X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

ব্যালটই একমাত্র শক্তি

সাইফুল হাসান
১৬ নভেম্বর ২০১৮, ১৬:৩৩আপডেট : ১৬ নভেম্বর ২০১৮, ১৬:৪০

সাইফুল হাসান ক্ষমতার জন্য ব্যালটই একমাত্র বৈধ ছাড়পত্র। তাই কালে কালে, ব্যালটের অধিকার প্রতিষ্ঠায় বুলেটের সামনেই বুক পেতে দিয়েছে দুনিয়াজোড়া মানুষ। এই একবিংশ শতাব্দীতেও, ব্যালটের অধিকার পেতে লড়ছে বহু দেশের মানুষ। বুলেট শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয় বটে, কিন্তু জনগণকে মূল্য গুনতে হয় অনেক।

সব শাসক ভোটে জিততে চান। জনগণকে খুশি রেখে বা অন্য কোনও উপায়ে। ঘৃণা, বিদ্বেষ, সাম্প্রদায়িকতা উসকে দিয়ে, চাপে রেখে কিংবা নানা কৌশলে। এটাই ভোটের রাজনীতির ইতিহাস। আমেরিকা বা ভারত, ভেনিজুয়েলা বা শ্রীলংকা-সব জায়গায় সমান। ফলে, নির্বাচন এলেই কেবল ক্ষমতা প্রত্যাশীদের আসল চেহারা বেরিয়ে পড়ে।

বাংলাদেশে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ক্ষণগণনা শুরু হয়েছে। নির্বাচন নিয়ে জনমনে যেসব শঙ্কা ছিল তা ক্রমশও কেটে যাচ্ছে। স্বস্তির বিষয় হচ্ছে, ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাহীন দলগুলোর মধ্যে আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক কথাবার্তা হয়েছে এবং হচ্ছে। সংঘাতময় দ্বিদলীয় রাজনীতিতে এটাও বড় অগ্রগতি। প্রধান দুই রাজনৈতিক জোটই মনে করে, আগামী নির্বাচন বাংলাদেশকে ভবিষ্যতের পথ দেখাবে।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা বহুদিন নির্বাচনি মুডেও মাঠে। ৪ হাজারের বেশি প্রার্থী আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম কিনেছেন। অন্যদিকে, নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ড. কামালের নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্ট। যার প্রধান শরিক বিএনপি ও তার মিত্ররা। এতে থানা-পুলিশ-কোর্টে বিপর্যস্ত দলটির নেতাকর্মীরা কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে পারছে। মনোনয়ন প্রত্যাশী নেতা ও সাধারণ কর্মীদের পদচারণায় মুখর বিএনপি অফিস।

নির্বাচনে আসার সিদ্ধান্ত নিলেও বিরোধীরা সেই অর্থে সংগঠিত নয়। প্রশাসন এবং সংগঠনের পাশাপাশি সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিভিন্ন ‘পকেট’, এমনকি গণমাধ্যমের বড় অংশও আওয়ামী লীগের প্রভাবের বাইরে নয়। নির্বাচন নিয়ে, বিশ্ব মোড়লদের এখন পর্যন্ত তেমন নড়নচড়ন নেই। তাদের অনেকেই আওয়ামী লীগের পরীক্ষিত ও বিশ্বস্ত বন্ধু। প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও মোটামুটি অনুকূলেই। ফলে নির্বাচন নিয়ে সেই অর্থে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর তেমন চাপ আছে বলে আমি মনে করি না। তবে সরকারের কাছে  একটি ভালো নির্বাচনের প্রত্যাশা আছে সবার।

নাগরিক আকাঙ্ক্ষা হচ্ছে, সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি  করবে এবং নিরপেক্ষ থাকবে নির্বাচনকালীন সরকার। একটি স্বচ্ছ, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন সরকারের সাংবিধানিক ও নৈতিক দায়িত্ব। মনে রাখা ভালো, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বৈধতার প্রশ্নটি ঐক্যফ্রন্টের (বিএনপি) নির্বাচনে থাকার সঙ্গে জড়িত। কোনও কারণে তারা সরে দাঁড়ালে, নির্বাচন কারও কাছেই গ্রহণযোগ্য হবে না। কেননা, আওয়ামী লীগের বাইরে দেশে তারাই প্রধান রাজনৈতিক শক্তি এবং প্রায় ৩৫ শতাংশ মানুষ তাদের পক্ষে ভোট দেয়।

ঐক্যফ্রন্টের সুবিধা, তাদের বিপুল জনসমর্থন আছে। যদিও তা সফল আন্দোলন বা দাবি আদায়ের নিশ্চয়তা নয়। অসুবিধা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মতো কুশলী রাজনীতিক হচ্ছেন প্রতিপক্ষ। পাশাপাশি, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি, রাজনৈতিক-সামাজিক নানা গোষ্ঠী, প্রশাসন, ব্যবসায়ী, নাগরিক সমাজ, মূলধারার ধর্মীয় সম্প্রদায়, আদিবাসীরা ঐক্যফ্রন্ট (বিএনপি) থেকে নিরাপদ দূরত্বে। ফলে, প্রতিকূল এই সময়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার চেয়ে ভালো কোনও বিকল্প আর ছিল বলে মনে হয় না।

বিএনপি দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলের একটি। দলটির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া দুর্নীতির দায়ে সাজাপ্রাপ্ত এবং কারাগারে। দ্বিতীয় প্রধান নেতা তারেক রহমানও দণ্ডপ্রাপ্ত এবং ফেরারি। হাইকোর্টে খালেদা জিয়ার সাজা বহাল আছে এবং বেড়েছে। আপিল বিভাগে এই রায় একেবারে উল্টে যাওয়ার সম্ভাবনা কম। ফলে এ মুহূর্তে রাষ্ট্রপতির অনুকম্পা ছাড়া খালেদা জিয়ার জেল মুক্তির সম্ভাবনা ক্ষীণ।

অন্যদিকে সহায়ক পরিবেশ ছাড়া তারেক রহমান দেশে ফিরবেন এমন কোনও সম্ভাবনা দেখা যায় না। ২১ আগস্ট গ্রেনেড, ১০ ট্রাক অস্ত্র, জজ মিয়া কাহিনি, জঙ্গিদের প্রশ্রয়, সংখ্যালঘু নিপীড়ন, ঘুষ, দুর্নীতি, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহারসহ নানা অভিযোগ আছে বিগত বিএনপি জোট সরকারের বিরুদ্ধে। গত এক দশক ধরে যার প্রায়শ্চিত্ত করছে বিএনপি। কতদিন করতে হবে, সৃষ্টিকর্তাই ভালো জানেন।

বিএনপির কর্মী সমর্থকসহ বহু মানুষ খালেদার সাজাকে ‘রাজনৈতিক দণ্ড’ মনে করলেও বাস্তবতা হচ্ছে তিনি আদালতের চোখে দুর্নীতিপরায়ণ। আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন এমন সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এবং আপাতত তিনি রাজনীতি থেকে মাইনাস হতে চলেছেন। এই তিক্ত সত্য বিএনপি যত দ্রুত মেনে নেবে ততই মঙ্গল।

রাজনীতি ও নেতৃত্ব সংকট বিএনপির জন্য নতুন সুযোগ ও সম্ভাবনা নিয়ে এসেছে। মির্জা ফখরুলদের ক্যারিশমেটিক নেতৃত্ব ও প্রজ্ঞা দেখানোর সবচেয়ে উত্তম সময় এখন। লাখ লাখ নেতাকর্মীর হতাশা দূর করা ও তাদের উজ্জীবিত রাখাই নেতাদের সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জ। ঐক্যফ্রন্ট তৈরির কৌশলটি এখন পর্যন্ত সফল। ড. কামালের মুখচ্ছবিতে ঢাকা বিএনপির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে, এখান থেকে সুফল নিতে পারার ওপর। ঐক্যফ্রন্ট কোনও আদর্শিক জোট নয়। ফলে তা কতদিন টিকবে এই নিয়ে সব মহলেই সংশয় আছে।

বিএনপি নির্বাচনমুখী দল। এ ধরনের সংগঠন নির্বাচনেই বাঁচে। ফলে তাদের শুধু নির্বাচনের ট্রেন ধরলেই হবে না, গন্তব্য পর্যন্ত অপেক্ষাও করতে হবে। আগামী কয়েক সপ্তাহে রাজনৈতিক পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে বলা মুশকিল। তবে ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের উচিত সব ধরনের ঝুঁকি পরিহার করে চলা।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ মুহূর্তে দেশের সবচেয়ে দক্ষ, প্রজ্ঞাবান, প্রভাবশালী এবং ‘পরিপূর্ণ’ রাজনীতিবিদ। তিনি কৌশলে অনন্য। লক্ষ্য স্থির করেন এবং তা অর্জনের চেষ্টা করেন। তিনি রাজনীতি জানেন এবং প্রয়োগ করেন। অন্যরা তাকে অনুসরণ করে মাত্র। ড. কামালের এক চিঠির জবাবে সংলাপে রাজি হওয়া, হেফাজতের আল্লামা শফি হুজুর আয়োজিত শুকরিয়া মাহফিলে যোগদান এর সবচেয়ে নিকটতম ও সাধারণ উদাহরণ।

১৪ দলীয় জোট নেতা শেখ হাসিনা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য লম্বা সময় ধরে প্রস্তুতি নিয়েছেন। পরিকল্পনা করেছেন। দল এবং নিজেদের পক্ষের সব শক্তিকে ধীরে ধীরে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত করেছেন। ফলে সবাইকে তার দেখানো কোর্টে খেলতে হচ্ছে। এমনকি বিরোধীদেরও। ফলে আওয়ামী লীগ যে লম্বা সময় ধরে রাজনীতিতে নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছে তা শুধু বিরোধীদের ব্যর্থতা নয়, বরং শেখ হাসিনার কৃতিত্বও।

শেখ হাসিনা জাতির পিতার কন্যা, তিন তিনবারের প্রধানমন্ত্রী। একমাত্র ‘রাষ্ট্রপতি’ হওয়া ছাড়া ব্যক্তিগতভাবে এই দেশ থেকে তাঁর আর কিছু পাওয়ার নেই। যেটা তিনি চাইলেই হতে পারতেন বা এখনও পারেন। ভবিষ্যতেও পারবেন। কিন্তু তার কাছ থেকে এই দেশের পাওয়ার আছে অনেক কিছু। এরমধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের নিশ্চয়তা এবং বাস্তবায়ন। যে অঙ্গীকার ইতোমধ্যেই অনেকবার করেছেন তিনি। কিন্তু তা কতখানি পালিত হবে, সে প্রশ্ন নির্বাচন পর্যন্ত তোলা থাকলো।

ভুলে গেলে চলবে না, নির্বাচন কমিশন (ইসি) অনেক ক্ষেত্রেই অর্পিত দায়িত্ব ঠিকমত পালন করতে পারেনি। ইসির নেতৃত্ব ও সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন আছে। কিছু ক্ষেত্রে তাদের গ্রহণযোগ্যতাও প্রশ্নবিদ্ধ। এ অবস্থায় একটি ভালো নির্বাচনই পারে কমিশনের ওপর জনআস্থা ফেরাতে। সব দলের জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি, প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণ এবং নিরপেক্ষ রাখা, মানুষকে নির্ভয়ে ভোট দিতে পারার পরিবেশ সৃষ্টিও কমিশনের দায়িত্ব। এ কাজটি সাফল্যের সাথে করতে হবে ইসিকে।

ইসির ও সরকারের সামনে, ৫ জানুয়ারির বদনাম ঘুচানো এবং নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার সুবর্ণ সুযোগ। নির্বাচনে সব দল অংশ নিচ্ছে, তাই এই সুযোগ নষ্ট করা উচিত হবে না।

‘যুদ্ধে আপনি একবারই হত্যার শিকার হতে পারেন কিন্তু রাজনীতিতে অসংখ্যবার’-চার্চিলের  এই উক্তি রাজনীতিতে সবসময় সত্য। নির্বাচন ঘিরে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্র, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট (বিএনপি)-সহ আরও  কয়েকটি ছোট দল ও জোট রক্তপাতহীন এক যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত কে ‍জিতবে তা ডিসেম্বরের ৩০ তারিখেই পরিষ্কার হবে।

নাগরিক প্রত্যাশা হচ্ছে, সবাই কিছু কিছু করে জিতুক। যাতে কেউ নিজেদের পরাজিত না ভাবে। এটি ভালো নির্বাচনের স্বার্থে সবারই কিছু কিছু ছাড় দেওয়া উচিত। যেন মানুষ উৎসবমুখর পরিবেশে তার ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে।

লেখক: সাংবাদিক

[email protected]

 

/এমওএফ/আপ-এফএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
দুই বলের ম্যাচে জিতলো বৃষ্টি!
পাকিস্তান-নিউজিল্যান্ড প্রথম টি-টোয়েন্টিদুই বলের ম্যাচে জিতলো বৃষ্টি!
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ