X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

ব্লগার অর্পিতা রায় চৌধুরীর আত্মহত্যা, কেন?

দাউদ হায়দার
২০ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৫:৩৬আপডেট : ২০ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৬:৪৪

দাউদ হায়দার তমালিকা সিংহ ওরফে অর্পিতা রায় চৌধুরী কেন আত্মহত্যা করলেন, কাউকে জানতে দেননি, পূর্বাভাসও টের পাওয়া যায়নি, কোনও নোটও (সুইসাইড) আবিষ্কৃত হয়নি। আত্মহত্যার কারণ কী, আন্দাজে বলা দুষ্কর। তবে, অনুমান করতে পারি। অনুমানও ঠিক নয় হয়তো। (যদিও আত্মহত্যা কিনা- সেই বিষয়ে জার্মান প্রশাসন কিছু নিশ্চিত করেনি)।
অর্পিতা রায় চৌধুরীকে চিনতুম না। নামও অপরিচিত। বছর দেড়েক আগের ঘটনা হবে (কিংবা তারও কম।)। গ্রীষ্মের এক দুপুরে জুবায়েন সন্ধি নামের একজন ব্লগার ফোন করেন। দেখা করতে চান। আন্তর্জাতিক লেখক সংস্থা (PEN), জার্মান শাখার (জার্মান পেন) পরিচালক ফোনে জানান বাংলাদেশের ব্লগার সন্ধির নাম, পেন-এর পক্ষ থেকে বার্লিনে আশ্রিত।
অভিজিৎ রায়, দীপন প্রমুখের (প্রত্যেকে ব্লগার, একজন সম্পাদক) হত্যাকাণ্ডের পরে বহু ব্লগার আত্মগোপনে, বিদেশি সরকারের সহায়তায় (মূলত পেন, মানবাধিকার সংস্থা।) কেউ কেউ দেশ ছেড়েছেন। একা বা পরিবার নিয়ে। বাঁচার তাগিদায়। পশ্চিম ইউরোপসহ স্ক্যান্ডেনিভিয়ান দেশে ডজনখানেকের বেশি ব্লগার ঠাঁই পেয়েছেন। ব্লগে নিয়মিত লেখালেখি করেন। ধর্মাধর্ম আর গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয় তেমন। লেখেন চলতি ঘটনাবলি। কেউ কেউ আবার ব্লগে খুব জাহির করেন নিজেদের। অধিকাংশই বানোয়াট। শুদ্ধ বাংলাও লিখতে শেখেননি অনেকে। কয়েকজনের লেখা পড়েছি। অতীব বাজে, অপাঠ্য। বিদেশে আশ্রয় পেয়ে নিজেকে ফলাও করার, ঢোল পেটানোর এই তো মওকা।

সন্ধিকে দেখা করা অনুমতি দিই। বিকেলে আসেন, সঙ্গে তরুণী। বয়স ২৪/২৫ হবে। কম বা বেশি। ছোটখাটো গঠন। সাকুল্যে লম্বা সাড়ে চার ফুটও নয়। একেবারে পাতলা। ওজন বোধ হয় ২৫ কেজির কম। লাবণ্যমাখা কচিমুখ। মনে হতে পারে সদ্য কিশোরী। কিন্তু চোখের চাহনি বুদ্ধিদীপ্ত। চোখ দুটি উজ্জ্বল। চোখেই নানা জিজ্ঞাসা বিচ্ছুরিত।

সন্ধি পরিচয় করিয়ে দেন, ‘ওঁর নাম অর্পিতা রায় চৌধুরী। ব্লগার। এই নামেই লেখেন। লেখার বিষয় বিস্তর। আসল নাম তমালিকা সিংহ।’ বলি, আমাদের এক ভাগ্নির নাম তমা।

সলজ্জ হেসে তমার উত্তর, “আপনাকে মামা বলবো।”

এই আবদারে, অবাক কাণ্ড, “আপনার জন্যে শুঁটকি মাছ নিয়ে এসেছি বাংলাদেশ থেকে। এই শুঁটকিতে গন্ধ নেই।”

এরকম উপহার কখনও পাইনি, এঁকে অচেনা, তায়, প্রথম সাক্ষাৎ।

বাংলাদেশ থেকে যারা দেখা করতে আসেন বেশিরভাগই ফেলে আসা বন্ধুবান্ধব। কখনও লেখক, পাঠক, সাংবাদিক, সম্পাদক, প্রকাশক। রাজনীতিক। সরকারি আমলাও। উপহার আনেন বইপত্র/পত্রিকা। শার্ট। পাঞ্জাবি। শাল। একবার গুনে দেখি (গত বছর), নানা বাহারি পাঞ্জাবি, সংখ্যা সাতচল্লিশ।

শুঁটকি মাছ পেয়ে আনন্দিত, রান্না করতে জানিনে, রান্নার ভার দিই তমাকেই। অর্পিতা রায় চৌধুরী ব্লগার, কী লেখেন পড়িনি, শুনলুম, লেখার কারণে মৌলবাদীদের রোষ, ফতোয়াও দিয়েছে, হত্যার পরোয়ানাও। পলাতক। দেশছাড়া। পেন-ই উদ্ধার করেছে, স্কলারশিপ দিয়ে বার্লিনে নিয়ে এসেছে। ঘাতকের হাত থেকে বাঁচবে।

তমালিকা সিংহ ওরফে অর্পিতা রায় চৌধুরীর লেখা পড়তে চাই, এই চাওয়ায় এতটাই লজ্জিত, পাতালে তলিয়ে যেতে চান। “আপনাকে আমার লেখা পড়াব? তুলোধুনা করবেন। লাঠি ছাড়াই পেটাবেন। না, পড়তে দেব না।”-বলেন। সন্ধির কাছে কৃতজ্ঞ, তিনি, অর্পিতার কয়েকটি লেখা পাঠান ইমেইলে। পড়ে বিস্মিত। চমৎকার বাংলা। নানা বিষয়ে লেখা। যুক্তি-বিশ্লেষণ বুদ্ধিযোগীর। আর-পাঁচজন লেখক থেকে আলাদা। প্রশ্নের সঙ্গে যুক্তি, যুক্তির সঙ্গে বিশ্লেষণ, বিশ্লেষণে ইতিহাস-দর্শন-রাজনীতির বিপুল সমাহার, তথ্য। ফাঁকি কোথাও। তথাকথিত নারীবাদী ‘লেখিকা’ নন। কেউ-কেউ নারীবাদী ‘লেখিকা’ যেমন বাগাম্বড়ে নিজেকে জাহিরে দিশেহারা।

অর্পিতার লেখা পড়লেই বোঝা যায়, নারী হয়েও নারীবাদীর ঊর্ধ্বে, বিস্তর লেখাপড়া তাঁর। পড়া নয় কেবল, পড়ার সঙ্গে চিন্তা, বুদ্ধির সংযোজন।

অর্পিতা অনেকবারই দেখা করেছেন, বাড়িতে এসেছেন, এসে, “আপনাকে জ্বালাতন করছি।” মধুর স্বরে কথা।

-বাড়িতে নয় শুধু, নানা জায়গায়।

শেষ দেখা কিছু দিন আগে। বিমর্ষ চেহারা। জিজ্ঞেস করি, ‘হেতু কী।’ নিজেকে খুব প্রকাশিত করেন না, বললেন, “ভালো আছি।” ভালো নেই, চোখমুখ বলছে। স্বীকার করেন। মলিন কণ্ঠে জানান, “এদেশে আমার কে আছে? এখানে কী আছে? দেশ-ভাষা-সংস্কৃতি-আত্মীয়স্বজন-বন্ধুবান্ধব ছেড়ে এখানে কেন আছি? এই বাঁচার মানে কী? বন্ধু বলতে সন্ধি আর আপনি। কথা বলবারও কেউ নেই। আপনারও সময় নেই। আপনার দেখা পাওয়াও সহজ নয়।” বুঝে নিই, গভীরতর অসুখ তাঁর, ফ্রাসটেশনে আক্রান্ত। মানুষের যখন ফ্রাসটেশন শুরু হয়, বিপ্লবী যখন কূলকিনারা পায় না, চারদিকে অথই আঁধার, জীবনকে তুচ্ছ মনে হয়। বিদেশবিভুঁই অনাত্মীয়।

সন্ধি জানিয়েছিলেন, ‘মনোরোগের ডাক্তার দেখানো হয়েছিল। তারপরেও সুস্থতা বা অসুস্থতার বিশদ জানায়নি অর্পিতা।’

সন্ধির ফোনেই জেনেছি অর্পিতার মৃত্যু (আত্মহত্যা)। দেশ ছেড়ে বিদেশবিভুঁইয়ে মৃত্যু বা আত্মহত্যা কোন দুঃখে, কোন ক্ষোভে, নিশ্চয় কারণ আছে। আপনমুগ্ধ দেশও কী এর জন্য দায়ী নয়?

লেখক: কবি ও সাংবাদিক

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ