X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

ভাইরাল ভিডিওর ইতি-নেতি

আমীন আল রশীদ
১৫ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৭:১১আপডেট : ১৫ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৭:১৩

আমীন আল রশীদ ফেসবুকে এবার ভাইরাল হয়েছে বা করা হয়েছে রিকশাচালকের ওপর একজন ক্ষুব্ধ নারীর আচরণ। যেখানে দেখা যাচ্ছে, তিনি একজন রিকশাচালককে থাপ্পড় দিচ্ছেন। সেখানে থাকা কিছু লোকের প্রতিবাদ করলে ওই নারী তাদের সঙ্গেও অসৌজন্যমূলক আচরণ করছেন। ঘটনার পরে জানা যায়, সুইটি আক্তার শিমু নামে ওই নারী ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের ৭ নম্বর (রূপনগর থানার আংশিক ও মিরপুর থানার আংশিক) ওয়ার্ডের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক। ঘটনার পরে দল থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়। সেই বহিষ্কারের চিঠিও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। যদিও তার এই রাজনৈতিক পরিচয় নিয়েও যে রাজনীতি এবং পাল্টা রাজনীতির চেষ্টা হয়েছে, তারও নির্মোহ বিশ্লেষণ প্রয়োজন।
ঘটনাটি ফেসবুকে ভাইরাল হয় ১১ ডিসেম্বর। কাকতালীয়ভাবে এদিন বিকেলেই রাজধানীর পুরানা পল্টন এলাকায় আরেকজন রিকশাচালকের সঙ্গে প্রায় একইরকম ঘটনা প্রত্যক্ষ করি। জ্যামের ভেতরে মোটরসাইকেলের পেছনে বসা ওই নারীর পাশেই দাঁড়ায় একটি রিকশা। সম্ভবত তার শাড়িতে রিকশার সামনের চাকাটি লেগে যায়। এ কারণে তিনি রিকশাচালকের ওপর ক্ষুব্ধ হন। এক কথা, দুই কথা। তারপর সেই তর্কে যোগ দেন মোটরসাইকেলচালকও। একপর্যায়ে তিনি হেলমেট দিয়ে রিকশাচালককে দুই-তিনটি আঘাতও করেন। অনেক মানুষ সেই দৃশ্য দেখছিলেন। কেউ সেটি ভিডিও করেছেন কিনা, জানা যায়নি। তবে যেকোনও ঘটনাই যে এখন ভিডিও হয়ে যাচ্ছে এবং এর ফলে নানা ছবি ভাইরাল হয়ে যাচ্ছে, তার ইতি-নেতিও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।

আমরা স্মরণ করতে পারি, সিলেটের শিশু রাজন থেকে শুরু করে নারায়ণগঞ্জের শিক্ষক শ্যামল কান্তি এবং কলেজছাত্রী খাদিজা; সবগুলো ঘটনার ন্যায়বিচার কিংবা এসব ঘটনা নিয়ে দেশজুড়ে তোলপাড়ের মূল অনুঘটক মোবাইল ফোনের ভিডিও। যারা রাজনকে পিটিয়ে মারা, শ্যামল কান্তিকে কান ধরে ওঠবস করানো এবং খাদিজাকে নৃশংসভাবে কোপানোর ওই দৃশ্যগুলো ভিডিও করেছেন, তারা সবাই এক অর্থে ওই সময়ে নাগরিক সাংবাদিকতা বা সিটিজেন জার্নালিজমের চর্চা করেছেন। যে ছবিগুলো পরে পিক করেছে মূলধারার গণমাধ্যম। যে কারণে বলা হয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুক কখনো-সখনো মূলধারার গণমাধ্যমের চেয়েও শক্তিশালী।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, যদি রাজনকে পিটিয়ে মারা কিংবা শ্যামল কান্তিকে কান ধরে ওঠবস করানো অথবা খাদিজাকে কোপানোর ওই ভয়াবহ দৃশ্যগুলোর কোনও ভিডিও না থাকত, যদি উৎসাহী কেউ ওই দৃশ্যগুলো তাদের মোবাইল ফোনে ধারণ না করতেন, তাহলে এই ঘটনাগুলোর কী পরিণতি হতো? এ নিয়ে পরবর্তী সময়ে হয়তো সাংবাদিকরা রিপোর্ট করতেন ঠিকই, কিন্তু এত আলোচনা হতো না কিংবা খাদিজার ওপর আক্রমণকারী এবং শ্যামল কান্তিকে কান ধরে ওঠবস করানোর সঙ্গে জড়িতদের চেহারা ও রাজনৈতিক পরিচয় গোপন থেকে যেতো। ফলে দেখা যাচ্ছে, ভিডিও এখানে সত্য ঘটনা প্রচার এবং এ বিষয়ে জনমত গঠনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে। কারণ এরকম ঘটনা মাঝেমধ্যেই ঘটে। আলোচনায় আসে এবং জনমত তীব্র হয় মূলত যেসব ঘটনার ছবি আছে। ফলে এই প্রশ্নটিও সঙ্গত যে, যেসব ঘটনার ভিডিও নেই, সেগুলোর কী হবে?

কুমিল্লার কলেজছাত্রী তনু কিংবা সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যার ভিডিও বা নিদেনপক্ষে একটি-দুটি আলোকচিত্রও যদি থাকতো, তাহলেও এতদিনে নিশ্চয়ই এ তিনটি নৃশংস হত্যার বিচার হতো। তার মানে কি দাঁড়াচ্ছে এই যে, এখন যেকোনও ঘটনার ন্যায়বিচার পেতে গেলে তার ভিডিও থাকতে হবে? প্রশ্নটা এ কারণে যে, শ্যামল কান্তিকে কান ধরে ওঠবস করানোর কিছুদিন পরেই লালমনিরহাটে একজন শিক্ষককে প্রকাশ্যে জুতাপেটা করার খবর এসেছে গণমাধ্যমে। ওই ঘটনার প্রতিবাদও হয়েছে। কিন্তু এ নিয়ে খুব বেশি আলোড়ন তৈরি হয়নি। না ফেসবুকে, না মূলধারার গণমাধ্যমে। কারণ শিক্ষককে জুতাপেটা করার কোনও ভিডিও ছিল না।

সবশেষ সুইটি আক্তার নামে যে নারীর ভিডিওটি ভাইরাল হলো, সেটির ইতি-নেতি কী? রাস্তায় চলতে-ফিরতে এরকম দৃশ্য কি এই শহরের মানুষ এর আগে দেখেনি? রিকশাচালকের সঙ্গে বচসা এমনকি তাকে দুই চারটা চড় দেওয়ার ঘটনা কি খুব নতুন কোনও দৃশ্য? কিন্তু যখন এ রকম ঘটনা ঘটে, তার কয়টি এরকম ভিডিও হয় এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়া হয়? নাকি এই দৃশ্যটি উৎসাহী কেউ একজন ভিডিও করেছেন শুধু রিকশাচালককে একজন নারী থাপ্পড় দিচ্ছিলেন বলে? ‘মাইয়া মানুষও রিকশাওয়ালার গায়ে হাত তোলে’—এই যে রসালো বাক্য, যেখানে নারীকে একজন ‘মাইয়া মানুষের’ বেশি ভাবতে এই সমাজ অভ্যস্ত নয়, ভাইরাল হওয়া ভিডিওর পেছনে কি সেই মনস্তত্ত্ব দায়ী নয়? এই ঘটনাটিই যদি একজন ‘পুরুষলোক’ করতেন, সেটি কয়জন ভিডিও করতেন বা ভাইরাল করতেন? তার মানে কি এখানে ঘটনার চেয়ে নারীর লৈঙ্গিক পরিচয়টিই মুখ্য হয়ে উঠলো?

এই ঘটনার রাজনীতিকরণও আমাদের সমাজ ও সমাজস্থ মানুষের রাজনৈতিক দ্বিধাবিভক্তির নোংরা দিকটি উন্মোচিত করেছে। ভিডিওটি ভাইরাল হওয়ার পরে স্বভাবতই উৎসাহী লোকেরা ওই নারীর ফেসবুক প্রোফাইলে গিয়ে তার রাজনৈতিক পরিচয়টি জানতে পারেন এবং তার বিরোধী আদর্শের লোকেরা তখন দ্বিগুণ উৎসাহে ভিডিওটি ভাইরালে অধিকতর মনোনিবেশ করেন। পক্ষান্তরে ঘটনার পরে তার ছবি দিয়ে একটি ফেক আইডি তৈরি করা হয়—যেখানে প্রমাণের চেষ্টা করা হয় তিনি বিএনপির লোক। কিন্তু এই আইডি যে ভুয়া সেটি পরিষ্কার। তাকে দল থেকে বহিষ্কারের পরে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয়। বাস্তবতা হলো, ফেসবুকে কেউ কোনও কারণে আলোচিত হলে প্রথমেই তার রাজনৈতিক পরিচয় সন্ধান এবং সেই আলোকে তার প্রতি ট্রিটমেন্ট এখন সাধারণ প্রবণতায় পরিণত হয়েছে। অর্থাৎ মানুষ যে ‘রাজনৈতিক প্রাণী’—এই বিষয়টি এখন ফেসবুকের দুনিয়ায় চোখ বোলালেই স্পষ্ট। 

কিন্তু একজন মানুষ যখন নিপীড়কের ভূমিকা অবতীর্ণ হন, তখন সেখানে লৈঙ্গিক বা রাজনৈতিক পরিচয়টি মুখ্য নয়। একজন পুরুষ যেমন নিপীড়ক হতে পারেন, তেমনি একজন নারীও। আবার একজন মানুষ যখন নিপীড়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন, তখন সেখানে তার ক্ষমতা এবং ক্ষমতা প্রদর্শনের লিপ্সাও অনেক সময় ক্রীয়াশীল থাকে। সুইটি নামে যে নারী রিকশাচালককে প্রকাশ্যে থাপ্পড় মারলেন এবং এর প্রতিবাদকারীদের ওপরেও চড়াও হলেন, এটি তার পক্ষে সম্ভব হয়েছে, তার রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে। কিন্তু যেহেতু তিনি দল থেকে বহিষ্কার হয়েছেন এবং এখন আর তিনি ক্ষমতার বলয়ে নেই, সুতরাং তার পক্ষে এখন এই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করা বেশ কঠিন। এখন কোনও রিকশাচালককে থাপ্পড় মারার আগে তিনি দশবার ভাববেন। কারণ দল থেকে বহিষ্কার তার ভেতরের ক্ষমতাবান চরিত্রকে অনেকটা ম্লান করেছে, দুর্বল করেছে। আবার সব সময় যে রাজনৈতিক কারণে মানুষ নিজেকে ক্ষমতাবান মনে করে, তাও নয়। বরং ভোগবাদী সমাজে ক্রেতা বা সেবাগ্রহীতা সবসময়ই বিক্রেতার চেয়ে নিজেকে বেশি ক্ষমতাবান মনে করেন। তিনি মনে করেন, রিকশাচালক তার চেয়ে দুর্বল বা রিকশাচালকের চেয়ে তিনি বেশি ক্ষমতাবান। সেই মানসিক বৈকল্য থেকে তিনি ‘পান থেকে চুন খসলেই’ রিকশাচালকের গালে কসে চড় দিয়ে বসেন।

নিজেকে অধিকতর ক্ষমতাবান বা সুপিরিয়র ভাবার এই মানসিকতার কারণেই একজন রিকশাচালককে মারা খুব সহজ। রিকশাচালককে ‘তুই’; নিদেনপক্ষে ‘তুমি’ বলাও সহজ। প্যাসেঞ্জারের চেয়ে বয়সে ছোট হলে অবশ্যই তাকে ‘তুই’ এবং সমবয়সী বা বড় হলে ‘তুমি’—এটি এখন স্বতঃসিদ্ধ। একই কথা খাটে বাসের হেল্পার-কন্ডাকটরদের বেলায়ও। কথিত নিম্নশ্রেণির পেশায় যুক্ত লোকেরা সেবাগ্রহীতার কাছ থেকে সম্মানজনক আচরণ পাবেন না, এটি এখন স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত। অথচ এই একই লোক যখন অন্য পেশায় যুক্ত, তাকে আমরা চট করে ‘তুই’ তো দূরে থাক, ‘তুমি’ বলারও সাহস পাই না।

ধরুন আপনি ব্যাংকে গেলেন কোনও কাজে। কাউন্টারে দেখলেন যিনি বসে আছেন, তিনি আপনার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট। তাকে ‘তুই’ বলার সাহস হবে? হবে না। কারণ তিনি কথিত উচ্চমানসম্পন্ন পেশায় আছেন। আপনি যেহেতু নিজে মনে মনে অন্যের চেয়ে সুপিরিয়র ভাবতে পছন্দ করেন, সুতরাং চান্স পেলেই রিকশাচালককে ‘তুই’ তো বলেনই, বরং গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধা করেন না। কারণ আপনি তার চেয়ে সুপিরিয়র এবং এটি সমাজকে দেখাতে চান।

যে ‘অপরাধে’ আপনি রিকশাচালককে মারলেন বা মারার সাহস করলেন, সেই একই কারণে আপনি আমার গায়ে হাত তোলার কথা কল্পনাও করতে পারেন না। ফলে যে নারী ও রিকশাচালকের ভিডিওটি ভাইরাল হয়েছে, সেখানে ওই নারীকে এককভাবে আমি দোষারোপ করি না। কারণ তিনি হাজার বছরের লিগ্যাসি বহন করে চলেছেন। এই সমাজ তাকে শিখিয়েছে, রিকশাচালককে ‘তুই’ অথবা নিদেনপক্ষে ‘তুমি’ বলা যায়। এই সমাজ তাকে শিখিয়েছে, রিকশাচালককে জোরে না চালালে বা ইগোতে আঘাত দিয়ে কথা বললে তাকে লোকজনের সামনে প্রকাশ্যে মারা যায়—যদি আপনি সমাজের কথিত উঁচুতলার মানুষ হয়ে থাকেন এবং যদি নিজেকে ক্ষমতাবান বা সুপিরিয়র ভাবতে পারার মতো অবস্থা আপনার থাকে।

সুতরাং একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে বলে আমরা ওই নারীর পরিচয় খুঁজে সেখানে রাজনৈতিক রঙ দিতেই পারি। কিন্তু সমস্যাটা শুধু রাজনীতির নয়। এটি আমাদের কালচারের সমস্যা। সেই সমস্যা থেকে আমরা অধিকাংশ মানুষই মুক্ত নই। যারা ওই নারীর সমালোচনা করছেন, তারা বুকে হাত দিয়ে বলুন যে, আপনি রিকশাচালককে ‘তুই-তুকারি’ করেন না। বাসের হেল্পার কন্ডাকটরকে ‘তুই-তুমি’ বলেন না? সুযোগ পেলে তাদের গালি দেন কিনা?

লেখক: সাংবাদিক।  

 

/এসএএস/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
চেলসিকে গুঁড়িয়ে দিলো আর্সেনাল
চেলসিকে গুঁড়িয়ে দিলো আর্সেনাল
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ