাদিকের সংখ্যা বেড়ে ১৩৭
গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত সাংবাদিকের সংখ্যা বেড়ে ১৩৭
কানে ডিভাইস নিয়োগ পরীক্ষার কেন্দ্রে বোন, বাইরে থেকে উত্তর বলার অপেক্ষায় ভাই
কানে ডিভাইস নিয়োগ পরীক্ষার কেন্দ্রে বোন, বাইরে থেকে উত্তর বলার অপেক্ষায় ভাই
কাভার্ডভ্যান-লরির মুখোমুখি সংঘর্ষে দুই গাড়িতেই আগুন, প্রাণ গেলো একজনের
কাভার্ডভ্যান-লরির মুখোমুখি সংঘর্ষে দুই গাড়িতেই আগুন, প্রাণ গেলো একজনের
বাড়লো ব্রয়লার মুরগির দাম, কারণ জানেন না কেউ
বাড়লো ব্রয়লার মুরগির দাম, কারণ জানেন না কেউ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ