X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

সংলাপ সংস্কৃতি: অর্জন ফিকে নয়

আনিস আলমগীর
১৩ নভেম্বর ২০১৮, ১৪:২৯আপডেট : ১৩ নভেম্বর ২০১৮, ১৪:৩১

আনিস আলমগীর ভোটের পালে হাওয়া লেগে গেছে। আওয়ামী লীগ ৯ নভেম্বর থেকে দলের নমিনেশন ফরম ছেড়েছে। ৮ নভেম্বর তফসিল ঘোষণার তিন দিন পর বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঘোষণা দেওয়ায় সরগরম হয়ে উঠেছে নির্বাচনের মাঠ। তারাও নমিনেশর পেপার বিলি শুরু করেছে ১২ নভেম্বর থেকে। অন্য বড় দলগুলোও কেউ পিছিয়ে নেই। বলা যায় এতদিন জোটে জোটে যে সংলাপ হচ্ছিল তা এবার জোটের শরিকদের সঙ্গে শুরু হবে, মানে ভোটের সংঘাত ও সমঝোতা শুধু সরকারের সঙ্গে নয়, জোটগুলোকে অভ্যন্তরীণভাবেও মোকাবিলা করতে হবে। সময়ও বাড়তি পাওয়া যাবে। নির্বাচনে ভোট গ্রহণের তারিখ ২৩ থেকে পিছিয়ে ৩০ ডিসেম্বর করা হয়েছে। অবশ্য বিএনপি জোট দাবি করে আসছে নির্বাচন এক মাস পিছিয়ে দিতে হবে।
বিএনপির নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্তে আপাতত সব দলের অংশগ্রহণপূর্ণ একটি নির্বাচনের আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগেরও অর্জিত হলো একটি বড় রাজনৈতিক বিজয়। শেখ হাসিনার সরকারের অধীনেই শেষ পর্যন্ত নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, যেটিতে অংশগ্রহণকে বিএনপি বলছে আন্দোলনের অংশ। বিএনপির অংশগ্রহণকে মর্যাদা দেওয়া, নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করার দায়িত্ব এখন সরকারের। সরকারি প্রশাসনকে এখন নির্বাচনকালীন সরকারের মতোই হস্তক্ষেপ ছাড়াই চলতে দিতে হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, ঐক্যফ্রন্টের আড়ালে বিএনপির নির্বাচনে যাওয়ার এই সিদ্ধান্তের পেছনে কাজ করেছে অতি সম্প্রতি অনুষ্ঠিত রাজনৈতিক সংলাপ।

সংলাপে কী পেলো? সাত দফা পূরণ হয়নি তারপরও নির্বাচনে যেতে বিএনপি বাধ্য হয়েছে– এমনও কথাবার্তা চলছে রাজনীতির মাঠে। ‘সেই তো লোক হাসিয়ে নির্বাচনে গেলি’–এমন তির্যক মন্তব্যও চলছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। আমি বলি প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি চোখে দেখার মতো কিছু না থাকুক, আলোচনার টেবিলে বসার মাঝেও একটা সফলতা থাকে। রুদ্ধ দুয়ার খুলে যায়। মন খুলে কথা বললেও মন ভারাক্রান্ত থাকে না। ব্যাপক আলোচনায় ভুল বোঝাবুঝিরও অবসান হয়। সংলাপে অংশ নেওয়া নেতাদের বডি ল্যাংগুয়েজ প্রমাণ দিয়েছে সংলাপ কতটা জরুরি ছিল।

খেয়াল করে দেখুন, বারবার আলোচনায় বসার প্রস্তাব দিয়ে আসছিল বিএনপি। আবার আওয়ামী লীগ বৈঠকে না বসার অনমনীয় মনোভাব দেখিয়ে আসছিলো বহুদিন থেকে। কিন্তু জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন যেই মাত্র সংলাপের কথা বলে চিঠি দিলেন, সঙ্গে সঙ্গে শেখ হাসিনা ১৮০ ডিগ্রিতে ঘুরে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রধান ড. কামাল হোসেনকে চিঠি লিখে পাঠালেন। গণভবনে সংলাপ আয়োজনের কথা জানালেন। সঙ্গে নৈশভোজেরও দাওয়াত দিলেন।

ড. কামাল চিঠির সঙ্গে তাদের ৭ দফা দাবিও পাঠিয়েছিলেন। আর প্রধানমন্ত্রী দাওয়াতের চিঠিতে আলোচনার ভিত্তি হিসেবে শাসনতন্ত্রের কথা উল্লেখ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক মহলকে পরিষ্কারভাবে বার্তা দিয়ে দিলেন যে তিনি রাজনৈতিক সমঝোতায় বিশ্বাসী। ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনের আগেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে বিএনপি প্রধান বেগম খালেদা জিয়াকে টেলিফোনে সংলাপের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু বেগম জিয়া সংলাপে বসতে সম্মত হননি। উভয়ের টেলিফোন আলাপ পরে দেশের মানুষ টেলিভিশনে শুনেছে।

খালেদা জিয়া তখন সংলাপ ছেড়ে আন্দোলনেই সমস্যার সমাধান খুঁজেছিলেন। কিন্তু তিনি আন্দোলনে বিজয়ী হতে পারেননি। কাঁদুনে গ্যাসে আওয়ামী লীগের চোখ ফুটেছে। তাকে আন্দোলন দিয়ে কাবু করা খুবই কঠিন ব্যাপার। আবার তার থলেতে জমা আছে ১৯৭১ সালের একটা সশস্ত্র যুদ্ধের অভিজ্ঞতাও। সশস্ত্র নিরস্ত্র কোনও দিকে আওয়ামী লীগকে ডিঙিয়ে যাওয়ার মতো কোনও সংগঠন আপাতত বাংলাদেশে নেই বলা চলে। সর্বোপরি তাদের আছে জাদুকরের মতো একজন নেত্রী শেখ হাসিনা। আছেন আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, মতিয়া চৌধুরী, মোহাম্মদ নাসিমের মতো একঝাঁক প্রবীণ নেতা-নেত্রী।

সুতরাং ২০১৪ সালের নির্বাচনের পূর্বে বেগম জিয়া যেভাবে আওয়ামী লীগকে অবমূল্যায়ন করেছেন তা তার সঠিক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হয়নি। বর্তমান বিএনপির ভোগান্তি খালেদা জিয়ার সেই ভুল রাজনৈতিক সিদ্ধান্তরেই ফসল। রাজনীতিতে একবার পা পিছলে পড়লে তার খেসারত দীর্ঘ সময়ব্যাপী দিতে হয়। সংলাপ একটা রাজনৈতিক সংস্কৃতি। শেখ হাসিনা সহজে রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে বিচ্যুত হতে চাননি। তাই শেষ পর্যন্ত তিনি বিএনপির নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নয় শুধু, সব জোট এবং ছোট ছোট দলকেও গণভবনে সংলাপে ডেকেছেন। সবার কথা ধৈর্যসহকারে শুনেছেন।

অথচ বিএনপি নৈশভোজের মতো ক্ষুদ্র বিষয় নিয়েও কত তামাশা করলো। আবার তাদের নাশতার দৃশ্য মিডিয়ায় আসলো কেন সেজন্য সরকারকে ছোটলোক বললেন ঐক্যফ্রন্টের মাহমুদুর রহমান মান্না। যখন কোনও আলোচিত শীর্ষ ব্যক্তিরা বৈঠকে মিলিত হন তখন তারা কী খাওয়া দাওয়া করবেন, করলেন–এটা নিয়ে মিডিয়ার উৎসাহ নতুন কিছু নয়। সংলাপে গেলেও নৈশভোজে অংশ নেবেন না বলে মিডিয়ার উৎসাহকে বরং আরও একধাপ বাড়িয়ে দিয়েছেন মান্নারা স্বয়ং। ফলে তাদের কথা বলার চেয়ে খাওয়ার ছবিই প্রাধান্য পেয়েছে ক্যামেরায়। সহজ সমীকরণ ছিল এটি। এখানে সরকার বা মিডিয়াকে তিরস্কার করা বা এসবের সংবাদমূল্য নিয়ে যারা পাণ্ডিত্য দেখিয়েছেন তারা কিন্তু অতি সম্প্রতি ট্রাম্প-কিম শীর্ষ বৈঠকে দুই নেতা কী কী খেয়েছেন সেটা খুব আগ্রহ নিয়ে পড়েছেন।

বঙ্গবন্ধু নাকি চট্টগ্রামে গেলে লালদীঘির পাড়ে জনসভা শেষে গুডস হিলে ফজলুল কাদের চৌধুরীর বাসায় গিয়ে তার থেকে চাঁদা এনে জহুর আহমদ চৌধুরী এবং এম এ আজিজকে দিতেন। আবার খুলনার হাদিস পার্কের জনসভা করতে গিয়ে সবুর খানের বাসায় গিয়ে তার থেকে চাঁদা এনে শেখ আব্দুল আজিজ অ্যাডভোকেট ও আব্দুল মুমিনকে দিতেন। অথচ ফজলুল কাদের এবং সবুব খান দুজনই ছিলেন মুসলিম লীগের নেতা। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর শাহ আজিজ দালাল আইনে জেলে ছিলেন আর বঙ্গবন্ধু প্রতি মাসে তার ঘর ভাড়া তার স্ত্রীর কাছে পৌঁছে দিতেন। শাহ আজিজ যতদিন জেলে ছিলেন ততদিন তার ঘর ভাড়া দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। এসব অনেকেই জানেন।

আরেকটি শোনা কথা শেয়ার করছি। শ্রমিক নেতা মিসির আহমেদ ভূঁইয়া একবার হঠাৎ গ্রেফতার হয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে গিয়েছিলেন। সেখানে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তার দেখা। শেখ মুজিব তাকে দেখে বললেন, কী মিসির, মুখ কালো কেন, ভয় পেয়েছো নাকি? তখন মিসির আহমেদ নাকি বলেছিলেন, না মুজিব ভাই, ভয় পাইনি। চিন্তা হচ্ছে মায়ের হাতে কোনও টাকা দিয়ে আসতে পারিনি। মা চলবে কী করে!

শেখ মুজিব মিসিরের কাছ থেকে তার কুমিল্লার বাসার ঠিকানা নিয়েছিলেন এবং তার মায়ের কাছে টাকা পাঠিয়েছিলেন। মিসির ভূঁইয়া জীবনে কখনও আওয়ামী লীগ করেননি। ন্যাপের রাজনীতি করতেন। আওয়ামী লীগের সঙ্গে ছিল ন্যাপের বৈরিতা। বঙ্গবন্ধুর এই গল্প বলার সময় মিসির আহমেদ চোখের পানি ফেলতেন।

রাজনীতির ভিন্নতার কারণে পরস্পরের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক থাকবে না কেন? গান্ধী অখণ্ড ভারতের স্বাধীনতা চেয়েছিলেন আর জিন্নাহ ভারতের মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্রের দাবি তুলেছিলেন। এমন দুই ঐতিহাসিক নায়কের বৈরিতার মাঝেও কেউ কাউকে কখনও অবমূল্যায়ন করেননি। জিন্নাহকে ‘কায়দে আযম’ উপাধি দিয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধী। নেহরুর সঙ্গে শত বৈরিতার পরও জিন্নাহর প্রশংসা করতে গিয়ে নেহরু বলেছিলেন, জিন্নাহ আনসেন্সড চরিত্রের লোক। বিরোধী রাজনীতি করার অর্থ  এই নয় যে পরস্পর মল্লযুদ্ধ করতে হবে। অতীতের রাজনীতিবিদদের কর্মকাণ্ড আচরণ ইত্যাদি থেকে আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত। এখন রাজনীতিবিদ এবং রাজনীতির সব ভালো গুণই মন্দের ছায়ায় ঢাকা পড়ে গেছে। আস্থা-বিশ্বাসও তিরোহিত হয়ে গেছে।

বলছিলাম সংলাপের কথা। সংলাপ রাজনৈতিক উত্তাপে জল ঢেলে দিয়েছে। পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে দেখা-দেখি হয়েছে। ব্যক্তিগত কথাবার্তাও হয়েছে। মওদুদ আহমদ প্রধানমন্ত্রীর কাছে তার ঘরের কথা উত্থাপন করেছেন, জাফরুল্লাহ চৌধুরী শেখ হাসিনার সরকার কর্তৃক তার প্রতিষ্ঠানকে প্রদত্ত ১৪ বিঘা জমির দখল না পাওয়ার কথা বলেছেন, আর মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মামলার চক্করে তার চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাওয়ার অসুবিধার কথাও আলোচনা করেছেন।

এই যে ঘরোয়া পরিবেশে নিজের ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের কথা আলাপ হলো তাতেই তো সবার মন প্রসন্ন হলো। বিএনপি তথা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নির্বাচনে যাওয়া নিয়ে সংশয় ছিল। সংশয় কাটাতে সংলাপ সহায়তা করেছে। কোর্টে হাজিরার সময় খালেদা জিয়াকে দেখতে গিয়েছিলেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সেখানে খালেদা জিয়া তার দলের মহাসচিবকে বলেছিলেন, আন্দোলন আর নির্বাচন দুইটাই করতে হবে। দেশবাসী আশা করছেন, নির্বাচনের পালে যে হাওয়া লেগেছে সেটা যেন আবার কেউ বানচাল না করে। সরকার- বিরোধী দল যে কেউ নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করলে, নির্বাচনের পরিবেশ নষ্ট করলে- নাগরিক জীবনের অতৃপ্তিবোধ বাড়বে। কারণ, এখন সবাই নির্বাচনের জন্য উৎসুক হয়ে উঠেছে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
দোকান থেকেই বছরে ২ লাখ কোটি টাকার ভ্যাট আদায় সম্ভব
দোকান থেকেই বছরে ২ লাখ কোটি টাকার ভ্যাট আদায় সম্ভব
বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে অতীত ফিরিয়ে আনলেন শান্ত-রানারা
বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে অতীত ফিরিয়ে আনলেন শান্ত-রানারা
হিট স্ট্রোক প্রতিরোধে করণীয় ও বিশেষজ্ঞ পরামর্শ জেনে নিন
হিট স্ট্রোক প্রতিরোধে করণীয় ও বিশেষজ্ঞ পরামর্শ জেনে নিন
হাতিরঝিলে ভাসমান অবস্থায় যুবকের মরদেহ
হাতিরঝিলে ভাসমান অবস্থায় যুবকের মরদেহ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ