X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিজয়ের মাসে বিজয় দেখার অপেক্ষা!

রেজানুর রহমান
১১ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৫:২২আপডেট : ১১ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৫:২৭

রেজানুর রহমান ‘বৎস তুমি ভবিষ্যতে তুমি কি হইতে চাও?’ বৎস সরাসরি উত্তর দিলো, ‘ভবিষ্যতে আমি অনেক টাকার মালিক হইতে চাই।’ তাকে আবার প্রশ্ন করা হলো, ‘অনেক টাকার মালিক হইয়া তুমি কী করিবে?’ বৎস উত্তর দিলো, ‘অনেক টাকার মালিক হইয়া আমি জাতীয় সংসদের নমিনেশন কিনিবো। তারপর জানগণের দ্বারে দ্বারে গিয়া ভোট প্রার্থনা করিবো। অতঃপর ভোটে জয়ী হইলে জনগণের কথা বেমালুম ভুলিয়া যাইবো। বরং জনগণের সঙ্গে ‘ডাট’ মারিবো... পরবর্তীতে আবারও নমিনেশন পাওয়ার আশায় আরও অনেক টাকার মালিক হওয়ার চেষ্টা করিবো।’
এবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রায় প্রতিটি দল ও জোটের প্রার্থীদের অনেকের পরিচিতি দেখে আমার এক বন্ধু হাস্য কৌতুকের সুরে ওপরের মন্তব্যটি করেছে। ভেবেছিলাম তার এই মন্তব্য নিছক কথার কথা। এর কোনও ভিত্তি নেই। কিন্তু খোঁজ নিতেই দেখা গেলো বন্ধুর রসিকতা একেবারে ফেলে দেওয়ার মতো নয়। এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অধিকাংশ ক্ষেত্রে অর্থবিত্তের মালিকরাই প্রতিটি দল ও জোট থেকে অধিক হারে মনোনয়ন পেয়েছেন। অতীতকালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আইনজীবী শিক্ষক এবং এলাকার জনপ্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরাই প্রার্থী হতেন। বর্তমান সময়ে সেই জায়গা দখল করে নিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।

একটি পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এমপিদের মাত্র ১৮ শতাংশ ছিলেন ব্যবসায়ী। দশম জাতীয় সংসদ অর্থাৎ সদ্যবিদায়ী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্যবসায়ী এমপি’র সংখ্যা ছিল ৫৯। নির্বাচনে ব্যবসায়ীরা হঠাৎ এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলেন কেন? এই প্রশ্ন করতেই আমার একজন বন্ধু বললেন, এটা তো সহজ হিসাব। রাজনীতি করতে এখন টাকা লাগে। আর অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই টাকার জোগানদাতা হলেন ব্যবসায়ীরাই। কাজেই তারা তো নির্বাচন করতে চাইবেনই। প্রয়োজনে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা নেবেন অথচ নেতা হতে চাইলে উৎসাহ দেবেন না, এটাতো হতে পারে না। যিনি টাকা দেন তার তো সাধ আহ্লাদও থাকে।

হ্যাঁ, এটাই গুরুত্বপূর্ণ কথা। যিনি টাকা দেন তার তো সাধ আহ্লাদ থাকবেই। আমি টাকা দেই অন্যেরা নেতা হয়। কাজেই আমাদের নেতা হতে দোষ কোথায়? ব্যবসায়ীদের অনেকের ভাবনাটা বোধকরি এমনই। তাই রাজনীতির মাঠে এখন ব্যবসায়ীদেরই জয়জয়কার।

এখন প্রশ্ন হলো, তাহলে কি ব্যবসায়ীরা নেতা হতে পারবেন না? সহজ উত্তর, অবশ্যই পারবেন। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সাংবাদিক, খেলোয়াড়, সংগীতশিল্পী, কৌতুক অভিনেতা জাতীয় সংসদে নেতা হওয়ার অধিকার রাখলে ব্যবসায়ীদেরও তো অধিকার আছে। তাই বলে টাকা থাকলে কি নেতা হওয়া যাবে? রাজনৈতিক নেতা হওয়ারও তো একটা প্রক্রিয়া আছে। সারা বছর মাঠে থাকলাম না। এলাকার সাধারণ মানুষের সঙ্গে তেমন কোনও যোগসূত্রও নেই, এমন অনেকে জাতীয় সংসদের প্রার্থী হচ্ছেন। এটা শুধু ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রেই নয়, অন্যান্য পেশার মানুষের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, এবার যারা জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন তাদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠরাই অঢেল টাকার মালিক। কারণ, সময়টাই নাকি এমন, টাকা ছাড়া নেতা হওয়া মুশকিল। আমাদের রংপুর অঞ্চলে একটা প্রবাদ আছে- ‘ট্যাকায় করে কাম। মিছায় মদ্দের নাম!’ অর্থাৎ টাকাই আসলে কাজ করে। শুধু শুধু টাকার মালিকের নাম হয়।

তাহলে কি নেতা হওয়ার প্রক্রিয়া পাল্টে গেলো? ছোটবেলায় (দেশ স্বাধীনের আগে) আমাদের এলাকায় একজন নেতাকে দেখেছিলাম। সর্বদাই পাজামা-পাঞ্জাবি পরতেন। হাতে থাকতো একটা ছোট্ট ব্যাগ। কার কোথায় বিপদ ঘটেছে নিমিষেই ছুটে যেতেন। প্রকৃত অর্থে তার কোনও অর্থকড়ি ছিল না। তবু এলাকায় ব্যাপক জনপ্রিয় ছিলেন। তিনি একবার এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। আজকের দিনে কি এটা সম্ভব?

একটা সময় দেখা যেত ছাত্র রাজনীতিতে যারা সক্রিয় ভূমিকা পালন করতেন তারাই পরবর্তীতে মূল রাজনৈতিক দলে জায়গা পেতেন অথবা জায়গা করে নিতেন। বর্তমানে তেমনটা দেখা যায় না বললেই। একসময় সক্রিয় ছাত্র রাজনীতি করেছেন এমন একজন ছাত্রনেতা কথায় কথায় আক্ষেপ করে বললেন, যখন ছাত্র রাজনীতি করেছি তখন মূল দলে আমার অনেক কদর ছিল। ছাত্রজীবন পার করার পর রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করে দেখেছি টাকা ছাড়া সম্ভব নয়। তাই পিছিয়ে পড়েছি। তবে যারা আমার চেয়ে চালাক তারা টিকে গেছে। তারা বৈধ, অবৈধ উপায়েই টাকা বানিয়ে রাজনীতি করছে। কোটি টাকার গাড়ি চালায়। আলিশান বাড়িতে থাকে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার একজন পরিচিত শিক্ষক বললেন, মাঝে মাঝে আমার কিছু ছাত্র লেটেস্ট মডেলের গাড়ি নিয়ে আমার কাছে আসে। তখন তাদের জিজ্ঞেস করি কী করছো এখন? হেসে উত্তর দেয় স্যার রাজনীতি করছি। প্রায়শই ওদের কথা ভাবি। রাজনীতি করে ওরা এত টাকা পায় কীভাবে? রাজনীতি কি কোনও ব্যবসা? আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বর্তমানে একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করেন। সেই তুলনায় আমাদের একজন সংসদ সদস্য খুবই ভাগ্যবান। একবার সংসদ সদস্য হতে পারলে ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্যও একটা পাকাপোক্ত ঠিকানা গড়ে তোলা সম্ভব। বাবার পর ছেলে অথবা মেয়ে, তারপর তার ছেলে অথবা মেয়ে বংশপরম্পরা এমপি হওয়ার দৌড়ে লেগে থাকবেনই। পরিবারের অন্য কেউ এমপি না হতে পারলেও বাবা অথবা মায়ের এমপি পদবিটা তো আর যাচ্ছে না। ওই যে এমপি সাহেবের বাড়ি। ওই যে এমপি সাহেব যান... এই ধরনের সার্টিফিকেট পেতে কার না ভালো লাগে! তাই যেকোনও মূল্যে এমপি হওয়া চাই। সে কারণে অনেক ক্ষেত্রে টাকাটাই মূল ফ্যাক্টর হয়ে ওঠে।

তাই বলে ব্যতিক্রম যে নেই তা তো নয়। এই ব্যতিক্রমধর্মী নেতারাই আমাদের মূল ভরসা। আশার কথা, অনেক শঙ্কা কাটিয়ে সারাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনি প্রচার শুরু হয়েছে। এবারের নির্বাচনে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক তরুণ ভোটার প্রথমবারের মতো জাতীয় পর্যায়ের নির্বাচনে সিদ্ধান্ত গ্রহণে মতামত দেবেন। প্রিয় দেশ, প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ যুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছে। কাজেই নতুন ভোটারের ভোটটি পড়ুক স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির ব্যালটে। ডিসেম্বর বিজয়ের, মাসে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিরই আরেক বিজয় দেখার অপেক্ষায় আছি।

লেখক: সাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক- আনন্দ আলো।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জোভানের নতজানু বার্তা: আমার ওপর কষ্ট রাখবেন না
জোভানের নতজানু বার্তা: আমার ওপর কষ্ট রাখবেন না
লাগাতার তাপদাহে যশোরে জনজীবন দুর্ভোগে
লাগাতার তাপদাহে যশোরে জনজীবন দুর্ভোগে
জেলেনস্কিকে হত্যার পরিকল্পনায় জড়িত অভিযোগে পোলিশ নাগরিক গ্রেফতার
জেলেনস্কিকে হত্যার পরিকল্পনায় জড়িত অভিযোগে পোলিশ নাগরিক গ্রেফতার
বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিলেন মিয়ানমারের আরও ১৩ সীমান্তরক্ষী
বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিলেন মিয়ানমারের আরও ১৩ সীমান্তরক্ষী
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ