X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

নির্বাচনি প্রচার এবং প্রত্যাশা

আনিস আলমগীর
২৫ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৩:৫৮আপডেট : ২৫ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৩:৫৯

আনিস আলমগীর সেনাবাহিনী নিয়ে ড. কামাল হোসেনদের এত অতি উৎসাহ কেন বুঝলাম না। আগামী ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচনের ছয় দিন আগে মাঠে নেমেছে সেনাবাহিনী। বলা হয়েছে তারা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্যে প্রশাসনকে সহায়তা করার জন্য ‘স্ট্রাইকিং ফোর্স’ হিসেবে কাজ করবে। মানে তারা ২৪ ডিসেম্বর থেকে ২ জানুয়ারি পর্যন্ত জননিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবে, সিভিল প্রশাসনের অধীনে কাজ করবে। কিন্তু মাঠে নামার প্রথম দিনেই সংবাদ সম্মেলন করে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আহ্বায়ক ও গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেন আফসোস করছেন, ‘নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েনের পরও হামলার ঘটনা অপ্রত্যাশিত।’
নিশ্চয়ই যেকোনও হামলা অপ্রত্যাশিত। কিন্তু নির্বাচনে হামলা-মামলা তো এই দেশে সাধারণ ঘটনা। সেনাবাহিনী নামার পরপরই বিপ্লবী কিছু প্রত্যাশা তো অতি উৎসাহের ফল, অতিরিক্ত চাওয়া। ড. কামাল গং যদি সেনাবাহিনীকে সাধারণ প্রশাসনিক কাজে হস্তক্ষেপ করার জন্য উসকানি দিতে চান সেটি ভালো ফল বয়ে আনাবে না। যে পক্ষই করুক না কেন, নির্বাচনি প্রচারে কোনও প্রার্থীর ওপর, তার সমর্থকদের ওপর হাঙ্গামা যেমন গ্রহণযোগ্য নয়, তেমনি নির্বাচন বলে অপরাধীদের গ্রেফতার থেমে থাকাও কাজের কথা না। যারা মানুষ হত্যা করেছে, আগুনে পুড়িয়ে এতদিন পালিয়ে ছিল, নির্বাচন উপলক্ষে তারা গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াবে সেটা নিশ্চয়ই ড. কামালের প্রত্যাশা হতে পারে না।

এবারের নির্বাচনে একটি বহুল প্রচারিত বিষয় হচ্ছে বিরোধীদল প্রচারের সুযোগ পাচ্ছে না, মাঠেও নামতে পারছে না। একুট পেছনে তাকান। এবারের নির্বাচনি প্রচারের প্রথম দিনেই আওয়ামী লীগের দুইজনকে হত্যা করেছে বিএনপি সমর্থকরা। মামলা হয়েছে। গ্রেফতার হয়েছে। নির্বাচনি প্রচারের শুরুতেই মনোনয়নপত্র কিনতে গিয়ে নয়াপল্টনে পুরনো স্টাইলে পুলিশ পিটিয়েছে, তাদের গাড়ি ভাঙচুর করেছে। সে ঘটনায়ও মামলা হয়েছে। গ্রেফতার হয়েছে।

মানুষের মনে যে বিএনপিকে নিয়ে ভয়, বিএনপি ক্ষমতায় এলে প্রতিহিংসার রাজনীতিতে নেমে এরা খুনের বন্যা বয়ে দেবে– তার জন্য কি বাড়তি গবেষণা করার দরকার আছে? বিএনপি নেতারা তাদের সব অনুষ্ঠানে ক্ষমতায় এলে প্রতিহিংসায় জড়াবে না বলে যতই আশ্বস্ত করার চেষ্টা করুক– মানুষকে বিশ্বাস করানো কঠিন। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে প্রতিপক্ষের ওপর যে তাণ্ডব তারা করেছে, সংখ্যালঘুদের ওপর যে অত্যাচার নেমে এসেছিল– সেসব এখনও অনেকের স্মৃতিতে রয়ে গেছে। রাজনৈতিক মোকাবিলা চায় না, সুযোগ পেলেই এরা প্রতিপক্ষকে মেরে শেষ করে দিতে চায়। বিএনপির এ এক অদ্ভুত রাজনীতি!

পরিস্থিতি যখন এমন, নির্বাচনি প্রচারে বিএনপি জামায়াতের গতিবিধি কিছুটা চাপের মুখে পড়বেই এবং পড়েছেও– তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সম্ভবত ২০১৪ সালের নির্বাচনের অভিজ্ঞতার কারণে সরকার তাদের প্রতি কড়া নজর রেখেছে। তাদের মিছিলের আগে পিছে পুলিশ লেগে আছে। কিন্তু এটাকে যদি বিএনপি ইস্যু করে বসে থাকে, নির্বাচনে সহানুভূতি আদায়ের কৌশল হিসেবে নেয় বলার কী আছে! চট্টগ্রাম মহানগরসহ অনেক স্থানে তারা সমানে সমান প্রচারণা চালাচ্ছে। ঢাকায় প্রচার একেবারেই কম। ২৫ ডিসেম্বর তারা ঢাকায় নির্বাচনি প্রচার বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছে। কেউ কেউ যে বলছেন নির্বাচন বানচালের একটা ষড়যন্ত্রও চলছে- সেটাকে দেখছি একেবারে অবহেলা করা যাচ্ছে না। 

তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে উপদ্রুপবিহীন নির্বাচন কল্পনাও করা যায় না। এর মানে এই নয় যে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নেই। শান্তিপূর্ণ অবস্থা বিরাজ না করলে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড কিছুটা ব্যাহত হবেই। দুটি বৃহৎ দল নির্বাচনের মাঠে আছে। সুতরাং কিছু যে মারামারি কাটাকাটি হবে না, তা তো নয়। বিহার বিধানসভার নির্বাচনে ১৪৭ জন লোক মারা গিয়েছিল। কাশ্মির বিধানসভার নির্বাচন সামরিক বাহিনীর ঘেরাওর মাঝে অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

নির্বাচন নিয়ে হামলা সংঘর্ষ প্রতিদিন ঘটছে। দু’পক্ষই আহত হচ্ছে সারা দেশে। বিএনপির ৪/৫ জন প্রার্থী সরাসরি আঘাতের শিকার হয়েছে। এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের চারজন কর্মী নিহত হয়েছেন। মন্ত্রী শাজাহান খানের বাডির সামনে রাখা দুটি ট্রাক আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে। নোয়াখালী-৪ আসনের বিএনপি প্রার্থী মোহাম্মদ শাহজানের কর্মীরা আওয়ামী লীগ কর্মী মো. হানিফের চোখে মরিচের গুঁড়া মেরে তাকে মাটিতে ফেলে ইট দিয়ে মাথা থেঁতলে হত্যা করেছে। বিএনপির এসব নির্মমতা অনেকটা তাদের জেনেটিক অভ্যাস। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই কারণেই নাকি তাদের চাপে রাখা হয়েছে, অন্যথায় নির্বাচনকে ঘিরে হত্যার হাট বসাতো বিএনপি।

অবশ্য এটাও ঠিক, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে এসব ঘটনার জন্য নির্বাচন ব্যাহত হয় না, বন্ধ থাকে না। এটা অনেকটা উত্তেজনাপূর্ণ নির্বাচনের স্বাভাবিক পরিণতি। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড, এ শব্দটা পূর্বে কখনও ছিল না। এটা আমাদের সুশীল সমাজের নব সংযোজন। এ শব্দটা পাকিস্তানের নির্বাচনে বা ভারতের নির্বাচনেও উচ্চারিত হতে শুনিনি। আমাদের সুশীলরা যে নির্বাচনের চিত্র কল্পনা করেন তা স্বর্গে ছাড়া সম্ভব নয়। কম-বেশ ত্রুটি বিচ্যুতি থাকবেই। আমেরিকার বয়স আর তাদের শাসনতন্ত্রের বয়স সমান। এই প্রাচীন দেশটার নির্বাচনেও বহু ত্রুটি বিচ্যুতির কথা আমরা শুনি। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির মতো কেলেঙ্কারিও হয়েছে; যে কারণে প্রেসিডেন্ট নিক্সন পদত্যাগ করে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। জুনিয়র বুশ প্রথমবার যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন তাতেও ব্যাপক কারচুপি হয়েছিল। আলগোরকে সুপ্রিম কোর্টের বিতর্কিত সিদ্ধান্তে পরাজয় মেনে নিতে হয়েছিল। ট্রাম্পের নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তো এখনও চলমান।

এবারের একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করেছে সত্য কিন্তু ড. কামালকে নিয়ে নির্বাচনকে বিতর্কিত করতে তাদের অভিযোগের কোনও অন্ত নেই। অভিযোগের ধরনও অভিনব। স্থানীয় থানার ওসি থেকে জাতিসংঘের মহাসচিব পর্যন্ত তাদের অভিযোগের সীমানা বিস্তৃত। সালুনে ব্যঞ্জনে বিদেশিদের কাছে দৌড়ে গিয়ে নালিশ করা তাদের অভ্যাস। এভাবে বিদেশি রাষ্ট্রদূতরা যে আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপের একটা সুযোগ পাচ্ছে এবং শেষ পর্যন্ত তারা যে জেনেভা কনভেনশন ভাঙার সুযোগ গ্রহণ করবে সে ব্যাপারে বিএনপি সম্পূর্ণ অমনোযোগী। 

আসলে জিয়াউর রহমান খুবই ধূর্ত প্রকৃতির লোক ছিলেন। তিনি বিএনপি গঠন করার সময় দেশের সমস্ত আওয়ামী বিরোধী শক্তিগুলোকে একত্রিত করে বিএনপি দাঁড় করিয়েছিলেন। আবার সম্প্রদায়িক দলগুলোকে বিশেষ করে জামায়াত ইসলামীকেও আত্মপ্রকাশের সুযোগ করে দিয়েছিলেন। বিএনপি এবং জামায়াত ইসলামী মিলেমিশে এখনও আওয়ামী বিরোধী রাজনীতি উজ্জীবিত রেখেছে এবং তারা বিশেষ করে বিএনপি মনে করে যে ইসলাম পছন্দ জনগোষ্ঠী তাকেই সমর্থন দিয়ে যেতে হবে। কারণ তারা ইসলামিস্টও নন আবার ধর্মনিরপেক্ষ অসম্প্রদায়িক রাজনীতিও করেন না। তারা ঘুষও নেবে, মিথ্যাও বলবে। সুযোগ পেলে রাষ্ট্রীয় সম্পদও আত্মসাৎ করবে আবার তারা ‘ইসলাম পছন্দ’ভুক্তও থাকবে। 

বিএনপির রাজনীতি অভিনব পন্থার রাজনীতি। এ জন্য কাজের চেয়ে অভিযোগ বেশি। অনেক স্থানে তারা পোস্টার লাগায়নি অথচ অভিযোগ হচ্ছে তাদের পোস্টার ছিঁড়ে ফেলা হচ্ছে। ডিজিটাল প্রচারেও তাদের কেউ বাধা দিয়েছে? ফোন কোম্পানিগুলোকে দিয়ে ভোটারদের একটা রেকর্ড করা ফোন দিতেও তাদের বাধা দেওয়া হচ্ছে? নিজেদের কোনও গৌরবের কাজ নেই, আওয়ামী লীগের ছিদ্র অন্বেষণকে পুঁজি করে তিন দশকের বেশি সময় রাজনীতিতে টিকে আছে বিএনপি। একসময়ে কিছু অভিজ্ঞতাসম্পন্ন নেতা ছিলেন, এখন অধিকাংশ প্রবীণ নেতা মরে গেছেন। এখন তাদের মাঝে নেতৃত্ব শূন্যতা প্রবল। মেধাহীনদের বিপুল সমাবেশ।

একটা গুজব ছিল যে নির্বাচন উপলক্ষে সেনাবাহিনী মাঠে নামলে বিএনপি খুবই তৎপর হবে এবং আওয়ামী লীগের ওপর সর্বপ্রকার চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করবে। প্রয়োজনে আইনশৃঙ্খলার অবনতি হলেও তারা পিছপা হবেন না। ঐক্যজোট নেতাদের মনে রাখা উচিত, দেশের মানুষ নির্বাচনে কোনও গোলযোগ হোক তা কামনা করে না। সুতরাং তাদের এমন কোনও পরিকল্পনা থাকলেও তারা তা থেকে বিরত থাকা উচিত। অবশ্য ড. কামাল হোসেন বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ লাগামহীন হলে পরকালে হলেও তাদের জবাবদিহি করতে হবে’ ড. কামাল যখন পরকালের ওপর ভরসা করলেন তখন ইহকালে যে কিছু করতে পারবেন না, তা বুঝে নিতে কষ্ট হয় না। হাঁকডাকই সম্ভবত ভরসা। তাই থাক।

আগামী ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮ দেশে একাদশ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার তারিখ। দেশের সাধারণ মানুষ নির্বাচন নিয়ে উৎসবে মেতে আছে। শঙ্কায়ও রয়েছে। এখন আওয়ামী জোট এবং বিএনপি জোটের উচিত একদিন নিজেদের সংযত রেখে দেশে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহায়তা করা। দেশের মানুষ একটা শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চায়। অর্থপূর্ণ নির্বাচন চায়। এবারের নির্বাচন আগের যেকোনও নির্বাচন থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ