X
বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪
৩ বৈশাখ ১৪৩১

রাজনীতিতে হঠাৎ হেমন্তের কোমলতা!

প্রভাষ আমিন
৩০ অক্টোবর ২০১৮, ১৬:৪৭আপডেট : ৩০ অক্টোবর ২০১৮, ১৬:৪৮

প্রভাষ আমিন প্রকৃতিতে এখন হেমন্তের কোমলতা। বৈশাখের ঝড় নেই, জৈষ্ঠ্যের খরতাপ নেই, আষাঢ়ের দুর্ভোগ নেই, ভাদ্রের তালপাকা গরম নেই, মাঘের বাঘ পালানো শীত নেই। গরম গেছে, কোমল পায়ে শীত আসছে। কবির ভাষায়, ‘সকাল বেলা শিশির ভেজা/ ঘাসের ওপর চলতে গিয়ে/ হালকা মধুর শীতের ছোঁয়ায়/ শরীর ওঠে শিরশিরিয়ে।’
প্রকৃতিতে যখন এই মধুর শীতের ছোঁয়ার শুরু, তখন রাজনীতিতে বইছিল উল্টো হাওয়া। নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনীতির মাঠ গরম করার চেষ্টা করছিল নবগঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে সামনে রেখে বিএনপি। ৭ দফা দাবি আর ১১ দফা লক্ষ্য সামনে রেখে গত ১৩ অক্টোবর আত্মপ্রকাশ করা ঐক্যফ্রন্ট খুব দ্রুত মাঠে নেমে পড়ে। ইতিমধ্যে সিলেট ও চট্টগ্রামে দু’টি সমাবেশ করে ফেলে। এবার  রাজশাহী ও ঢাকায় সমাবেশের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ড. কামাল সামনে থাকলেও মাঠের কর্মসূচির মূল প্রযোজক বিএনপি। তাদের লক্ষ্য, সরকারকে চাপ দিয়ে দাবি আদায় করে নেওয়া। দুটি সমাবেশ ও বিভিন্ন আয়োজনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নেতারা বেশ কড়া ভাষায় সরকারকে হুমকি দিচ্ছিলেন। এরইমধ্যে রবিবার সন্ধ্যায় জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের দুটি চিঠি যায় আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর কার্যালয়ে। একটি ড. কামাল হোসেন লিখেছেন শেখ হাসিনা বরাবর। আরেকটি মোস্তফা মহসিন মন্টু লিখেছেন ওবায়দুল কাদেরকে।

ড. কামাল তার চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘ইতিবাচক রাজনীতি একটা জাতিকে কীভাবে ঐক্যবদ্ধ করে ন্যায়সঙ্গত অধিকারগুলো আদায়ের মূলশক্তিতে পরিণত করে, তা বঙ্গবন্ধু আমাদের শিখিয়েছেন। নেতিবাচক রুগ্ন রাজনীতি কীভাবে আমাদের জাতিকে বিভক্ত ও মহাসংকটের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। তাও আমাদের অজানা নয়। এই সংকট থেকে উত্তরণ ঘটানো আজ আমাদের জাতীয় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ৭ দফা দাবি ও ১১ দফা লক্ষ্য ঘোষণা করেছে। শান্তিপূর্ণ ও সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে সবার অংশগ্রহণ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সঙ্গে একটি অর্থবহ সংলাপের তাগিদ অনুভব করছে।  সেই লক্ষ্যে আপনার কার্যকর উদ্যোগ প্রত্যাশা করছি।’ এ ধরনের চিঠি লেখা নিয়েও দ্বিধা ছিল ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের। তবে তাদের ধারণা ছিল, এই চিঠির কোনও ইতিবাচক জবাব পাওয়া যাবে না। গত কয়েকদিনে আওয়ামী লীগের নেতা ও মন্ত্রীদের কড়া অবস্থানে তেমনটাই মনে হচ্ছিল। সে ক্ষেত্রে আন্দোলন আরও বেগবান করা যাবে। আওয়ামী লীগ সংলাপ চায় না, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চায় না; এই কথা বলে দেশে-বিদেশে আরও নালিশ দেওয়া যাবে। কিন্তু শেখ হাসিনা এক দুপুরেই উল্টে দিলেন সবকিছু। রবিবার রাত ৮টায় ড. কামাল হোসেনের চিঠি আওয়ামী লীগ অফিসে পৌঁছেছে। সোমবার দুপুরে মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে দলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে শেখ হাসিনা জানিয়ে দেন, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে সংলাপে তিনি বসবেন। বিকালে ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের ডেকে জাতির সামনে সেই ‘প্লেজেন্ট সারপ্রাইজ’ উপহার দেন। সাংবাদিকদের জানিয়েই ক্ষান্ত হননি তিনি। সন্ধ্যায়ই তিনি মোস্তফা মহসিন মন্টুকে ফোন করে প্রতিনিধিদলের নামের তালিকা চেয়েছেন এবং গণভবনে নৈশভোজের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। শেখ হাসিনা নাকি নৈশভোজে তারা কী খেতে চান, তাও জেনে নিতে বলেছেন। মঙ্গলবার সকালেই চিঠির জবাব নিয়ে ড. কামালের বাসায় গেছেন আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক আব্দুস সোবহান গোলাপ। সব ঠিক থাকলে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়ই গণভবনে সংলাপে বসতে পারে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট।

জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট যেখানে রাজনীতিতে ঝড় তোলার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, শেখ হাসিনা সেখানে পানি ঢেলে দিলেন। তার এক দুপুরের সিদ্ধান্তই পাল্টে দিলো রাজনীতির চিত্র। প্রকৃতির হেমন্তের  কোমলতাকে শেখ হাসিনা টেনে আনলেন রাজনীতিতে।

শেখ হাসিনা আবারও প্রমাণ করলেন রাজনীতি একটি কৌশলের খেলা এবং সেই খেলাটা তিনিই সবচেয়ে ভালো পারেন। গ্রেনেড মেরে এই খেলায় জেতা যায় না। জিততে হয় রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দিয়ে, রাজনৈতিক কৌশলেই। শেখ হাসিনার এক সিদ্ধান্তই ব্যাকফুটে ঠেলে দিয়েছে বিএনপি তথা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে। এমনকি যেদিন জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়ার ৭ বছর কারাদণ্ড হয়েছে, সেদিনই শেখ হাসিনার সংলাপের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাতে হয়েছে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদকে। তিনি যে কতটা অনিচ্ছায় শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানিয়েছেন, তা শুধু তিনিই জানেন। কিন্তু রাজনীতির চালে পিছিয়ে গিয়ে স্বাগত জানাতে হয়েছে।

রাজনীতির এই কৌশলের খেলায় বারবার হেরে গেছে বিএনপি।  ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনা সরাসরি ফোন করেছিলেন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়াকে। আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন গণভবনে। তাদের প্রস্তাব দিয়েছিলেন নির্বাচনকালীন সরকারে যোগ দেওয়ারও। তারা গণভবনে যাননি, সরকারে যোগ দেননি, নির্বাচনেও আসেননি। সেটা যে বিএনপির সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক ভুল, তা তারা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। ‘আমি তো টেলিফোন করেছিলাম, সরকারে যোগ দিতে বলেছিলাম; তারা আসেননি’—এই বক্তব্যে শক্ত অবস্থান নিয়ে শেখ হাসিনা ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন করে ফেলেন। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মান নিয়ে প্রশ্ন আছে, কিন্তু সেই নির্বাচনে গঠিত সরকারই কিন্তু মেয়াদ পূর্তি করেছে। ৫ বছর আগে পরিস্থিতি যা ছিল, এখনও পরিস্থিতি তাই আছে এবং বিএনপি সম্ভবত শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচনে যাচ্ছে। মাঝখানে এই ৫ বছরে ২০১৪-১৫ সালের দুই দফা আন্দোলনের নামে পেট্রোল সন্ত্রাস করে বিএনপি মানুষের নিন্দা কুড়িয়েছে, নেতাকর্মীরা মামলা-হামলায় জর্জরিত, খালেদা জিয়া তখন ছিলেন বিরোধী দলীয় নেত্রী, আর এখন তিনি দুর্নীতির মামলার সাজা নিয়ে কারাগারে থাকা একজন আসামি মাত্র। আজ যখন সংলাপ হচ্ছে; তখন বিএনপি অপ্রাসঙ্গিক, খালেদা জিয়া কারাগারে, তারেক রহমান তো আলোচনায়ই নেই। অথচ ৫ বছর আগে প্রধানমন্ত্রীর ডাকে সাড়া দিলে পরিস্থিতি অন্যরকম হতে পারতো। এটাই রাজনীতির কৌশল। এখানেই বারবার জিতে যান শেখ হাসিনা।

২০১৪ সালের নির্বাচনের পরও আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুর পর খালেদা জিয়াকে সান্ত্বনা জানাতে গুলশানে ছুটে গিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। ধরে নিচ্ছি, এটাও তার রাজনীতির কৌশলেরই ‘খেলা’। কিন্তু সে ‘খেলায়’ও তিনিই জিতেছেন। কারণ প্রধানমন্ত্রীর জন্য দরজা খোলার ভদ্রতা দেখানোর মতো বিএনপির কেউ ছিলেন না সেখানে। কদিন আগেও শেখ হাসিনা বলেছেন, যারা টেলিফোনে আমার সঙ্গে অভব্য আচরণ করে, যারা আমার মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দেয়, যারা গ্রেনেড মেরে আমাকে নিশ্চিহ্ন করতে চায়, যারা আগুন সন্ত্রাস চালায়, জঙ্গিদের প্রশ্রয় দেয়; তাদের সঙ্গে সংলাপ নয়। শেখ হাসিনা তার অবস্থান থেকে সরেননি। তিনি ড. কামাল হোসেনের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে সংলাপ করবেন। বিএনপি হয়তো এই সংলাপে আসবে, তবে ঐক্যফ্রন্টের লেজুড় হিসেবে। ৫ বছরে এই হলো বিএনপির অর্জন!

জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ৭ দফা দাবি নিয়ে সংলাপে যাবে। আর আওয়ামী লীগ কোনও শর্ত ছাড়াই তাদের সংলাপে ডেকেছে। ১৮ ঘণ্টার মধ্যে সংলাপের সিদ্ধান্ত নিয়ে শেখ হাসিনা সবাইকে চমকে দিয়েছেন। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সব পরিকল্পনা লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। আমার ধারণা সংলাপের টেবিলের জন্য আরও কিছু চমক তুলে রেখেছেন শেখ হাসিনা। এতদিন ওবায়দুল কাদেরসহ একাধিক মন্ত্রী বারবার বলছিলেন, ঐক্যফ্রন্টের ৭ দফা অসাংবিধানিক, একটিও মানা হবে না। আমার ধারণা, শেখ হাসিনা অত অযৌক্তিক হবেন না। চাইলে ৭ দফার ৫টি পুরো, দুটি আংশিক মেনে নেওয়া সম্ভব। এমনকি সংসদে প্রতিনিধিত্ব না থাকা সত্ত্বেও ঐক্যফ্রন্টের কয়েকজনকে টেকনোক্র্যাট কোটায় নির্বাচনকালীন সরকারে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণও জানাতে পারেন। তেমন যদি হয়, তাহলে বিদ্যমান ব্যবস্থায় শেখ হাসিনার সরকারের অধীনেই নির্বাচনে যেতে হবে ঐক্যফ্রন্টকে। সরকার আন্তরিক নয়, এ কথা বলার সুযোগ থাকবে না আর। বেশিরভাগ দাবিই মেনে নিলে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আর না বলার সুযোগ থাকবে না। তাতে নিশ্চিত হয়ে যাবে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। দেশি-বিদেশি সব মহলের চাওয়া অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। তবে সে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ হবে কিনা, তা জানতে অপেক্ষা করতে হবে ভোটগ্রহণের দিনপর্যন্ত। তখন দেশি-বিদেশি গণমাধ্যম, পর্যবেক্ষকরা কঠোর নজরদারি বজায় রেখে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে ভূমিকা রাখতে পারেন।

শেখ হাসিনার এক চমকেই রাজনীতিতে যে হেমন্তের কোমলতা, যে স্বস্তির সুবাতাস; তা বইতে থাকুক নির্বাচন বা তারও পর পর্যন্ত।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

 

/এসএএস/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সুনামগঞ্জে বজ্রপাতে দুই কৃষকের মৃত্যু
সুনামগঞ্জে বজ্রপাতে দুই কৃষকের মৃত্যু
ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস আজ
ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস আজ
অপরাধে জড়িয়ে পড়া শিশু-কিশোরদের সংশোধনের উপায় কী
অপরাধে জড়িয়ে পড়া শিশু-কিশোরদের সংশোধনের উপায় কী
লেবাননে এক হিজবুল্লাহ কমান্ডারকে হত্যার দাবি ইসরায়েলের
লেবাননে এক হিজবুল্লাহ কমান্ডারকে হত্যার দাবি ইসরায়েলের
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ