X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

নূর হোসেন দিবসে গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা

প্রভাষ আমিন
১০ নভেম্বর ২০১৮, ১৩:৫২আপডেট : ১০ নভেম্বর ২০১৮, ১৬:৩৫

প্রভাষ আমিন ১৯৮৭ সালের উত্তাল নভেম্বরে আমি কুমিল্লায় ছিলাম। ১০ নভেম্বর সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচিতে যোগ দিতে আমারও ঢাকা আসার কথা ছিল। জরুরি কাজে আটকে যাওয়ায় আসতে পারিনি। তবে সহযোদ্ধাদের বিদায় দিতে রাতে কুমিল্লা রেল স্টেশনে গিয়েছিলাম। সেদিন ঢাকা আসাটাও এক যুদ্ধ ছিল। পুরো স্টেশন ঘিরে রেখেছিল পুলিশ। অবস্থা দেখে আমরা সবাই স্টেশনের আগে পিছে রেললাইনের পাশে অন্ধকারে ঘাঁপটি মেরে লুকিয়ে ছিলাম। যখনই ট্রেন ছাড়ার হুইসেল বাজে, তখনই সবাই অসহায় পুলিশের চোখের সামনে দিয়ে ট্রেনে চড়ে বসে। তাদের নিরাপদে বিদায় করে ফিরি টমছমব্রিজের নিউ হোস্টেলে।
পরদিন কুমিল্লায় কর্মসূচি পালন করতে নেমেছিলেন যুবলীগকর্মী নূর হোসেন। শেখ হাসিনা তাকে সাবধান থাকতে বলেছিলেন। কারও শঙ্কা পাত্তা না দিয়ে মাঠে নেমে জীবন দিয়েছিলেন  নূর হোসেন। ১৯৮৭ সালে না হলেও নূর হোসেনদের দেখানো পথ ধরে ১৯৯০ সালে নিপাত যায় স্বৈরাচার, মুক্তি পায় গণতন্ত্র। কিন্তু ৩১ বছর পরে এসে আজ নিজের মনেই নিজের প্রশ্ন–সত্যিই কি মুক্তি পেয়েছে গণতন্ত্র?
এখনও রাজপথে গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন, ভোটাধিকারের জন্য সংগ্রাম, নির্বাচনি ব্যবস্থা নিয়ে অনাস্থা, নির্বাচন নিয়ে সংশয়–আমাদের বেদনার্ত করে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ৮ দলীয় জোট আর বিএনপি নেতৃত্বাধীন ৭ দলীয় জোটের যুগপৎ আন্দোলনে পতন ঘটেছিল প্রবল স্বৈরাচার এরশাদের। আমরা ভেবেছিলাম গণতন্ত্র পেয়ে গেছি, আমাদের আর ভাবনা নেই। কিন্তু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দুই প্রধান দলের মধ্য অবিশ্বাস, অনাস্থা ক্রমশ বাড়তে থাকে। দুই দলের অবস্থান এখন দুই মেরুতে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা করে বিএনপি সেই দূরত্বকে অলঙ্ঘনীয় করে ফেলেছে।

তবে আশার কথা হলো, সরাসরি দুই দল এক না হলেও দুই পক্ষে সংলাপ হয়েছে। কোনও পক্ষই আলোচনাকে ব্যর্থ বলে নাকচ করে দেননি। নিভু নিভু হলেও সমঝোতার আশার বাতি এখনও জ্বলছে। সময় খুবই কম। জাতি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য।

দুই প্রধান দলের অবিশ্বাস-অনাস্থার ফাঁক গলে গণতন্ত্রের লেবাস ধরে স্বৈরাচার এরশাদ মিশে গেছেন রাজনীতির মূলধারায়। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর কেউ কি ভেবেছিলেন, এরশাদ এমপি হবেন, রাজনীতি করবেন, মন্ত্রীর পদমর্যাদা পাবেন? পতনের পরের পাঁচ বছরই এরশাদ কারাগারে ছিলেন। এরপর আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করে মুক্তি পান। মুক্তি পেয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে মাঠে নামতে সময় নেননি। বিএনপির সঙ্গে মিলে চারদলীয় জোট করে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে। এভাবে শোচনীয় পতনের বছর সাতেকের মধ্যে এরশাদ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সঙ্গে জোট বেঁধে নিজেকে জায়েজ করে নিয়েছেন।

স্বৈরাচার এরশাদ আজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার  বিশেষ দূত। তার দল জাতীয় পার্টি আজ সংসদে প্রধান বিরোধী দল। এরশাদ মাঝে মধ্যে মোচড় দেওয়ার চেষ্টা করলেও মঞ্জুর হত্যা মামলার তারিখ দিলেই এরশাদ আবার ‘পোষ’ মেনে যান।  এরশাদ আর কখনও জেলে যেতে চান না, তাই থাকতে চান ক্ষমতার সঙ্গে। এরশাদকে সঙ্গে নিয়ে রাজনীতি করতে, জোট করতে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেওয়া আওয়ামী লীগ-বিএনপি নেতাদের কেমন লাগে জানি না; দেখতে আমাদের খুব লজ্জা লাগে। তেমন একটি দৃশ্য এখনও চোখে ভাসে। সম্ভবত ১৯৯৯ সাল। চারদলীয় জোটের শীর্ষ নেতাদের বৈঠক হবে ২৯ মিন্টো রোডে বিরোধী দলীয় নেতার সরকারি বাসভবনে। ভোরের কাগজের রিপোর্টার হিসেবে আমার তখন সেখানে এসাইনমেন্ট ছিল। একে একে নেতারা আসছেন। এরশাদের গাড়ি আসছে শুনে উপস্থিত নেতাকর্মীদের মধ্যে চাঞ্চল্য। সবাই অপেক্ষা করছেন। হঠাৎ আমানউল্লাহ আমান ছুটে গেলেন এরশাদকে মূল ফটকেই রিসিভ করতে। তারপর স্বৈরাচার এরশাদের গাড়ির সঙ্গে হেঁটে আসেন স্বৈরাচারবিরোধী সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক আমানউল্লাহ আমান। আমান ভাই হয়তো জানতেও পারবেন না, শুধু বিরোধী দলীয় নেতার বাসভবনের ফুল বাগান নয়; তিনি সেদিন তছনছ করে দিয়েছিলেন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের মিছিলে তার সঙ্গে পা মেলানো এক কর্মীর হৃদয়ও।

আমি জানি, এরশাদকে নিয়ে আওয়ামী লীগেও এমন অনেক নাটক হয়েছে। এখানেই এরশাদের সাফল্য। এরশাদের বিরুদ্ধে সংবিধান লঙ্ঘনের সবচেয়ে জরুরি মামলাটি করেছিলেন জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু। আজ তিনিও এরশাদের মহাজোটসঙ্গী।

রাজনীতিতে আসলেই শেষ কথা বলে কিছু নেই।

ভোটের অঙ্কের হিসাবে স্বৈরাচার আজ আওয়ামী লীগের জোটসঙ্গী। যেমন রাজাকার জামায়াতে ইসলামী বিএনপির জোটসঙ্গী। নূর হোসেনের বুকে-পিঠের দুটি স্লোগানই ভুল বানানে লেখা। আমরা কি তাহলে ভুল আন্দোলনে অপচয় করেছি আমাদের উজ্জ্বল যৌবন? যতবার প্রশ্ন করি, ততবারই জবাব পাই– না। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন আমাদের যৌবনকে মহিমান্বিত করেছে। রাজনীতিবিদদের আপসের চোরাবালিতে হয়তো হারাতে বসেছে আমাদের মহৎ অর্জন। কিন্তু তাতে অর্জনের মাহাত্ম্য ম্লান হয় না। খেটে খাওয়া যুবক নূর হোসেনের কাছে বানানটা মূখ্য ছিল না, মুখ্য ছিল স্বৈরাচারের নিপাত, গণতন্ত্রের মুক্তি। কিন্তু বিশ্ব বেহায়া এরশাদ যখন আজ ১০ নভেম্বর পালন করে ‘গণতন্ত্র দিবস’ হিসেবে, তখন বুঝি গণতন্ত্র আজও মুক্তির জন্য ডানা ঝাপটায়। নূর হোসেনের আত্মা কি একটু কষ্ট পায়?

নূর হোসেন দিবসে ভোটাধিকারের জন্য আমাদের আকাঙ্ক্ষা, গণতন্ত্রের জন্য আমাদের তৃষ্ণা আরও বাড়ে। আমরা চাই, সংলাপের ধারাবাহিকতায় জটিলতা মিটে যাক, সব দল নির্বাচনে অংশ নিক। উন্নয়নের যে ধারা, তা আরও বেগবান হোক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

/এসএএস/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
রবিবার থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলছে, শনিবারও ক্লাস চলবে
রবিবার থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলছে, শনিবারও ক্লাস চলবে
অবৈধ ব্যবহারকারীদের ধরতে বাড়ি বাড়ি যাবে তিতাস
অবৈধ ব্যবহারকারীদের ধরতে বাড়ি বাড়ি যাবে তিতাস
ছক্কায় মুশফিকের ‘আউট’ নিয়ে যা বললেন রনি
ছক্কায় মুশফিকের ‘আউট’ নিয়ে যা বললেন রনি
ফাইনালে ১১ মিনিট লড়াই, জব্বারের বলী খেলায় চ্যাম্পিয়ন বাঘা শরীফ
ফাইনালে ১১ মিনিট লড়াই, জব্বারের বলী খেলায় চ্যাম্পিয়ন বাঘা শরীফ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ