X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

পরিবর্তন না প্রত্যাবর্তন?

প্রভাষ আমিন
২৯ ডিসেম্বর ২০১৮, ২০:১৪আপডেট : ২৯ ডিসেম্বর ২০১৮, ২০:১৬

প্রভাষ আমিন আগামীকাল ৩০ ডিসেম্বর, হতে পারে বাংলাদেশের রাজনীতির মোড় ঘোরানো দিন। আকাশে-বাতাসে, চায়ের টেবিলে, পত্রিকার পাতায়, টেলিভিশনের টক শো’য় অসংখ্য প্রশ্ন। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন—পরিবর্তন না প্রত্যাবর্তন? বাংলাদেশের রাজনীতির স্বাভাবিক প্রবণতা হলো পরিবর্তন। আপনি যত ভালো কাজ আর উন্নয়নই করুন, মানুষের মন পাওয়া সহজ নয়। বড় ভুল তো বটেই, ছোটখাটো ভুল বা এমপির একটু হামবড়া ভাবও মানুষ মনে রাখে। পাঁচ বছর পর মানুষ একবার নিজেদের ক্ষমতা প্রয়োগ করার সুযোগ পেলে পাল্টে দেয় চিত্র। এরশাদের পতনের পর ৯১ সালে  আওয়ামী লীগের সব হিসাব-নিকাশ উল্টে দিয়ে ক্ষমতায় আসে বিএনপি। ৯৬ সালেই আবার রায় আসে পরিবর্তনের পক্ষে। ২১ বছর পর ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। কিন্তু ২০০১ সালেই আবার পরিবর্তনের গল্প। খালেদা জিয়ার প্রথম আমল আর দ্বিতীয় আমলের মধ্যে আকাশ-পাতাল ফারাক। দ্বিতীয় দফায় তারা ক্ষমতায় আসে জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে। দ্বিতীয় দফায় নিজামী-মুজাহিদের গাড়িতে ওড়ে জাতীয় পতাকা। ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসেই দেশের বিভিন্নস্থানে প্রতিশোধের নেশায় মেতে ওঠে বিএনপি-জামায়াত। ওই সময়টা ছিল অন্ধকারের। বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করতে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় গ্রেনেড হামলা হয়েছে, জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটেছে প্রকাশ্য রাজপথে, প্রতিবেশী দেশে ব্যবহারের জন্য আনা হয়েছিল ১০ ট্রাক অস্ত্র, দুর্নীতি সীমা ছাড়িয়েছিল, ক্ষমতার বিকল্প কেন্দ্র নিয়ে সমালোচনা ছিল। নিয়ম মেনে আরেকটি পরিবর্তন যখন অবশ্যম্ভাবী; তখনই ভুয়া ভোটার তালিকা করে আর বিচারকদের অবসরের বয়স বাড়িয়ে পছন্দের ব্যক্তিকে প্রধান উপদেষ্টা বানানোর চেষ্টা, রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমদের প্রধান উপদেষ্টার পদ নেওয়া, রাজপথে প্রবল প্রতিরোধ আর সহিংসতা মিলে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। তখনই সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নেয়। পাল্টে যায় সব হিসাব-নিকাশ। দুই বছর পর ২০০৮ সালে আবারও পরিবর্তনের পক্ষে রায় দেয় জনগণ, নিরঙ্কুশ জয় পায় আওয়ামী লীগ। ২০১৪ সালেও পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষার গান শোনা গিয়েছিল। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে আগে অনুষ্ঠিত ৫টি সিটি নির্বাচনে জয় পায় বিএনপি। কিন্তু জনগণের পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করতে পারেনি দলটি। বরং জন-আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে গিয়ে নির্বাচন বর্জন করে। এরপর গত পাঁচ বছরে রাজনীতির হিসাব-নিকাশ পাল্টে গেছে।

আগামীকাল জনগণ ভোট দেবে। বাংলাদেশের রাজনীতির স্বাভাবিক প্রবণতায় এবারও পরিবর্তনের গল্প লেখার কথা। কিন্তু  ১/১১ এবং পরবর্তী ১০ বছরে অনেককিছু পাল্টে গেছে। তবে ক্ষমতাসীন দলের বিপক্ষেই ভোট দিতে হবে বা পরিবর্তন আনতেই হবে; এই ধারণার দূরে রেখে ভোট দেওয়ার বিষয়টি যৌক্তিকভাবেও আলোচনা করা যেতে পারে।

মানুষ কেন পরিবর্তন চায়? মানে মানুষ কেন আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে না? এই প্রশ্নের উত্তরে অনেকগুলো কারণ বলা যাবে। বিরোধী দলের সবচেয়ে বড় অভিযোগ, গণতন্ত্রহীনতা, একদলীয় শাসন কায়েম। সরকারবিরোধী নেতাদের বক্তৃতায় এই তালিকা অনেক লম্বা হয়ে যায়।  তাদের অভিযোগের মধ্যে রয়েছে, মত-প্রকাশের স্বাধীনতা না থাকা, দুর্নীতি, সুশাসনের অভাব, নির্বাচন ব্যবস্থার ক্ষতি, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন, ব্যাংকিং খাত ও শেয়ারবাজারে লুটপাট, আয়বৈষম্য, কোটাবিরোধী আন্দোলন, সাম্প্রদায়িক শক্তি হেফাজতের সঙ্গে আপস, সুন্দরবনের ঝুঁকির পরও রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে এগিয়ে যাওয়া, নিরাপদ সড়কের আন্দোলন, ছাত্রলীগের বাড়াবাড়ি, এমপিদের জনবিচ্ছিন্নতা ইত্যাদি ইত্যাদি। এ তালিকা চাইলে আরও লম্বা করা যাবে। যদিও বিরোধী দলের এ অভিযোগের বেশিরভাগই তর্কসাপেক্ষ। এর বিপরীতে অনেক যুক্তি আছে। তবে, একথা অস্বীকার করা যাবে না যে, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, বিরোধী দলকে দমনের অভিযোগ আন্তর্জাতিকভাবেও সমালোচনার মুখে ফেলেছে সরকারকে।

কে না জানে, কাজ বেশি করলেই ভুল হয়। কাজ না করলে কোনও ভুলই নেই। আওয়ামী লীগ ১০ বছরে অনেক কাজ করেছে। তাই কিছু ভুল হাওয়াটাই স্বাভাবিক। ভুলের জন্য শেখ হাসিনা ক্ষমাও চেয়েছেন। ক্ষমা চাওয়ার এই ঔদার্য্য সবার থাকে না। ক্ষমা চাইতেও সাহস লাগে, সততাও।

কিন্তু মজাটা হলো আওয়ামী লীগকে কেন ভোট দেবেন, এই তালিকাও অনেক লম্বা। আমার বিবেচনায় এক নম্বর কারণ—বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার, মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় এ দু’টি বিচারের মাধ্যমে জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করা হয়েছে। তবে আওয়ামী লীগের  বিবেচনায় সবচেয়ে বড় যুক্তি হলো–উন্নয়ন। সব সরকারের আমলেই কিছু না কিছু উন্নয়ন হয়। সবাই হাঁটে, তাই কিছু না কিছু অগ্রগতি হয়। কিন্তু এটা মানতেই হবে, গত ১০ বছরে আওয়ামী লীগ হাঁটেনি, দৌড়েছে। এ সময় বাংলাদেশের তাক লাগানো উন্নয়ন হয়েছে, আসলে বাংলাদেশ সবাইকে চমকে দিয়েছে। যেদিকেই তাকাবেন, সেদিকেই উন্নয়নের ছোঁয়া। উন্নয়নের রানওয়েতে দ্রুতগতিতে এগুচ্ছে সমৃদ্ধির বিমান। অপেক্ষা টেকঅফের। সরকারের ধারাবাহিকতা এই টেকঅফকে মসৃণ করবে, নইলে ওড়ার আগেই মুখ খুবড়ে পড়তে পারে। এই ১২ বছর আগেও লোডশেডিং ছিল  একটা বড় সমস্যা। বিদ্যুৎ উৎপাদনে নাটকীয় অগ্রগতি হয়েছে। মাথাপিছু আয় বেড়েছে, দারিদ্র্যের হার কমেছে। বাংলাদেশ এখন মধ্যম আয়ের দেশ, পা রেখেছে উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার পথে। এছাড়া, সব সামাজিক ও অর্থনৈতিক সূচকে এগিয়েছে বাংলাদেশ। বিশ্বব্যাংককে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু আমাদের অহঙ্কারের প্রতীক হয়ে বাস্তবতার আদল পাচ্ছে। পকেটে টাকা এলে সমাজে নিজেদের আসন পোক্ত করতে মানুষ কিছু ‘ফুটানি’ করে। বাংলাদেশের সেই ‘ফুটানি’ হলো সাবমেরিন ও স্যাটেলাইট। এ দু’টি কী কাজে লাগবে, তারচেয়ে বড় কথা, বিশ্ব সমাজে আমাদের মর্যাদা বেড়েছে। বাংলাদেশের কূটনৈতিক সাফল্যও কম নয়। ছয় দশকের সীমান্ত সমস্যা মিটেছে। সমুদ্রসীমা জিতেছি।

সর্বশেষ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে আন্তর্জাতিক মহলে সুনাম কুড়িয়েছে। এরআগে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। এখনও স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির নেতৃত্ব আওয়ামী লীগের হাতেই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উন্নত, সমৃদ্ধ, উদার, গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার লড়াইয়ে এখনও আওয়ামী লীগই সবচেয়ে এগিয়ে। সাম্প্রদায়িক শক্তি হেফাজতের সঙ্গে আপসকে অবশ্য আওয়ামী লীগ নেতারা কৌশল হিসেবে দেখেন। সরকারের যুক্তি হলো, কওমি মাদ্রাসার লাখ লাখ ছাত্রও তো বাংলাদেশের নাগরিক; আর সরকার তো শুধু আওয়ামী লীগের নয়, সবার। তাই সবাইকেই মূলধারায় শামিল করতে হবে। আওয়ামী লীগ সরকারের আরেকটা বড় বৈশিষ্ট্য হলো—কোনও বিষয়ে অযৌক্তিক জিদ ধরে না থাকা। আন্দোলনের মুখে আড়িয়াল বিলে বিমানবন্দর স্থাপন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভ্যাট আরোপের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে। নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। নীতিগতভাবে একমত না হয়েও কোটা বাতিল করেছে। তবে ভোটারদের কাছে আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় সাইনবোর্ড হলেন শেখ হাসিনা। তার ডায়নামিক নেতৃত্বই বদলে দিয়েছে বাংলাদেশকে। শেখ হাসিনা এখন আর নিছক বাংলাদেশের নেত্রী নন, বিশ্বসভায় তার ব্যক্তিগত ভাবমূর্তিও উজ্জ্বল-ঝলমলে। অনেক প্রার্থীই ভোট চাইছেন শেখ হাসিনার নামে। ‘যতদিন শেখ হাসিনার হাতে দেশ, পথ হারাবে না বাংলাদেশ’–এটাই আওয়ামী লীগের সবচেয়ে কার্যকর স্লোগান। শেখ হাসিনার সাফল্যের মুকুটে অনেক ঝলমলে মণি-মুক্তা। একটাই কালো পাথর–গণতন্ত্র ও নির্বাচন ব্যবস্থা। দলীয় সরকারের অধীনেও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব, এটা প্রমাণ করতে পারলেই তিনি নিজেকে নিয়ে যাবেন অনতিক্রম্য উচ্চতায়। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার মতো শেখ হাসিনার চেয়ে যোগ্য, দক্ষ আর কেউ এই মুহূর্তে বাংলাদেশে নেই। শেখ হাসিনা নিজেকে আওয়ামী লীগ, বিএনপির সাধারণ নেতৃত্ব বিবেচনার ঊর্ধ্বে নিয়ে গেছেন।

আওয়ামী লীগের যেমন সাইনবোর্ড শেখ হাসিনা, বিএনপির তেমন কেউ নেই। আসলে বিএনপিতে কেন, কোনও দলেই নেই, বাংলাদেশেই আর কেউ নেই। নির্বাচনে জিতলে কে প্রধানমন্ত্রী হবেন, এটাই এখনও ঠিক করতে পারেনি বিএনপি তথা ঐক্যফ্রন্ট। ড. কামাল নির্বাচন করছেন না, কোনও দায়িত্বও নেবেন না। যারা নির্বাচন করছেন, তাদের মধ্যে কেউও দায়িত্ব নেওয়ার মতো দক্ষ নন। তার মানে বিএনপি জিতলে দুর্নীতি মামলায় কারাগারে থাকা খালেদা জিয়া বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড নিয়ে পালিয়ে থাকা তারেক রহমানই হবেন তাদের নেতা। কিন্তু সেটা ঘোষণা করার মতো সৎ সাহস নেই বিএনপির।

আওয়ামী লীগকে কেন ভোট দেবেন, তার অনেকগুলো কারণ আছে। কিন্তু বিএনপিকে কেন ভোট দেবেন, এই প্রশ্নের ভালো কোনও উত্তর নেই। এমনকি বিএনপি নেতারাও এই প্রশ্নে আমতা আমতা করেন। আমরা গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করছি, এটুকু বলার পরে তারা আওয়ামী লীগের শাসনামলের বিবরণ দিতে শুরু করেন। তার মানে নিজেদের কোনও অর্জন নেই; তারা বসে আছে, আওয়ামী লীগের ওপর বিরক্ত হয়ে মানুষ দলে দলে মানুষ তাদের ভোট দেবে, সেই আশায়। গত ১০ বছরে তাদের কোনও অর্জন তো নেইই, তাদের সর্বশেষ শাসনামলের অন্ধকার সময়ের কথা মানুষ ভুলে গেছে, এটা ভেবেই তারা স্বস্তি পান। ভোটের নির্ধারক তরুণ ভোটাররা আওয়ামী লীগের শাসনামল দেখেছে, কিন্তু বিএনপির ‘দুঃশাসন’ তাদের স্মৃতিতে নেই। তবে এটা নিয়ে বিএনপির পুলকিত হওয়ার কিছু নেই। এখন আর তরুণ প্রজন্ম স্মৃতিশক্তির ওপর নির্ভর করে না। তারা ইতিহাস পড়ে তুলনা করতে পারে।

কেন বিএনপিকে ভোট দেবেন না, সে তালিকা বরং অনেক লম্বা।  গ্রেনেড হামলা, জঙ্গি উত্থান, ১০ ট্রাক অস্ত্র, দুর্নীতি, লোডশেডিংয়ের অন্ধকার সময়ে মানুষ আর ফিরে যেতে চাইবে না। বিএনপি সরকারি দল হিসেবে যতটা ব্যর্থ, বিরোধী দল হিসেবে তারচেয়ে বেশি ব্যর্থ।

২০১৪ সালের নির্বাচন ঠেকানোর নামে আর ২০১৫ সালে সে নির্বাচনের বর্ষপূর্তিতে বিএনপি যে নজিরবিহীন সহিংসতা আর পেট্রোলসন্ত্রাস চালিয়েছে, তার স্মৃতি মানুষ ভুলে যায়নি। এখনও শত পরিবারে স্বজন হারানোর কান্না। অনেকে শরীরে, অনেক মনে সেই পেট্রোল সন্ত্রাসের ভয়ঙ্কর স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছে। এই যে গত দশ বছরে, বিশেষ করে গত ৫ বছরে সংসদ শক্তিশালী বিরোধী দল পায়নি, তার দায়ও অনেকটাই বিএনপির। জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির জোট নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। কিন্তু বিএনপি জামায়াতকে ছাড়েনি।

এতকিছুর পরও ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে বিএনপির নির্বাচনে অংশগ্রহণের খবরে দারুণ আশাবাদ তৈরি হয়েছিল। মানুষ আবার গাইতে শুরু করেছিল পরিবর্তনের গান। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বিএনপি জিতবে, এমন কথা বলাবলি হচ্ছিল। কিন্তু বিএনপি সে আওয়াজটা আরো উঁচুতে তুলতে তো পারেইনি; বরং তাদের নিষ্ক্রিয়তা আর নিস্পৃহতায় সে আওয়াজ দ্রুতই হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। নির্বাচনের আগের দিন মাঠের ধারণা হলো, বিএনপির ‘হ্যাডম’ নাই। যেকোনোভাবে আওয়ামী লীগই জিতবে। তাই ভোট নষ্ট করে লাভ নেই। ২০ দিন আগেও যেখানে বিএনপির জয়ের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল, এখন সেখানে আলোচনা, বিএনপিকে দিলে ভোট নষ্ট হবে। এটা ঠিক, নির্বাচনের মাঠ সমতল ছিল না। পুলিশ, প্রশাসন, গণমাধ্যম সব একতরফা ছিল। নির্বাচনি প্রচারণা করতে নেমে বিরোধী প্রার্থীদের অনেকে হামলার শিকার হয়েছেন।

কিন্তু বিএনপিকে আমার নির্বাচনের ব্যাপারে, জয়ের ব্যাপারে সিরিয়াস মনে হয়নি। তাদের কোনও কিছুতে কোনও পরিকল্পনার ছাপ নেই, ভঙ্গি হাল ছেড়ে দেওয়ার। বিএনপির একজন ভাইস চেয়ারম্যান আমাকে বলেছেন, বিএনপির হারারও যোগ্যতা নেই। বড় জোর ৫০ আসন পেতে পারে। আরেক ভাইস চেয়ারম্যান আরো হতাশ–‘নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে এটা প্রমাণের জন্য সরকারি দলকে কারচুপি করে বিএনপিকে কিছু আসন দিতে হবে, নিজেদের যোগ্যতায় জিতে আসার সামর্থ্য নেই’। মনোনয়ন বাণিজ্যেই যেন বিএনপির নির্বাচন শেষ। নামকাওয়াস্তে ইশতেহার দিয়েছে। বিএনপির নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রথম বৈঠক হয়েছে ৫ দিন আগে, সবগুলো উপকমিটি গঠিতই হয়নি। ১২ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা একটি দলের মধ্যে যেমন মাটি কামড়ে পড়ে থাকা বা মরিয়া ভাব থাকার কথা, সেটা দেখা যাচ্ছে না। সারাদেশ যেমন তেমন, ঢাকা দেখলে মনে হবে বিএনপি নির্বাচন ছেড়ে দিয়েছে। দেশজুড়ে বিএনপির প্রচারণায় হামলার খবর যেমন ঠিক, আবার নির্বাচনি সহিংসতায় যে তিনজন মারা গেছেন, তারা সবাই আওয়ামী লীগের, এটাও তো ঠিক। বিএনপির পোস্টার লাগাতে দেওয়া হচ্ছে না বলে যেমন অভিযোগ রয়েছে, তেমনি এমন তথ্য পাওয়া গেছে যে, বিএনপির অনেকে পোস্টারই ছাপেননি।  ঢাকায় মির্জা আব্বাস, আফরোজা আব্বাস বারবার মাঠে নেমেছেন, বারবার মার খেয়েছেন বলেও বিএনপি অভিযোগ তুলেছে। তাতে তাদের প্রচারণা হয়েছে, মিডিয়ায় কাভারেজ পেয়েছেন, ভোটারদের সহানুভূতি পাবেন। কিন্তু ঢাকার বেশিরভাগ আসনেই বিএনপি প্রার্থীদের মাঠে দেখা যায়নি। হামলা হতে পারে, এই ভয়ে ঢাকা-১০ আসনের বিএনপি প্রার্থী আব্দুল মান্নান একদিনও প্রচারণায় নামেননি। তারপরও তিনি যদি আশা করেন, মানুষ দলে দলে তাকে ভোট দেবে, সেটা কি ঠিক হবে। ঢাকা-১০ আসনে মান্নান পাস করতে না পারলেও কি বিএনপি কারচুপির অভিযোগ আনবে? শুধু ঢাকা-১০ নয়, সারাদেশে অনেক আসনেই বিএনপির কোনও তৎপরতা দেখা যায়নি। বিএনপি আন্দোলনের অংশ হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। কিন্তু এখন তারা নির্বাচনেও নেই, আন্দোলনেও নেই। দেখেশুনে মনে হচ্ছে, দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়; নির্বাচনের পর এ অভিযোগটি করার জনই বিএনপির এত আয়োজন।

গত ১০ বছরে আওয়ামী লীগ যে উন্নয়ন করেছে, তাতে এমনিতেই তাদের জেতা উচিত। তারপরও আওয়ামী লীগ নির্বাচনের ব্যাপারে অনেক সিরিয়াস। তাদের নির্বাচন পরিচালনা কমিটি একবছরেরও বেশি সময় ধরে আলাদা অফিস নিয়ে কাজ করছে। তাদের ইশতেহার উপস্থাপনায় স্মার্ট, কনটেন্টে সেরা। বিএনপির প্রার্থী মাঠে না থাকলেও আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা রাতদিন প্রচারণা চালিয়েছেন। এমনকি যে ঢাকা-১০-এর কথা বললাম সেখানে শেখ ফজলে নূর তাপস বিরামহীন প্রচারণা চালিয়েছেন।

মানুষ এখন স্থিতিশীলতায় অভ্যস্ত হয়ে গেছে। তারা শান্তি চায়। পরিবর্তনে যে অস্থিতিশীলতার ঝুঁকি সেটাও থাকবে ভোটারদের মাথায়। বিএনপি জিতলে আবার ২০০১ সালের মতো প্রতিহিংসার বাংলাদেশ ফিরে আসতে পারে। তাই প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনাই বেশি।

আবার অনেকদিন ধরেই কেউ কেউ উন্নয়ন না গণতন্ত্র, এই বিতর্ক করছেন। আমরা উন্নয়ন অবশ্যই চাই, তবে তার আগে চাই গণতন্ত্র। কার্যকর গণতন্ত্র ছাড়া উন্নয়ন টেকসই হয় না। পেটে ভাত থাকলেই মানুষ সন্তুষ্ট থাকে না; তার চাই কথা বলার স্বাধীনতা, ভোট দেওয়ার অধিকার, রাতে বাসায় নিশ্চিন্তে ঘুমানোর সুযোগ।

সবকিছু বিবেচনা করেই জনগণ সিদ্ধান্ত নেবে, পরিবর্তন না প্রত্যাবর্তন? প্রত্যাবর্তনে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা, পরিবর্তনে অস্থিতিশীলতা আর প্রতিহিংসার ঝুঁকি।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

 

/এসএএস/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখলে আমাদের লজ্জা হয়: শাহবাজ
বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখলে আমাদের লজ্জা হয়: শাহবাজ
৬ ম্যাচ পর জয় দেখলো বেঙ্গালুরু 
৬ ম্যাচ পর জয় দেখলো বেঙ্গালুরু 
সাদি মহম্মদ স্মরণে ‘রবিরাগ’র বিশেষ আয়োজন
সাদি মহম্মদ স্মরণে ‘রবিরাগ’র বিশেষ আয়োজন
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ