X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

মোদির বিপর্যয় কেন হলো?

আনিস আলমগীর
১৮ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৪:১৯আপডেট : ১৮ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৪:২২

আনিস আলমগীর ভারতে হিন্দু যেমন আছে, মুসলমানও আছে। বৌদ্ধরাও ভারতের সন্তান, খ্রিস্টান-শিখরাও এই ভারতেরই মানুষ। ভারতকে খণ্ড বিখণ্ড হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করে এক জাতি এক দেশ বানানোর জন্য নেতারা বললেন বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্যই হবে ভারতের সংহতি ও সমৃদ্ধির মন্ত্র। কিন্তু সমান্তরালভাবে হিন্দু মৌলবাদী সংগঠন সংঘ পরিবার বললো ভারতে রামরাজত্ব প্রতিষ্ঠার কথা। গ্রিকরা যেমন মহাকাব্যকে ধর্মীয় গ্রন্থের মর্যাদা দিতো ভারতীয়রাও তেমনি মহাকাব্য ‘মহাভারত’কে মর্যাদা দিয়েছে। যা হোক, ভারতের রাম ভক্তের সংখ্যাও নগণ্য নয়। গান্ধীও রামের অনুরাগী ছিলেন। অথচ অবিশ্বাস্য হলেও সত্য তিনি জীবনে কখনও কোনও মন্দিরে যাননি, কোনও বিগ্রহের সামনে মাথানত করেননি। কোনও দেব-দেবীর পূজা করেননি। সন্ধ্যায় বিড়ালা মন্দিরে প্রার্থনাই ছিল তার ধর্মকর্ম।
২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে ভারতীয় ধনবাদী গোষ্ঠী রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় পরিবর্তন এনে একজন শিল্পবান্ধব প্রধানমন্ত্রী করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। তারা বেছে নিলেন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদিকে। একটা কথা প্রচারিত ছিল যে নরেন্দ্র মোদি শিল্প প্রতিষ্ঠায় খুবই আগ্রহী এবং তিনি গুজরাটে বহু শিল্প কারখানা গড়ে তুলেছেন। অথচ গুজরাট আগে থেকেই শিল্প সমৃদ্ধ ছিল। ব্রিটিশের সময়ে গুজরাটের আহমেদাবাদ শহরকে ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার বলা হতো। আহমেদাবাদ বস্ত্রশিল্পের নগরী। তেজপুর, পোর বন্দর, জামনগর, গুজরাটের এ শহরগুলোও ব্রিটিশের সময় থেকে শিল্প সমৃদ্ধ।

২০০২ সালে নরেন্দ্র মোদি যখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হন তখন ভারতীয় রফতানিতে গুজরাট রাজ্যের অবদান ছিল ১৭ শতাংশ আর সেই হার এখনও অব্যাহত আছে। মোদি শিল্পে গুজরাটে বিপ্লব ঘটিয়েছিল এটা কল্পকাহিনি। তবে দৌড়াদৌড়ি ছুটাছুটিতে তার জুড়ি নেই। বাকবিভূতিতেও তিনি অদ্বিতীয়। এই দুই গুণেই তিনি ভারতের শীর্ষস্থানে পৌঁছেছেন।

২০১৪ সালে বিজেপির গোয়া বৈঠকে তাকে লোকসভা নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রীর প্রার্থী ঘোষণা করা হলো। টাইমস আর ইকোনোমিস্ট পত্রিকা বলেছিলো ভারতীয় ধনবাদী গোষ্ঠী ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে ৭/৮ হাজার কোটি টাকা মোদিকে প্রধানমন্ত্রী করার জন্য খরচ করেছিলেন।

আম্বানিরা ভারতের মিডিয়া মোগল। সমস্ত মিডিয়া মোদির প্রচারে নিয়োজিত ছিল। নরেন্দ্র মোদি কোনও উচ্চবংশ থেকে আসেননি। তার বাবা ছিলেন রেল স্টেশনের চায়ের ফেরিওয়ালা। ছোটকাল থেকে তিনি আরএসএস-এর ক্যাডার। শিক্ষাদীক্ষায়ও উচ্চশিক্ষিত নন। হারিয়ানার কোনও এক কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেছিলেন। যদিওবা তার পার্টির কমরেডরা দাবি করেছিলেন যে তিনি এম.এ. পাস। তিনি কখনও নেহরু, ইন্দিরা, রাজীব বা রাহুলকে সম্ভ্রম করে কথা বলতেন না।

তিনি কংগ্রেসকে ভারত থেকে উচ্ছেদ করার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছেন বারবার। ১৩৩ বছরের একটা প্রাচীন দলকে উচ্ছেদের কথা বলে নরেন্দ্র মোদি ভারতীয় গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষের গণতান্ত্রিক অনুভূতিতে আঘাত করেছেন বলে মনে হয়।

কংগ্রেস ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম করেছে, গান্ধী, নেহরু, বল্লভ ভাই প্যাটেল, মাওলানা আবুল কালাম আজাজের নাম এ সংগঠনটার নামের সঙ্গে জড়িত। ভারতে দুইটা রাজনৈতিক দলকে তার ভক্তরা ভূমিদান করেছিলেন যেন চলার পথে কোনও দুর্ভোগ পোহাতে না হয়। একটা ভারতীয় কংগ্রেস আর একটা কমিউনিস্ট পার্টি। তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন করা সহজ কথা নয়। জনতা পার্টির স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে কোনও সস্পর্ক নেই। অটল বিহারী বাজপেয়ী, এল কে আভদানী, নরেন্দ্র মোদি কারো স্বাধীনতা সংগ্রামে দু-পয়সার অবদান নেই। তারাই যদি বলে একটা ঐতিহাসিক দলকে ভারতের মাটি থেকে উচ্ছেদ করে দেবে তবে ভারতের সাধারণ মানুষ তো তা কখনও মেনে নেবে না। বরং তারা মনক্ষুণ্ন হবে।

মনমোহন সিং দ্বিতীয়বার যখন সরকার গঠন করেন তখন আঞ্চলিক দলগুলোর বাড়াবাড়ি ছিল অতিরিক্ত, যার কারণে গুড গভর্নেন্স ছিল না এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতিও ছিল না এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতিও ছিল স্থবির। যে কারণে সর্বব্যাপী নৈরাশ্যের মধ্যে মানুষ যেমন সামান্য আলোকে উদীয়মান সূর্য মনে করে, তেমনি ভারতীয় জনতা বিভ্রান্তিতে পড়ে নরেন্দ্র মোদিকে সূর্য মনে করেছিল। এখন যখন পাঁচ বছর সময়টা অতিক্রম হলো তখন নরেন্দ্র মোদির গত নির্বাচনের আগে দেওয়া প্রতিশ্রুতি ও তার বাস্তবায়নের হিসাব সাধারণ মানুষ করবেই। সাধারণ মানুষ ধর্মান্ধ আরএসএস-এর ক্যাডার নন। তারা সাধারণ অরাজনৈতিক মানুষ তাদের মতের পরিবর্তন হবেই।

মোদি নির্বাচনের সময় নিজেকে যত কর্মপটু বলে জাহির করেছিলেন, গত পাঁচ বছরের কর্মকাণ্ডে তা প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। দলে তার ও অমিত শাহর কর্তৃত্ববাদী ভূমিকার কারণে প্রবীণরা বিক্ষুব্ধ। মন্ত্রিসভায়ও মোদি মন্ত্রিসভা সদস্যদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেন না, বিশেষ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং দেশরক্ষামন্ত্রী তার হস্তক্ষেপে তারা তিক্ত বিরক্ত হয়ে গেছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ বলেছেন, তিনি আগামী লোকসভা নির্বাচনে আর প্রতিদ্বন্দ্বিতাই করবেন না। সুষমা স্বরাজ, মুরলি মনোহর যোশী, সুমীত্রা মহাজন, এলকে আদভানী– এরাই এখন বিজেপির প্রবীণ নেতা। মোদির জামানায় এদের কথার কানাকড়ির মূল্য নেই। মোদি আর আমিত শাহ-ই এখন সর্বেসর্বা। সর্বেসর্বা হওয়াতে বিপদও আছে। ব্যর্থতার দায়ও এককভাবে নিতে হয়।

নরেন্দ্র মোদি আরএসএস-এর ক্যাডার। সুতরাং তিনি সাম্প্রদায়িক হবেনই। কিন্তু তিনি সাম্প্রদায়িকের চেয়েও অতিরিক্ত সাম্প্রদায়িক। ২০০২ সালে গুজরাটে তার মুখ্য মন্ত্রীত্বের সময়ে তার নেতৃত্বেই দাঙ্গা হয়েছে। সেই দাঙ্গায় তিনি নির্বিচারে মুসলিম হত্যা করেছেন। ভারতের প্রত্যেক প্রধানমন্ত্রী রমজান মাসে ইফতার পার্টির আয়োজন করে থাকেন। এমনকি অটল বিহারী বাজপেয়ী যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তখনও ইফতার পার্টি হয়েছে। কিন্তু নরেন্দ্র মোদির সময় সিনিয়র মন্ত্রীদের অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি কোনও ইফতার পার্টির আয়োজন করেননি।

মোদি ক্ষমতা আসার পর গরুর মাংস খাওয়া নিয়ে ভারতব্যাপী যে উত্তেজনা সৃষ্টি করলো তাতে চারজন মুসলমানকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ঘরওয়াপসি কর্মসূচি দিয়ে সংখ্যালঘু মুসলমানদের জোর করে হিন্দু ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করতে চেয়েছিল, তাও ব্যর্থ হয়েছে। বিশ্বে অনেক ধর্ম রয়েছে কিন্তু মুসলমান আর ইহুদিরা সহজে ধর্মত্যাগ করেন না।

রাফায়েল বিমান ক্রয় নিয়ে যে কেলেঙ্কারির কথা প্রকাশ পেয়েছে তাতে মোদি কোনও জবাব দেননি। রাহুল বলেছেন, মোদি চোর। ৩০ হাজার কোটি টাকা রাফায়েল বিমান ক্রয়ে মোদি আম্বানীকে পাইয়ে দিয়েছেন। নোট বাতিলের কারণে দেশের সাধারণ মানুষের প্রচুর ক্ষতি হয়েছে। যে দুই কোটি লোকের চাকরি সৃষ্টি করার কথা দিয়েছে সে কর্মসূচি সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে।

গুজরাটে মরা গুরুর চামড়া সংগ্রহ করতে গিয়ে নিম্নবর্ণের লোকেরা নির্যাতনের শিকার হয়েছে এবং মুচি সম্প্রদানের দু' যুবককে গো-রক্ষা সমিতির লোকেরা পিটিয়ে মেরেছে। এখন মোদির সময় শেষ। মোদিকে আর দেখার কিছুই নেই। সাম্প্রতিক বিধানসভা নির্বাচনে মোদি ৫টি রাজ্যের মধ্যে একটি রাজ্যেও সরকার গঠন করতে পারেননি। অথচ মধ্য প্রদেশ, ছত্তিশগড় আর রাজস্থানে বিজেপির সরকার ছিল। এখন সেখানে কংগ্রেস সরকার গঠন করেছে। ২৭টি লোকসভার উপনির্বাচন হয়েছে, তাতে ২৫টি লোকসভার আসন পেয়েছে বিরোধীরা।

আমরা একটা বিষয় লক্ষ করেছি, ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে ভারতীয় ভোটারদের যে আস্থা মোদি গড়ে তুলতে পেরেছিলেন তার সে আস্থার অবসান হয়েছে। কোনও কথাই তিনি রক্ষা করতে পারেননি। সুতরাং ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে লোকসভার যে নির্বাচন হবে তাতে মোদির পরিপূর্ণ পরাজয় অবধারিত। মোদি আইন আদালত, ইন্ডিয়া রিজার্ভ ব্যাংক, সিবিআই সবকিছুরই কর্তৃত্ব নিজ হাতে নিয়ে ফ্যাসিবাদী সরকার কায়েম করতে চেয়েছিলেন। তাতে সফল হলে ভারতের ঐক্য ও সংহতি বিনষ্ট হবে– এ কথা ভারতের মানুষ শতভাগ উপলব্ধি করেছেন বলে মনে হয়। সুতরাং ভারতীয় জনতা আগামী লোকসভা নির্বাচনে মোদিকে আর ক্ষমতায় ফিরে আসতে দেবে না।

লেখক: সাংবাদিক

[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বিএসএমএমইউ’র দায়িত্ব নিয়ে যা বললেন নতুন ভিসি
বিএসএমএমইউ’র দায়িত্ব নিয়ে যা বললেন নতুন ভিসি
বাজেটে শিক্ষা খাতে ১৫ শতাংশ বরাদ্দের দাবি
বাজেটে শিক্ষা খাতে ১৫ শতাংশ বরাদ্দের দাবি
ডিএনসিসির কাওরান বাজার আঞ্চলিক অফিস যাচ্ছে মোহাম্মদপুরে
ডিএনসিসির কাওরান বাজার আঞ্চলিক অফিস যাচ্ছে মোহাম্মদপুরে
ভাতা বাড়ানোর আশ্বাসে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের কর্মবিরতি প্রত্যাহার
ভাতা বাড়ানোর আশ্বাসে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের কর্মবিরতি প্রত্যাহার
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ