X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মি টু: প্রশ্ন ও পরিণতি

আমীন আল রশীদ
১১ নভেম্বর ২০১৮, ১৫:০০আপডেট : ১১ নভেম্বর ২০১৮, ১৫:০৪

আমীন আল রশীদ ভারতে যখন হ্যাশট্যাগ মি টু (আমিও) আন্দোলনটা ছড়িয়ে পড়লো তখন থেকেই দোটানায় ছিলাম এ নিয়ে কিছু লিখব কি লিখবো না। কারণ, বিষয়টা এতই স্পর্শকাতর এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, বিশেষ করে ফেসবুক এখন এমন এক বিপজ্জনক প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়েছে যে, কোন কথাকে কে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন বা বুঝবেন—সেটি অনেক সময় আন্দাজ করাও যায় না।
সেই ঝুঁকি বিবেচনায় রেখেই মি টু নিয়ে এই ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ। কারণ, এরইমধ্যে যাদের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ তোলা হয়েছে তার মধ্যে আছেন গণমাধ্যমকর্মী, ব্যবসায়ী এবং প্রকাশকও। তারা সবাই অত্যন্ত পরিচিত মুখ। ফলে এখন আমাদের প্রতিনিয়িত আতঙ্কে থাকতে হয়, এরপর কার নাম আসবে?
আতঙ্ক বলছি এ কারণে যে, যার বা যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসছে, সেগুলো প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত তাকে অপরাধী বলার সুযোগ নেই। কিন্তু ফেসবুকে তার সম্পর্কে লিখে এবং কখনও তার ছবি প্রকাশ করে দেওয়ার মধ্য দিয়ে সামাজিকভাবে তার একটা বিচার সম্পন্ন করা হচ্ছে। ধরে নিচ্ছি, যিনি অভিযোগ করছেন, তিনি সত্যই বলছেন। কারণ, একজন নারী ভিকটিম না হলে কোনও পুরুষের বিরুদ্ধে আর যাই হোক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অভিযোগ করেন না। কারণ, তার নিজেরও সামাজিক মর্যাদার বিষয় রয়েছে। ফলে আমরা আতঙ্কিত এ কারণে যে, না জানি আরও কার কার নাম ও ছবি এই মি টু’র তালিকায় আসে।

পক্ষান্তরে এমন অভিযোগও আছে, কেউ কেউ প্রতিষ্ঠিত হতে বা ক্যারিয়ারে সফল হতে স্বেচ্ছায় ও সজ্ঞানে এমন পরিস্থিতি তৈরি করেন, যাতে অভিযুক্ত তার শরীরে হাত দেওয়ার স্পর্ধা পায়। সে রকম কেউ কি ‘মি টু’ লিখে নিজের অভিজ্ঞতা জানাবেন? সেরকম হলেও অভিযুক্তের মুক্তি নেই। কারণ, যদি সেরকম হয়েও থাকে, তাহলেও অভিযুক্ত কখনও এটা স্বীকার করবেন না যে তিনি সুযোগ পেয়েছিলেন বা সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল বলে ওই নারীর শরীরে হাত দিয়েছিলেন। কারণ, তাহলেও তিনি অপরাধী সাব্যস্ত হবেন। ফলে যিনি একবার অভিযুক্ত হয়ে যাচ্ছেন বা মি টু হ্যাশট্যাগে পড়ে যাচ্ছেন, তার পক্ষে এই বৃত্ত থেকে বেরিয়ে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করা খুব কঠিন। আবার নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে গেলেও এই ইস্যুতে তাকে বারবার এমন সব কথাবার্তা এবং প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে যে, সেটিও তার জন্য খুব সম্মানজনক বা সুখকর হবে না। ফলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একবার কারও নাম প্রকাশিত হয়ে যাওয়ার অর্থই হলো তিনি দণ্ডিত হয়ে গেলেন। তার অপরাধের মাত্রা যাই থাক, যে পরিস্থিতিতেই তিনি অপরাধটা করে থাকুন না কেন, পুরো দায়ভারই তাকে নিতে হচ্ছে।

এ কথার অর্থ এই নয় যে যারা এরইমধ্যে মি টু হ্যাশট্যাগে অভিযুক্ত হয়েছেন, আমি তাদের পক্ষ নিচ্ছি। বরং বলতে চাইছি, কেউ যেন অবিচারের শিকার না হন। কারণ, কেউ একজন অভিযোগ করলেই তিনি অপরাধী হয়ে যান কিনা, সেই প্রশ্নটি বহু পুরনো। যে কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যখন কাউকে ধরে এনে গায়ে জঙ্গি, ডাকাত, সন্ত্রাসী, মাদক পাচারকারী ইত্যাদি ট্যাগ লাগিয়ে গণমাধ্যমের সামনে হাজির করে এবং আদালতে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগেই একধরনের মিডিয়া ট্রায়াল করে দেয়—এই প্রবণতা ও প্রক্রিয়ার যেমন অ্যাকাডেমিক সমালোচনা আছে, মি টু হ্যাশট্যাগের ক্ষেত্রেও এই প্রশ্নটি খাটে যে এর মাধ্যমে বিনা বিচারে কাউকে সাজা দেওয়া হচ্ছে কিনা?

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক তপন মাহমুদ কয়েক দিন আগে বাংলা ট্রিবিউনেই লিখেছিলেন, ‘মি-টু ঝড়: ভয় পাচ্ছেন?’ আসলেই ভয় পাচ্ছি। আসলেই ভয় পাচ্ছেন সবাই। কারণ, কেউই চায় না তার পরিচিত মুখের মুখোশ খুলে যাক। বিশেষ করে যৌন হয়রানির মতো লজ্জাজনক অভিযোগে কারো বন্ধু, সহকর্মী, বস কিংবা আত্মীয়-পরিজন অভিযুক্ত হোক, সেটি কেউই চায় না। চায় না এ কারণে যে, এই ঘটনার মধ্য দিয়ে কেবল একজন পুরুষই অভিযুক্ত হয় না, বরং সেই পুরুষের যদি সংসার থাকে, সেই সংসারও ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হয়। তিনি যদি কোনও বড় প্রতিষ্ঠানের বড় পদেও থাকেন, সেখানে তার চাকরি নিয়ে টানাটানি শুরু হয়। শুধু তা-ই নয়, সামাজিকভাবেও তিনি একঘরে হয়ে পড়েন। ফলে যৌন হয়রানির দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তির অপরাধের মাত্রা যাই হোক কিংবা তিনি যদি প্রতিহিংসারও শিকার হয়ে থাকেন, তারপরও যা হওয়ার তারই হবে। অতএব, ভয় পাওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে বৈকি। 

ভারতে একাধিক তারকা ও প্রভাবশালী ব্যক্তির বিরুদ্ধে মি টুর অভিযোগ ওঠার পর একসময়ের প্রভাবশালী সাংবাদিক এবং পরে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এম জে আকবর পদত্যাগও করেছেন। প্রশ্ন হলো, এরকম যৌন হয়রানি কি শুধু প্রভাবশালী ও তারকারাই করেন? নিশ্চয়ই না। বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীরা এসব অভিযোগ করতে চান না। এটা তার ব্যক্তিগত সঙ্কোচ, তার সামাজিক পরিচয় এবং পরিবার ও শুভানুধ্যায়ীদের তরফে চেপে যাওয়ার পরামর্শের কারণে অনেক ভুক্তভোগী অভিযোগ করেন না। বিবিসিকে একজন ভুক্তভোগী নারী বলেছেন, ‘আমিও চাইলেই আমার বিষয়টাকে সামনে আনতে পারি। কিন্তু এতে জল ঘোলা হওয়া ছাড়া আর কিছুই হবে না। আমরা এই আন্দোলনের জন্য আসলে প্রস্তুত না। কারণ, এখনও এ দেশে আন্দোলনের শুরুটা অনেক সুন্দর দেখায়, তারপর এটার মিসইউজ হয়।’

আমাদের দেশে কর্মক্ষেত্রে নারীদের যৌন হয়রানি খুব পুরনো। অনেক সময় দেখা যায়, মিটিং ও সেমিনারের নামে নারী সহকর্মীকে সাথে নিয়ে ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিদের বিদেশ ভ্রমণ এবং নানা ছুতোয় কাছে যাওয়া এবং শরীর স্পর্শ করার মতো ঘটনার শিকার হয়েছেন কত শত নারী—সেটি যদি তারা লেখা শুরু করেন, অসংখ্য ‘মহামানবের’ মুখোশ খুলে যাবে। পক্ষান্তরে এরকম অভিযোগও আছে যে, প্রতিষ্ঠানের বস কিংবা সিনিয়র সহকর্মীর কাছ থেকে হয়রানির শিকার হয়ে তার প্রতিকার চেয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে বিচার চেয়েও ন্যায় বিচার পাননি অগণিত নারী।

আমরাও অনেককে চিনি যারা তাদের সিনিয়র সহকর্মীদের দ্বারা নানাভাবে হয়রানির শিকার হয়েছেন। বিশেষ করে বিনোদন জগতের অবস্থা আরও ভয়ঙ্কর। টেলিভিশনের অপরাধবিষয়ক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এরইমধ্যে এসব ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। যৌন হয়রানি বা হেনস্তার কারণে গণমাধ্যমের অনেক নারী চাকরিও ছেড়ে দেন কিংবা প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন করেন। কিন্তু তারা যতদিন এই পেশায় আছেন, হয়তো অভিযোগ করবেন না।

কিন্তু তারপরও এই মি টুর একটি ইতিবাচক দিক হলো, তপন মাহমুদের ভাষায় ‘ভয় পাচ্ছি’ মানে সবাই ভয় পাচ্ছেন। পাচ্ছেন বলেই এখন যেকোনও পুরুষ তার নারী সহকর্মী কিংবা অধস্তন অথবা পরিচিতর শরীরে হাত দেওয়ার আগে দশবার ভাববেন। রাতে ফুটপাতে বাসের জন্য অপেক্ষমাণ কোনও পরিচিত নারীকে দেখে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে ব্যক্তিগত বা অফিসের গাড়িতে তুলে তার শরীরে হাত দেওয়ার আগে দশবার ভাববেন এ কারণে যে, এখন ওই নারী সামাজিক চক্ষুলজ্জায় এ নিয়ে এখন কোনও প্রতিবাদ না করলেও ১০ বছর পরে হলেও হয়তো ওই বাড়ি পৌঁছে দেওয়া ‘মহামানব’ মি টুতে ফেঁসে যাবেন। ফলে যে সাহসীরা অনেক বছর পরে হলেও নিজেদের যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার অভিজ্ঞতার কথা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তুলে ধরছেন, তাদের ধন্যবাদ। তবে কেউ যেন অবিচার বা প্রতিহিংসার শিকার না হন—সে বিষয়েও সতর্ক থাকা দরকার; তাতে তার সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয় যা-ই হোক না কেন।

খেয়াল করলে দেখা যাবে, এযাবৎ হলিউড, বলিউড এবং এরপরে বাংলাদেশে যেসব ভুক্তভোগী যৌন হয়রানির অভিযোগ করে সোশ্যাল মিডিয়ায় মি টু হ্যাশট্যাগ দিয়ে অনেক বছর পরে হলেও অন্যায়ের প্রতিবাদ করছেন, তারা সবাই সমাজের শিক্ষিত এবং ডিজিটালি অ্যাডভান্সড জনগোষ্ঠীর অংশ। কিন্তু যৌন হয়রানি শুধু এই শিক্ষিত সমাজ এবং মিডিয়া ও বিনোদন জগতেই হয় না। বরং গ্রামে, মফস্বলে, ছোট শহর থেকে শুরু করে সমাজের প্রতিটি স্তরেই কোনও না কোনোভাবে যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটে। ফলে ভুক্তভোগীর সংখ্যাও অগণিত। সেই অগণিত মানুষের হয়রানির কথা আমরা কোনও দিনই জানবো না। সমাজের এসব স্তরে যারা প্রতিনিয়ত নারীদের নিগৃহীত করেন, সেটি কর্মক্ষেত্রে কিংবা পথেঘাটে—তাদের মুখোশ কোনও দিনই উন্মোচিত হবে না। কারণ, ওইসব নারী সোশ্যাল মিডিয়ায় সক্রিয় নন। ফলে এখন হলিউড-বলিউডের জোয়ার আমাদের দেশে এসে লাগলেও এর মাধ্যমে শেষমেশ খুবই সামান্য সংখ্যক ভুক্তভোগী এবং অভিযুক্তের কথা আমরা জানবো; কিন্তু এর বাইরে থেকে যাবে এক বিশাল ইতিহাস।

লেখক: সাংবাদিক

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ