X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সবকিছু ‘চরিত্রহীনদের’ জিম্মায় যাবে!

আহসান কবির
০২ নভেম্বর ২০১৮, ১৬:২৫আপডেট : ০২ নভেম্বর ২০১৮, ১৬:২৭

আহসান কবির ‘চরিত্রহীন’ শব্দটা লিখলেই দেশের মানুষ ইদানীং ভাবে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন ও মাসুদা ভাট্টিকে নিয়ে কিছু লেখা হচ্ছে। কিন্তু চরিত্রহীন নিয়ে আলাদা গল্পও আছে। যেমন, জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে জিজ্ঞাসা করা হতো আপনি কি শরৎচন্দ্র?
-হ্যাঁ।

-কোন শরৎচন্দ্র?

-‘চরিত্রহীন’ শরৎচন্দ্র!

আসলে শরৎচন্দ্রের সমসাময়িককালে আরও একজন লেখালেখি শুরু করেছিলেন, যার নামও ছিল শরৎচন্দ্র। তারও বই বের হয়েছিল। এ কারণে ‘দেবদাস’ বা ‘চরিত্রহীন’ উপন্যাসের লেখক শরৎচন্দ্র ‘শ্রী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়’ নামে লিখতেন, বইয়ের সঙ্গে তার একটা ছবিও থাকতো (ব্যাপারটা অনেকটা এমন- আমিই আসল, আদি ও অকৃত্রিম শরৎ। আমার কোথাও কোনও শাখা নেই)। তবে অন্য শরৎচন্দ্রকে মানুষ তেমন মনে রাখেনি। কেউ আসল শরৎচন্দ্রকে কৌতুক করে জিজ্ঞাসা করলে তিনি উত্তর দিতেন, আমি ‘চরিত্রহীন শরৎচন্দ্র’।

দেবদাস লিখে প্রেমকে তিনি অন্য কোথাও নিয়ে গিয়েছিলেন। প্রেমিকাকে হারানোর আগে স্মৃতি হিসেবে বড়শির লাঠি দিয়ে মেরে কপাল কেটে দেওয়া (এই ধারাবাহিকতায় কেউ কেউ কি এসিড ছুড়ে মারে?) কিংবা প্রেমিকাকে হারানোর পর মদ খেতে খেতে নিজেকে শেষ করে ফেলার এই ট্রেন্ডের নাম হয়ে গেছে ‘দেবদাস সিনড্রোম’। (দেবদাসকে নিয়ে অনেক গান লেখা হয়েছে। যেমন-ভালোবাসা বেশি হলে খুন হয়ে যেতে হয়/দেবদাস বড় খুনি নিজ খুনে মেতে রয়/চন্দ্রমুখীর নাচে ভাবে জীবন পার্বতীময়)।

বাঙালি আবার মদ খাবার ব্যাপারটাকে চরিত্রহীনতার পর্যায়ে ফেলে। লেখক হুমায়ুন আজাদ লিখেছিলেন-বাঙালি পুরুষের চরিত্র নির্ণয়ের চলমান মাপকাঠি প্রধানত দুটো। সে মদপান করে কিনা আর অন্য নারীতে আসক্ত কিনা (সুদ ঘুষ খাওয়া, চাকরিতে উপরি নেওয়া, দেশবিরোধী কাজ করা, রাস্তায় চাকার নিচে ফেলে মানুষ মারাসহ বাকি সবকিছু যেন বৈধ)। যাই হোক আমরা চরিত্রহীন বিষয় নিয়েই থাকি।

যে কেউ চরিত্রহীন লিখে গুগলে সার্চ দিতে পারেন। দেখবেন চলে আসবে চরিত্রহীন নামের ওয়েব সিরিজ। মজার ব্যাপার হচ্ছে এই ওয়েব সিরিজের কাহিনিও শরৎচন্দ্রের উপন্যাস থেকে নেওয়া। খোলামেলা দৃশ্য আর যৌনতার কারণে এই ওয়েব সিরিজ নিয়ে তুমুল বিতর্ক শুরু হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতে। দৃশ্যায়নের সঙ্গে ডায়ালগও কেমন যেন। যেমন- আমাকে নিয়ে নেশা করো অথবা একটি একটি করে চুমু খাবে আর নিভে যাবে এক এক করে সব লাইট। এরপরের ডায়ালগে আর না যাই। পাঠকরা বলে দিতে পারেন-‘ওই সইরা খাড়ান’!

কাভার্ড ভ্যান বা ট্রাকের চরিত্র কেমন? রাস্তায় নামলে তাদের স্বভাব যেন ‘সইরা খাড়া সইরা খাড়া’তে রূপান্তরিত হয়। রাস্তা যেন বাস-মিনিবাস, ট্রাক আর কাভার্ড ভ্যানের। পথচারী বা যাত্রী সেখানে গরু ছাগল! সইরা খাড়াইলেও এইসব আইসা গায়ের ওপর ওঠে কিংবা দুই বাসের চিপায় ফেলাইয়া মানুষ মারে। বাস-ট্রাকের পেছনে তাই লেখা থাকে  ok।  মানে নাকি-‘original killer’! কেন এরা অরিজিনাল কিলার হলো? আসলে যারা এসব চালায় তাদের চরিত্রের ওপর নির্ভর করে ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, বাস আর মিনিবাসের রাস্তার চরিত্র কেমন হবে। বাস কিংবা মিনিবাসের ভেতরের চরিত্র আর বাইরের চরিত্র বিপরীতমুখী। বাসের ভেতরে লেখা থাকে- ব্যবহারে বংশের পরিচয়। লেখা থাকে- ‘থুথু বাহির হাত ভেতর’।  কিংবা ‘৫০০-১০০০ টাকার নোটের ভাংতি নেই’। বাসের বাইরে লেখা থাকে ‘আপনার সন্তানকে স্কুলে পাঠান’। এসব বাসের বাইরের চরিত্রটা সর্বগ্রাসী। শুধু দুর্ঘটনা ঘটিয়েই ক্ষান্ত হয় না। সাধারণ মানুষকে নিদারুণ ভোগান্তিতে ফেলে, জিম্মি করে রাখার চরিত্রটাই বাস শ্রমিক-মালিকদের আসল চেহারা, মূল চরিত্র।

ঢাকার রাস্তায় এবং ঢাকাসহ সারাদেশে যেসব বাস মিনিবাস চলে তাদের মালিক কারা? এককথায় প্রভাবশালী কিংবা ক্ষমতাসীন দলের নেতারাই এসব বাস মিনিবাস বা পরিবহনের মালিক।  জাতীয় পার্টি, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীর নেতারাও জড়িয়ে আছেন এই ব্যবসায়।  আসলে ক্ষমতা যাদের বাস মিনিবাসও তাদের। পাবলিক জিম্মি। ‘শিখর’ পরিবহন উদ্বোধন করেছিলেন মন্ত্রী শাজাহান খানের স্ত্রী সৈয়দা রোকেয়া বেগম। এই পরিবহনের মালিক মাহমুদ হোসেন এবং তার সাথে আছেন সাবেক জাতীয় পার্টি নেতা মাইজুদ্দিন। ঢাকা-মাদারীপুর রুটের ‘সার্বিক’ পরিবহনের মালিকানা মন্ত্রী শাজাহান খানের পরিবারের। ‘কনক’ পরিবহনের মালিক শাজাহান খানের ভাই আজিজুর রহমান। ‘জাবালে নুর’ পরিবহনে বাস আছে শাজাহান খানের শ্যালক নান্নু মিঞার।

সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি মশিউর রহমান রাঙ্গা এমপিও একটি পরিবহনের মালিক।  রাঙ্গা সাহেবের মতো জাতীয় পার্টির আরেক নেতা সালাহউদ্দীন আহমেদ ‘এসএ’ পরিবহনের মালিক। বিএনপি নেতা জিএম সিরাজ ‘এসআর’ পরিবহনের মালিক। খালেক এন্টারপ্রাইজের মালিক বিএনপি নেতা এস এ খালেক। বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাসের পরিবহন ব্যবসা রয়েছে। আওয়ামী লীগের এমপি শাহিদা তারিকের পরিবহনের নাম ‘প্রজাপতি’ পরিবহন। পরিবহন ব্যবসা রয়েছে খলনায়ক ও বিএনপি নেতা ডিপজলের। জামায়াত নেতা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ড কার্যকর হওয়া মতিউর রহমান নিজামীর ছিল ‘আজমেরি’ পরিবহন।  

তাহলে ঢাকা বা বাংলাদেশের রাস্তায় চলাচলকারী বাস মিনিবাসের আসল চরিত্রটা কেমন? নিয়ম না মেনে বেপরোয়া চালানো, চালকের বৈধ লাইসেন্স না থাকা, বাস মিনিবাসের ফিটনেস না থাকা, গাড়ি চালানোর সময়ে নিয়ম না মানা ইত্যাদি। শ্রমিকরা সীমাহীন বিশৃঙ্খলা তৈরি করেন পথে, মালিকরা তাদের মাথায় হাত বোলান। গাড়ির নিচে ফেলে মানুষ মেরে ফেললেও যেন তারা শাস্তি না পান সেটাই চান। চান জরিমানার বিধান না থাকুক, শাস্তি কম হোক, দুর্ঘটনা তদন্তে শ্রমিক প্রতিনিধি থাকুক আর ক্লাস ফাইভ পাসের সনদ দিয়ে যেন চালকরা ড্রাইভিং লাইসেন্স পান। শ্রমিক সমিতি আর মালিক সমিতির নামে প্রতিদিন যে চাঁদা ওঠে তার ভাগ কারা কেমন করে নিয়ে যায় সে গল্প মানুষের অজানাই থাকে। যাদের কাছে বিচার চাওয়ার কথা সেই নেতা মন্ত্রীরাই পরিবহন ব্যবসাটাকে নিয়ন্ত্রণ করেন, পরিবহন ব্যবসাটাকে মানুষের কল্যাণমুখী করার চেয়ে তারা ক্ষমতামুখী করে রাখতেই পছন্দ করেন। বাস মিনিবাসের চালকদের মতো নিয়ন্ত্রকদের চরিত্রও একই রকম। নিয়ন্ত্রকরা আইন করে আবার শ্রমিকদের দিয়ে ধর্মঘটও করায়।

পাবলিকের জন্য ভোগান্তি, প্রিয়তম নবজাতকের মৃত্যু কিংবা কাপড়ে ও মুখে পোড়া মোবিল মাখানোটাই প্রাপ্তি। যেমন খুশি তেমন চালানোর দেশ বাংলাদেশ! ‘সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে’র মতো সবকিছু ‘চরিত্রহীনদের’ জিম্মায় যাবে!

তবে সব ‘চরিত্রহীনদে’র জন্য রাষ্ট্রের এক বিচার হয় না। কোন কোন চরিত্রহীনরা বহাল তবিয়তে থাকে। কখনও সখনও এক দুইজন চরিত্রহীন জেলে যেতে বাধ্য হয়! শেষমেশ পাকিস্তানের দুই চরিত্রহীনের গল্প শুনে বিদায় নেই। প্রথম চরিত্রহীনের নাম ‘মাহমুদ’। সে পেশায় শ্রমিক। এক নারীর সাথে তার অবৈধ সম্পর্ক ছিল। ধরা পড়ার পর মাহমুদ ও তার প্রেমিকাকে খুঁটির সাথে বাঁধা হয়। পরে পাথর ছুড়ে মেরে ফেলা হয়।

পরের চরিত্রহীনের নামও মাহমুদ। আফগান সীমান্তের কাছে এক গোত্রের প্রধান সে। স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে থাকা সত্ত্বেও তার প্রেম হলো অল্পবয়সী এক মেয়ের সাথে। প্রেম লুকিয়ে রাখা যায় না। সারা গ্রাম রাষ্ট্র হয়ে গেল। গ্রামবাসীর সামনে বিচার বসলো। বিচারে মাহমুদের শাস্তি হলো প্রেমিকাকে বিয়ে করার! বিচারক আর গ্রামবাসী মাহমুদ আর তার প্রেমিকার বিয়ে খেয়ে ঘরে ফিরলো!

লেখক: রম্য লেখক

 

/ওএমএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
প্রতিবন্ধী শিল্পীদের আয়োজনে মঞ্চস্থ হলো ‘সার্কাস সার্কাস’ নাটক
প্রতিবন্ধী শিল্পীদের আয়োজনে মঞ্চস্থ হলো ‘সার্কাস সার্কাস’ নাটক
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ