X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

লবণের হাঁড়ি লবণে খায়

আনিস আলমগীর
৩০ অক্টোবর ২০১৮, ১৫:৫২আপডেট : ৩০ অক্টোবর ২০১৮, ২১:৪৭

আনিস আলমগীর দ্রুত অনেক কিছু ঘটে যাচ্ছে রাজনীতিতে। দুর্নীতির মামলায় উচ্চ আদালতের রায়েও দণ্ড বহাল থাকায় নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষিত হয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। তফসিলের আগে সংলাপ নেই বলে এলেও সোমবার আওয়ামী লীগ ঘোষণা করেছে বিএনপিকে নিয়ে গঠিত ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে তারা সংলাপে বসবে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় গণভবনে এই বৈঠক হতে পারে বলে বলা হচ্ছে। মাত্র ক’দিন আগে চট্টগ্রামের জনসভায় ড. কামাল হোসেন তাদের দাবি না মানলে চরম পরিণতি হবে বলে হুংকার দিয়েছিলেন। সাধারণত এমন ভাষায় ড. কামাল কথা বলেন না। সরকার কি তার হুংকারে কাত হয়ে গেছে? সরকার কাত হয়ে যাক আর দৃঢ় থাকুক, এটা বলা চলে যে সংলাপে বসার এই সিদ্ধান্ত এবং এই সিদ্ধান্তকে ঐক্যফ্রন্টের ত্বরিত স্বাগত জানানো রাজনীতিতে সুবাতাস আসার লক্ষণ। নির্বাচনে সে বাতাস আদৌ বয়ে যাবে কিনা দেখার জন্য আমাদের অবশ্য একটু অপেক্ষা করতে হবে। আগামী নির্বাচনের আগে দশম সংসদের শেষ অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সমাপনী বক্তব্যে বলেছেন, ‘আবার আসিব ফিরে এই সংসদে’। প্রধানমন্ত্রী আবারও সরকার গঠন করবেন সেই আশা করেছেন। দেশবাসীও আশা করেন নির্বাচন হোক নিরপেক্ষ এবং সবার অংশগ্রহণমূলক। তবে ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনে যাবে এই নিশ্চয়তা এখনও কেউ দিতে পারছে না। এমনকি তাদের সম্ভাব্য প্রার্থীরাও নিশ্চিত করে বলতে পারেন না– নির্বাচন হচ্ছে এবং তারা অংশ নিচ্ছেন।

গত ২২ অক্টোবর ড. কামাল হোসেন জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে খুবই সংক্ষিপ্তভাবে কেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করলেন তার উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করেছেন। ড. কামাল, ডাক্তার জাফরুল্ল্যাহ চৌধুরী, ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন প্রমুখ বিএনপির সঙ্গে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করেছেন বলে উভয় পক্ষ লাভবান হয়েছে। বিএনপি নেতৃত্বশূন্য বলে তাদের সমর্থকদের মনে যে আতঙ্ক বিরাজ করছিল তা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার একটা উপায় বের হলো। আবার জাতীয় পর্যায়ে খ্যাতিসম্পন্ন এই তিন ব্যক্তির নিজেদের কার্যকর কোনও সংগঠন না থাকলেও বিএনপির মতো একটা সংগঠনের ওপর ভর করে জনগণের সামনে আসার সুযোগ পেলেন।

আ স ম রব, মাহমুদুর রহমান মান্না আর সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদ– ডাকসুর তিন সাবেক ভিপি। এই তিন ব্যক্তিও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। আ স ম রবের দেশব্যাপী ছিটেফোঁটা সংগঠনও রয়েছে। ঐক্যফ্রন্ট আগেই ৭ দফা দাবিও পেশ করেছে। তারা নির্বাচনের সিডিউল ঘোষণার আগেই ৭ দফায় বাস্তবায়ন চান। দাবি দাওয়া আদায় করে নির্বাচন করতে হলে দীর্ঘদিন আগেই মাঠে নামতে হয়। দেশের মানুষকে দাবি আদায়ের আন্দোলন সংগ্রামের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত করতে হয়। তারা এক্ষেত্রে অনেক বিলম্বে মাঠে নেমেছে। তাই কোন জাদু বলে ৭ দফা আদায় করবেন আমি বুঝতে পারছি না। কারণ, নির্বাচনের ৭০ দিন আগে মাঠে নেমে নির্বাচন করা যায়, আমার দৃষ্টিতে দাবি আদায় সম্ভব নয়।

যাক, ধারণা ছিল জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতারা মাঠ ওয়ার্মআপ করে নির্বাচন করার প্রস্তুতি নেবেন এবং আওয়ামী ফ্রন্টের সঙ্গে খুব একটা ভালো প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হবেন। ড. কামাল হোসেন গং যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জিতে আসেন তবে তাদের প্রতিশ্রুত কাজগুলো করার জন্য সরকার গঠন করবেন। কিন্তু ২২ অক্টোবর প্রেসক্লাবের বক্তৃতায় ড. কামাল হোসেন যা বলেছেন তা বিভ্রান্তিকর। তার লিখিত বক্তব্যে বলেছেন তিনি ব্যক্তিগতভাবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন না এবং ক্ষমতায় যাওয়ারও তার কোনও অভিলাষ নেই। তবে কি তিনি বিএনপির ছত্রভঙ্গ ময়দান গোছানোর দায়িত্ব নিয়েছেন? তিনি কি সেখানে ‘ভাড়া খাটতে’ গেছেন? এটা তো ওকালতি নয় যে পেশাদারিত্বের কথা বলে টাকা রোজগার করা যাবে, চোর বাটপারেরও জামিন নেওয়া যাবে! নাকি খালেদা জিয়া বা তারেক জিয়াকে ক্ষমতায় আনার মিশনে নেমেছেন? নির্বাচনের আগে এটা তার পরিষ্কার করে বলা উচিত।

সবাই ধারণা করছিল ড. কামাল প্রধানমন্ত্রী হওয়ার চেষ্টা করছেন। বিএনপি বলছে, তারা নির্বাচনে জিতলে তাদের স্থায়ী কমিটির প্রবীণ সদস্যদের কেউ প্রধানমন্ত্রী হবেন। মওদুদ যদি প্রধানমন্ত্রী হন বা ড. মোশারফ যদি প্রধানমন্ত্রী হন তবে ড. কামাল ৭ দফা দিয়ে যে ১১ দফা লক্ষ্য বাস্তবায়নের কথা বলছেন তা তো সম্ভব নয়। মওদুদ ভুয়া দলিলে বাড়ির মালিক হওয়া লোক, দাউদকান্দির সাধারণ মানুষ বলে ড. মোশারফের পৈতৃক ২ কাঠা জমিনের পরচা নেই, এখন তিনি ১৫০০ কোটি টাকার সম্পদের মালিক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ছাড়ার পর তিনি কোনও ব্যবসা করেছিলেন? ১০/১২ বছর মন্ত্রিত্ব করে তো এত টাকার মালিক হওয়ার কথা নয়। টাকা পাচারেরও মামলা আছে তার বিরুদ্ধে।

নৈতিকতা নির্ভর কথা বলে বেড়াচ্ছেন ড. কামাল আর জোট করলেন মওদুদ বা মোশারফের মতো লোককে প্রধানমন্ত্রী করার জন্য? সব সরকারের প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীরা বহু কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে প্রমাণ করেছেন মন্ত্রী মানেই সৎ নন এবং সন্দেহের ঊর্ধ্বে নন। তবে বিএনপির মন্ত্রী সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিবাজ একথা দেশের মানুষ বিশ্বাস করে। এই দুর্নীতিবাজ মন্ত্রীদের তিনি পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য সারাদেশে নিয়ে ঘুরে বেড়াবেন এটা কেমন কথা। চোরের ঘর পাহারা সাধু দিতে যাবেন কেন!

ড. কামালের সততা নিয়ে কেউ খুব প্রশ্ন করছেন না। তিনি যাদের নিয়ে মাঠে নেমেছেন সেখানে তো বাটি চালান দিলেও একটা সৎ লোক পাওয়া যাবে না। ড. কামাল নিজেও কি বিশ্বাস করেন সেখানে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার মতো সৎ লোক আছে? ২০০৪ সালে আওয়ামী লীগের জনসমাবেশে যে গ্রেনেড হামলা হলো, ড. কামালের একসময়ের সহকর্মী আইভি রহমানসহ যে ২৪ জন নেতাকর্মী ঘটনাস্থলে প্রাণ হারালেন, তার দায় কি বিএনপি সরকার এড়াতে পারে? ড. কামালকেই তো আমরা দেখেছি এর প্রতিবাদে রাস্তায় মিছিল করতে। জজ মিয়াকে প্রধান আসামি করে যে চার্জশিট প্রদান করা হলো তাতে কি প্রমাণিত হয় না বিএনপি সরকার এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল এবং শেখ হাসিনাসহ সব আওয়ামী লীগ নেতাকে হত্যা করার জন্য এই হামলা করা হয়েছিল? এমন ঘৃণ্য কাজে যুক্তদের সঙ্গে জোট বেঁধে ড. কামালের মতো লোকের মিটিং মিছিল করা কি ন্যায়সম্মত কাজ হচ্ছে?

রাষ্ট্র পরিচালনায় আওয়ামী লীগের কোনও ভুল ত্রুটি নেই সেকথা আমরা তো বলছি না। কিন্তু গ্রেনেড হামলায় হত্যার মতো ত্রুটি তো আওয়ামী লীগের নেই। হাওয়া ভবনের মতো প্যারালাল অফিস খুলে বসার ত্রুটি তো আওয়ামী লীগের প্রধানমন্ত্রীর ছেলের নেই। তারেক জিয়ার কর্মকাণ্ডে ২০০১ সালের পর বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অকার্যকর হয়ে পড়েছিলেন। ২০০৪ সালের গ্রেনেড হামলা তারেক জিয়ার পরিকল্পনা মোতাবেক হয়েছিল। দুই মামলায় তার ১৭ বছরের জেল হয়েছে। আর গ্রেনেড হামলা মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে।

কোনও অভিযোগেই তো খালেদা জিয়া, তারেক রহমান নিজেদের নিরপরাধ প্রমাণ করতে পারছেন না। অপরের অমঙ্গল কামনায় সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকলে নিজের মঙ্গল আর হয়ে ওঠে না। ক্ষমতায় থাকতে রাষ্ট্র পরিচালনায়, দল পরিচালনায়, জাতীয় রাজনীতিতে তাদের কোনও সুস্থ চিন্তা ছিল না। আশ্চর্যের বিষয়, ড. কামাল শেষ বয়সে এসে এদের নিয়ে সমাজকে দুর্নীতিমুক্ত করতে আর মহান গণতন্ত্রকে কালিমামুক্ত করতে চাচ্ছেন।

আমরা ধারণা, ড. কামাল গং একা একা ক্ষুদ্র সমাবেশ করে কথা বললেও সমাজ উপকৃত হতো। কিন্তু এখন যে পথে হাঁটছেন তাতে সমাজের কোনও উপকার হবে না। তাদের ব্যক্তিগত লাভ হলেও হতে পারে। একটা উৎকৃষ্ট মাথা সমাজের উপকার করতে পারে। কিন্তু তিনি উৎকৃষ্ট মাথা নিয়ে শেষ বয়সে নিকৃষ্ট কাজের দায়িত্ব নিয়েছেন।

সম্ভবত শেখ হাসিনা বিদ্বেষই ড. কামালকে উদ্বুদ্ধ করেছে লাঠিতে ভর করে বিএনপির সঙ্গে ঐক্য করে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত করতে- সারাদেশ ঘুরে বেড়াতে। ড. কামালকে একটা কথা মনে করিয়ে দিতে চাই– লবণের হাঁড়ি লবণে খায়। বিদ্বেষের ফল শেষ পর্যন্ত ভালো হয় না। আপনার বিদ্বেষ আপনাকে খাবে। শেখ হাসিনাকে মারতে চেয়েছিল যারা, তারা সফল হয়নি। আপনি তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তাকে ক্ষমতা থেকে সরাতে চাইলেও সফল হবেন না। কারণ, আপনার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সৎ না।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জাবি ছাত্রলীগের সেই ৩ কর্মীকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের সুপারিশ 
জাবি ছাত্রলীগের সেই ৩ কর্মীকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের সুপারিশ 
সিরিয়ায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত ৩৮
সিরিয়ায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত ৩৮
বেচাকেনা জমজমাট, কম দামে ভালো পাঞ্জাবিতে আগ্রহ ক্রেতাদের
বেচাকেনা জমজমাট, কম দামে ভালো পাঞ্জাবিতে আগ্রহ ক্রেতাদের
‘মাঝেমধ্যে ভাবি, আইপিএল কি আদৌ ক্রিকেট’
‘মাঝেমধ্যে ভাবি, আইপিএল কি আদৌ ক্রিকেট’
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ