X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

‘গণতন্ত্রকে বাঁশযোগ্য করে যাবো আমি…!’

চিররঞ্জন সরকার
৩০ নভেম্বর ২০১৮, ১৪:৩৭আপডেট : ৩০ নভেম্বর ২০১৮, ১৪:৩৭





চিররঞ্জন সরকার আমাদের দেশে একাধিক স্বৈরশাসক দেশবাসীকে সালাম দিয়ে অস্ত্রের জোরে দেশের শাসন-ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। তারা ‘দেশ ও জাতি’র বৃহত্তর স্বার্থের দোহাই দিয়ে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছিলেন। কোনও উপকার নয়, দেশ-জাতির পাশাপাশি তারা গণতন্ত্র নামক জিনিসটাকেও ‘বাঁশ’ দিয়ে গেছেন।
সামরিক শাসনের জমানা পার হয়ে আমরা ১৯৯১ সালে ‘গণতান্ত্রিক শাসনে’ প্রত্যাবর্তন করি। কিন্তু আমাদের গণতান্ত্রিক দাবিদার নেতানেত্রীরাও মনে-মননে-আচরণে স্বৈরশাসকের ভাবধারা লালন করলেন। পারস্পরিক খেয়োখেয়ি, একে-অপরকে না-মানার কঠোর মনোভাব, লাগাতার হরতাল-অবরোধে জেরবার হলো নাগরিক-জীবন। নানা কারসাজি করে কীভাবে নির্বাচনকে প্রভাবিত করা যায়, কীভাবে ক্ষমতায় থাকা যায়-তার তত্ত্ব-তালাশ চলতে থাকলো। এরই ধারাবাহিকতায় নিজ স্বার্থে বিএনপি-জামায়াত জোট নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাঠামোটাকে পঙ্গু বানিয়ে ফেললো। নিজেদের পছন্দের ব্যক্তিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান বানাতে বিচারপতির অবসর গ্রহণের বয়স বাড়িয়ে বিতর্ক শুরু করা হলো। শেষ হলো দলীয় রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে নির্বাচন করার খায়েশ পূরণের উদ্যোগের মধ্য দিয়ে। আওয়ামী লীগের সর্বাত্মক প্রতিরোধের কারণে সৃষ্টি হলো চরম অরাজকতা। আর এই অরাজক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে আবারও অনির্বাচিত ব্যক্তিরা ক্ষমতার মঞ্চে প্রবেশ করলেন। ‘গণতন্ত্র নির্মাণের’ নামে নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে তারাও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ছাল তুলে ছাড়লেন!
এরপর নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীন হলেন শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার আমলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পরিবর্তন হলো। আবার ফিরে এলো পুরনো ব্যবস্থা। আবার শুরু হলো প্রতিরোধ। এবার বিএনপি-জামায়াতের পক্ষ থেকে। কিন্তু শক্তি আর কৌশলের খেলায় তারা পেরে না ওঠায় শেখ হাসিনার কাছে হার মানতে বাধ্য হলো।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকার ঘটনাবহুল এক দশক পর আবার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এই নির্বাচনের প্রাক্কালে আবারও কেউ কেউ ‘গণতন্ত্র উদ্ধারের’ কথা বলে মাঠ গরম করার চেষ্টা করছেন।
যারা গণতন্ত্র গণতন্ত্র করে মুখে ফেনা তোলেন, তাদের বলতে ইচ্ছে করে: হে মহামান্যগণ, গণতন্ত্র জিনিসটা কী? আপনারা কি জানেন? চেনেন? দেখেছেন? নিজেদের জীবনে-আচরণে-পরিবারে-দলে চর্চা করেন? তা যদি না করেন, তাহলে মিছে কেন ওই জিনিসের কথা বলে বিভ্রান্ত করছেন?
বরং আপনারা যেটা পারবেন, সেটাই জোর দিয়ে বলুন না কেন। হ্যাঁ, দায়িত্ব নিয়েই বলছি, জোর দিয়েই বলছি, বর্তমান আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক কাঠামো অপরিবর্তিত রেখে আমাদের নেতানেত্রীরা গণতন্ত্র-উদ্ধার, শক্তপোক্ত করা কিংবা চর্চা নয়, বরং গণতন্ত্রকে ‘বাঁশ’ দিতে পারবেন! অভিজ্ঞতায় আমরা তা-ই দেখেছি। অবশ্য শুধু নেতানেত্রীদের দোষ নয়, এটা আমাদের জাতিগত দোষ! আমরা গণতন্ত্রের কথা বলি শুধুই মুখে, গণতন্ত্র দেখতে চাই অন্যের মধ্যে, রাজনৈতিক দলে এবং রাষ্ট্রে। কিন্তু নিজে গণতন্ত্রী হই না, হতে পারি না। আমাদের আচরণ, গলার স্বর, শব্দচয়ন, বলার ধরনই বলে দেয় আমরা একেকজন খুদে হিটলার।
দীর্ঘদিনের চর্চা ও অভ্যাসে আমরা আমাদের সব সৃজনশীলতা হারাতে বসেছি। এখন আমাদের সম্বল বলতে একটি, সাধ্যও একটি। আসলে আমাদের দেওয়ার বলতে আছে মাত্র একটি জিনিস-সেটি হচ্ছে ‘বাঁশ’। যে ‘বাঁশে’র ফিলামেন্টে প্রথম কৃত্রিম আলোকরশ্মি জ্বলে উঠল, যে ‘বাঁশে’র কেল্লায় তিতুমীর সাম্রাজ্যবাদবিরোধী যুদ্ধ লড়ে গেলেন, যে বাঁশঝাড়ের মাথায় চাঁদ উঠলে কাজলাদিদির কথা মনে পড়ত, এখন সেই বাঁশ শুধু দেওয়ার জন্য! একসময় বাঙালি কিন্তু বাঁশের যথেষ্ট কদর করত। তখন শত্রুকে নির্বংশ হওয়ার অভিশাপ দেওয়া হতো এবং বন্ধুকে বংশরক্ষা বা বংশবৃদ্ধির শুভেচ্ছা জানানো হতো। হায় ‘বাঁশ’, তোমার সেই দিন নাই। এখন তুমি স্রেফ দেওয়ার জন্য, নেওয়ার জন্য নও।
রাজনীতির কচকচানি বাদ দিয়ে আমরা বরং বহুল প্রচলিত ও বহুল প্রচারিত কয়েকটি ‘বাঁশ’ নিয়ে আলোচনা সেরে নিতে পারি।
এক. ‘সরকারি বাঁশ’। এই প্রজাতির বাঁশ সবচেয়ে সহজলভ্য। সব গাছের মধ্যে বাঁশ সবচেয়ে থেকে তাড়াতাড়ি বাড়ে, আর সব বাঁশের মধ্যে এই বাঁশ সবচেয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ে। এতই সুলভ, সস্তা এবং টেকসই যে একে শুধু বাঁশ না বলে পাতিবাঁশও বলা যেতে পারে। যতদিন দেশ আছে, ততদিন এই ‘বাঁশ’ আছে। ছাউনিওয়ালা চার দেয়াল এবং একটি সাইনবোর্ড থাকলেই এই বাঁশের চাষ সম্ভব। এই বাঁশের অসংখ্য প্রজাতির মধ্যে পুলিশ-বাঁশ ও আইন-বাঁশ সবচেয়ে কার্যকর। শত্রুর জীবন “হেল” করে দেওয়ার জন্য সাধারণ মানুষও অল্প আয়াসে এবং সামান্য অর্থব্যয়ে এই বাঁশ ব্যবহার করতে পারেন।
দুই. ‘রাজনৈতিক বাঁশ’। এই বাঁশ সরকারি বাঁশের মতোই সহজলভ্য এবং উচ্চ ফলনশীল, কিন্তু বেশিরভাগ বাঁশ স্বল্পায়ু হওয়ায় দু-তিন রকম বাঁশই বড় অবস্থায় দেখতে পাওয়া যায়। সাধারণত শীতকালে এবং ভোটের মৌসুমে এই জাতীয় বাঁশের ফলনও বৃদ্ধি বেশি হয়। অমাবস্যা-পূর্ণিমা ইত্যাদি বিশেষ তিথিতে যেমন নদী বা সমুদ্রে জল বেড়ে ওঠে, তেমনই বছরের কিছু তিথিতে এই বাঁশের বিস্তর বাড়বৃদ্ধি হয়। সেই সব বিশেষ দিনে সাধারণ মানুষ ঘর থেকে বের হতে চান না। তারপরও আচমকা এই বাঁশ সর্বনাশ ঘটিয়ে দেয়।
তিন. ‘রাবিন্দ্রিক বাঁশ’। এই প্রজাতির বাঁশ বিরল না হলেও দুর্লভ, সূক্ষ্ম এবং পেলব। এদের স্বল্পদৈর্ঘ্য ও স্বল্পপ্রস্থের জন্য অনেকে এদের কঞ্চিও বলে থাকেন। তবে কে না জানে বাঁশের থেকে কঞ্চি…! সাধারণত শিক্ষা ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রের বিভিন্ন বেয়াড়া লোকজনকে টাইট দেওয়ার জন্য এই বাঁশ ব্যবহার করা হয়। এই বাঁশের রক্ষকের নাম গুরুদেব। এই বাঁশ বিরুদ্ধ-মত দমনে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে। কঞ্চির শক্তি বোঝা সাধারণ মানুষের পক্ষে সত্যিই দুঃসাধ্য।
চার. ‘সুশীল বাঁশ’। এই বাঁশ হাইব্রিড প্রজাতির বাঙালি বাঁশ। এই বাঁশের নব্বই শতাংশ বদহজম হওয়া মার্কসবাদী-বাঁশ ও রাজাকার-আলবদর-বাঁশের শংকরায়ন ঘটিয়ে উৎপাদন করা হয়। গত দুই দশকে এই বাঁশীয় প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতির ফলে এখন কৃত্রিম উপায়ে উচ্চ ফলনশীল চাষ সম্ভব হয়েছে। তবে এখনও এই বাঁশ বছরের সব সময় দেখা যায় না। কেবল রাজনৈতিক দুর্যোগ, দাঙ্গা ও প্রাণহানি হলেই এই বাঁশ দেখা যেতে পারে। যদিও এই বাঁশ সংখ্যায় খুব কম, এদের বর্ণাঢ্য চেহারার জন্য এরা সহজেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তবে এখন ঘর সাজানোর ফুল, চোরকাঁটা এবং বিছুটিপাতার বিকল্প ছাড়া এক্সপোর্ট কোয়ালিটির এই বাঁশের বিশেষ কোনও ব্যবহারিক উপযোগিতা নেই।
এই চার প্রজাতির বাঁশ ছাড়াও আর বহু বাঁশ আছে, যারা সংখ্যা ও শক্তিতে ক্ষীণ হলেও নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে ভাস্বর। যেমন বর্ণচোরা-বাঁশ, যা সাম্যবাদী-বাঁশের একটি বিশেষ প্রজাতি হলেও এদের জন্ম বা বৃদ্ধি সবই মাটির তলায়। অথবা করপোরেট বাঁশ, যা বহু চেষ্টার পর দেশে পরীক্ষামূলক চাষ শুরু হয়েছে। দেশে সাম্যবাদী-বাঁশের আবাদ কমে যাওয়ায় জঙ্গি-বাঁশের আবাদ ব্যাপক হারে বাড়ছে বলে বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন।
যাহোক, এই তালিকা আর না বাড়িয়ে আসুন আমরা কবি সুকান্তকে নকল করে একবিংশ শতকের ইশতেহার লিখি: ‘গণতন্ত্রকে বাঁশযোগ্য করে যাবো আমি-
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার!
লেখক: কলামিস্ট

 

 

/এমওএফ/আপ-আইএ

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ঢাকায় ‘র‌্যাম্পে হাঁটলো’ উট, ঘোড়া, কুকুরসহ বিভিন্ন পোষা প্রাণী
ঢাকায় ‘র‌্যাম্পে হাঁটলো’ উট, ঘোড়া, কুকুরসহ বিভিন্ন পোষা প্রাণী
একযুগ পর দলছুট, সঙ্গে সঞ্জীব চৌধুরী
একযুগ পর দলছুট, সঙ্গে সঞ্জীব চৌধুরী
সুন্দরবনে মধু সংগ্রহ করা ব্যক্তির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো বাঘ, নিয়ে গেলো গহীন বনে
সুন্দরবনে মধু সংগ্রহ করা ব্যক্তির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো বাঘ, নিয়ে গেলো গহীন বনে
ট্রাম্পের বিচার চলাকালে আদালতের বাইরে গায়ে আগুন দিলেন এক ব্যক্তি
ট্রাম্পের বিচার চলাকালে আদালতের বাইরে গায়ে আগুন দিলেন এক ব্যক্তি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ