X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

পোড়া মোবিল কার মুখে?

হারুন উর রশীদ
২৮ অক্টোবর ২০১৮, ২৩:৩৭আপডেট : ২৯ অক্টোবর ২০১৮, ১৪:০৬

হারুন উর রশীদ পরিবহন শ্রমিকদের কর্মরিতির নামে ধর্মঘটে এবার আলোচনায় পোড়া মোবিল। শ্রমিকদের এই ‘পোড়া মোবিলসন্ত্রাস’ থেকে ব্যক্তিগত পরিবহনের চালক, মোটরবাইক আরোহী থেকে শুরু করে কলেজছাত্রী পর্যন্ত, কেউ-ই রেহাই পায়নি। আমার প্রশ্ন, এই পোড়া মোবিল তারা কেন মারছেন? কার মুখে মারছেন?
পরিবহন শ্রমিকরা ৮ দফা দাবি নিয়ে ৪৮ ঘণ্টার কর্মবিরতিকে আছেন রবিবার সকাল থেকে। আর সকালেই তারা যাত্রাবাড়ী এলকায় একটি ব্যক্তিগত পরিবহনের চালকের মুখে পোড়া মোবিল মেখে দেন। সেই ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। ছবিটিতে সেই চালকের পোড়া মোবিলমাখা মুখে যে অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে, তার বর্ণনা কোনও ভাষা দিয়ে সম্ভব নয় বলেই আমার কাছে মনে হয়েছে। এরপরও ওই মুখে অসহায়ত্বের পাশাপাশি আমি দেখেছি কান্না আর ঘৃণা। আমার কাছে যেন তার মুখটি মনে হয়েছে, পোড়া মোবিলে মাখা অসহায় বাংলাদেশের মুখ। সেখানে ফুটে উঠেছে এক ভিন্নচিত্র। এই বাংলাদেশ বলছে, এখানে দুর্বৃত্তদের আস্ফালনের কথা। এই বাংলাদেশ বলছে, জোটবদ্ধ অপরাধীদের কাছে অসহায় বাংলাদেশের কথা। দুর্বৃত্তরা যেন পোড়া মোবিল মাখিয়ে বাংলাদেশের মুখই কালো রঙে ঢেকে দিয়েছে। এই কালো কলঙ্ক কার? ঘৃণ্য পরিবহণ রাজনীতির।

শুধু ঢাকায় নয়, নারায়ণগঞ্জেও একই কাজ করেছেন কিছু পরিবহন শ্রমিক। তারা কলেজছাত্রীর ড্রেসে মেখে দিয়েছেন পোড়া মোবিল। তারা পোড়া মোবিল ছুড়েছেন অ্যাম্বুলেন্সেও। নারীর পোশাকে কালো মোবিল ছুড়ে তারা নারীর প্রতি সহিংসতা দেখিয়েছেন। নারীকে অবমাননা করেছেন। নারীর অবমাননারীরা শ্রমিক নয়, দুর্বৃত্ত।

পোড়া মোবিলের এই সন্ত্রাসী ব্যবহার হয়েছে পুলিশের সামনে কিন্তু পুলিশ অসহায় এই মানুষগুলোকে  রক্ষায় এগিয়ে যাননি। সড়ক দুর্বৃত্তের  কাছে তারাও কি অসহায়? পোড়া মোবিল সন্ত্রাসীদের জোর কোথায়। তারা কাদের উসকানিতে পোড়া মোবিল সন্ত্রাসে নেমেছেন?

সড়াকের নিরাপত্তায় সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের আন্দোলনের মুখে সরকার সড়ক নিরাপত্তা আইন ২০১৮ পাস করেছে। কিন্তু এই থেকেই শ্রমিক নেতারা মিথ্যাচার করে সাধারণ শ্রমিকদের উসকানি দিয়ে আসছেন। তারা বলছেন, শ্রমিকরা গলায় ফাঁসির দড়ি নিয়ে গাড়ি চালাবেন না। তারা ভুয়া তথ্য দিচ্ছেন যে, আইনে ৩০২ ধারায় হত্যা মামলা দায়েরের বিধান করা হয়েছে। কিন্তু বরং উল্টো করা হয়েছে। সাত বছরের কারাদণ্ডের বিধান কমিয়ে পাঁচ বছর করা হয়েছে।   এখানও আন্দোলন তো সাধারণ নাগরিকদের এই আইনের বিরুদ্ধে করা উচিত ছিল। তা না হয়ে উল্টো নেতারা শ্রমিকদের মিথ্যা তথ্য দিয়ে মাঠে নামিয়ে পোড়া মোবিল সন্ত্রাস করাচ্ছেন।

ঠাকুরগাঁওয়ে একজন রিকশাচালকের মুখে পোড়া মোবিল মেখে দেন পরিবহন শ্রমিকরা

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন তাদের আট দফা দাবির যে লিফলেটটি বিলি করেছে, সেখানে স্পষ্ট তথ্য বিকৃতি করা হয়েছে। তারা বলেছে, ‘৩০২ ধারায় শ্রমিকদের গলায় ফাঁসির দড়ি ঝোলানোর সুযোগ রাখা হয়েছে।’ আর এই মিথ্যাচার তারা পরিকল্পিতভাবেই করছেন। শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে সমাবেশ করে কর্মবিরতির কর্মসূচি ঘোষণার  সময় ফেডারেশেনের সহ-সভাপতি সাদিকুর রহমান হিরু বলেন, ‘ফাঁসির আইন মাথায় নিয়ে আমরা সড়কে গাড়ি চালাতে পারবো না।’

নতুন আইন অনুযায়ী বেপরোয়াভাবে বা অবহেলা করে গাড়ি চালানোর কারণে কেউ আহত বা নিহত হলে দণ্ডবিধির ৩০৪ (খ) ধারায় মামলা দায়েরের কথা বলা আছে। আর এই ধারায় সাজা সর্বোচ্চ পাঁচ বছর কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ড এবং সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা। তবে, তদন্তে যদি এটাকে ইচ্ছাকৃত নরহত্যা প্রমাণিত হলে  মামলা ৩০২ ধারায়  রূপান্তরিত করার বিধান আছে। যার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। শুরুতেই ৩০২ ধারায় মামলার বিধান নেই।

সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলীর দাবি এই বিধানও রাখা যাবে না। তার কথা কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে দুর্ঘটনা ঘটায় না, এটাকে ধ্রুব সত্য হিসেবে মেনে নিয়ে আইন করতে হবে। তার এই দাবিকে আমার কাছে হত্যার লাইসেন্স চাওয়ার মতো মনে হয়েছে। কারণ, এটা যদি মেনে নেওয়া হয়, তাহলে বাংলাদেশে কাউকে হত্যা করার জন্য আর ভাড়াটে খুনি লাগবে না। বাস চালকদের দিয়েই কাজ সারা যাবে।

দুর্ঘটনা আমরা তাকেই বলবো, যেখানে গাড়ির ফিটনেস, ড্রাইভিং লাইসেন্স ড্রাইভারের ফিটনেস, গাড়ির কাগজপত্রসহ সব কিছু ঠিক থাকার পরও যদি দৈবক্রমে কোনও দুর্ঘটনা ঘটে। কিন্তু ড্রাইভারে যদি লাইসেন্স না থাকে, গাড়ি যদি ত্রুটিপূর্ণ হয়, ড্রাইভারের যদি ফিটসেন না থাকে অথবা রেসের কারণে যদি কেউ দুর্ঘটনায় নিহত হন, সেটা তো হত্যাকাণ্ডই হবে। সেটার শাস্তি তো পেতে হবে।

ধর্মঘট পালনকারী শ্রমিকদের হ্যান্ডবিল আসলে এই পরিবহন শ্রমিকদের কর্মবিরতির পেছনে মালিকদের হাত আছে। কারণ, তাদের গাড়ির ফিটনেস নেই, কম বেতনে অদক্ষ ড্রাইভার নিয়োগ করেন। তাদের মুনাফার লোভের কারণেই ড্রাইভাররা ট্রিপ বাড়াতে গিয়ে বেপরোয়া গাড়ি চালান। তারা নিয়োগপত্রও দেন না। সবার ওপরে যে পাঁচ লাখ টাকা ক্ষতিপুরণের বিধান আছে, নতুন আইনে তা মালিকদেরই দিতে হবে। তাই ৩০২ ধারায় ফাঁসির দড়ির মিথ্যাতথ্য দিয়ে শ্রমিকদের মঠে নামিয়ে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে স্বার্থ উদ্ধার করতে চাইছে।
সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরি সভাপতি নৌপরিবহনমন্ত্রী শজাহান খান। তিনি এই নৈরাজ্যে চুপ রয়েছেন। শ্রমিকদের কর্মবিরতি ও নৈরাজ্যের ব্যাপারে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, ‘আমি এই ব্যাপরে কিছু জানি না।’ তবে তার সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, ‘উনি তো আমাদের সাংগঠনিক লোক। তার তো না জানার কথা না। তিনি জানেন।’
আসলে তিনি সচেতনভাবেই এখন জানেন না। কারণ অর্থমন্ত্রী ধর্মঘটের নামে নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন। আর সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী বলেছেন শ্রমিকদের দাবি মানা সম্ভব নয়। শাজাহান খান আসলে এখ দুই কুলই রক্ষার ফন্দি করছেন। তার মূল শক্তি শ্রমিক নেতৃত্ব আর বোনাস মন্ত্রিত্ব—কোনোটাই তিনি হরাতে চান না। এর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় দুই শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার পর তার হাঁসি আমরা দেখেছি।
শ্রমিকদের আট দফা দাবির মধ্যে চাতুরতা আছে। কারণ, সেই আট দফার মধ্যে কোথাও নেই যে ৩০২ ধারায় মামলার বিধান প্রত্যাহার করতে হবে। কারণ, নেতারাও জানেন, এটা আইনে নেই। কিন্তু মুখে ও লিফলেটে তারা বলছেন, ‘আমরা ফাঁসির দড়ি গলায় নিয়ে গাড়ি চালাবো না।’
তাদের আট দফা দাবিগুলো হলো—সড়ক দুর্ঘটনায় সব মামলা জামিনযোগ্য করতে হবে, শ্রমিকদের অর্থদণ্ড ৫ লাখ টাকা প্রত্যাহার, সড়ক দুর্ঘটনার তদন্ত কমিটিতে শ্রমিক প্রতিনিধি রাখতে হবে, ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতা ৫ম শ্রেণি করতে হবে, ওয়েস্কেলে জরিমানা কমানো ও শাস্তি বাতিল, সড়কে পুলিশি হয়রানি বন্ধ, গাড়ি রেজিস্ট্রেশনের সময় শ্রমিকের নিয়োগপত্রে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের স্বাক্ষরের ব্যবস্থা রাখতে হবে ও সব জেলায় শ্রমিকদের প্রশিক্ষণের পর লাইসেন্স ইস্যু ও লাইসেন্স ইস্যুর সময় হয়রানি বন্ধ করতে হবে।
তারা মামলার তদন্তেও শ্রমিকদের প্রতিনিধি চায়। তাহলে তো থানা পুলিশ আর তদন্ত সংস্থা উঠিয়ে দিতে হবে। হয়তো কিছুদিন পর তারা বলবে, বিচার কাজেও আমাদের প্রতিনিধি রাখতে হবে। তারা পুলিশের হয়রানি বন্ধ করতে বলেছেন। হয়রারি অবশ্যই বন্ধ করা উচিত। কিন্তু এখানে সাধারণ মানুষের কী করার আছে?
তাদের যেসব দাবি যৌক্তিক, সেগুলো মানার আহ্বান আমরাও জানাই। কিন্তু মিথ্যাতথ্য দিয়ে শ্রমিকদের নৈরাজ্যের পথে নামানোর দায় শ্রমিক নেতাদের। তারা মালিকদের মুনাফার  স্বার্থে জঘন্য পথ বেছে নিয়েছেন। শুরু করেছেন ‘পোড়া মোবিলসন্ত্রাস’। তাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসদমন আইনে মামলার দাবি করছি। আর মিথ্যা ও বিভ্রান্তির তথ্য দিয়ে শ্রমিকদের উসকানি দিয়ে মাঠে নামানোর অপরাধে  ডিজিটাল আইন কি এখন প্রয়োগ হবে?
একজন মন্ত্রীর হাসিমুখ পুরো জাতিকে কাঁদিয়েছে। আর এখন মানুষের মুখে পোড়া মোবিল মেখে দিয়ে মানুষের হাসি কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। আসলে এই পোড়া মোবিল কার প্রাপ্য, কাদের প্রাপ্য? কাদের মুখে পোড়া মোবিল দেওয়া উচিত?

এর জবাব কী?

এই লেখাটি শেষ করার পরেই রবিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে খবর আসে মৌলভীবাজারে সাত দিন বয়সী এক শিশু মারা গেছে। অসুস্থ এই শিশুটিকে অ্যাম্বুলেন্সে করে সিলেট নেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছিল। কিন্তু পথে পথে ধর্মঘটী শ্রমিকদের বাধায় তাকে হাসপাতালে নেওয়া যায়নি। পথেই শিশুটির মৃত্যু হয়।

লেখক: সাংবাদিক

ইমেইল: [email protected]

 

 

 

/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
উত্তর কোরিয়া সফর করলেন রুশ গোয়েন্দা প্রধান
উত্তর কোরিয়া সফর করলেন রুশ গোয়েন্দা প্রধান
ঈদে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌপথে চলবে ১৫ ফেরি, ২০ লঞ্চ
ঈদে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌপথে চলবে ১৫ ফেরি, ২০ লঞ্চ
ট্রলারের ইঞ্জিন বিস্ফোরণে চার জন অগ্নিদগ্ধ
ট্রলারের ইঞ্জিন বিস্ফোরণে চার জন অগ্নিদগ্ধ
প্রিয় দশ
প্রিয় দশ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ