X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

বাংলাদেশকে রক্ষার দায়িত্ব আপনারই

মাসুদা ভাট্টি
৩০ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৩:১৬আপডেট : ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৩:৪১

মাসুদা ভাট্টি সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় এসেছে। এক্ষণে বাংলাদেশ নিয়ে যারা ভাবেন বা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে যারা ভাবেন তাদের সামনে নিশ্চিতভাবেই এই প্রশ্ন জীবন্ত হয়ে উঠেছে যে, কী রকম বাংলাদেশ আমরা চাই? কার হাতে ক্ষমতা দিলে কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশকে আমরা পাবো? এবং কোনপক্ষ আমাদের এই অস্থির সময়ে পৃথিবীর সঙ্গে লড়ে-বুঝে একটি শক্তিশালী জাতিরাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে? কাদের অতীত রাষ্ট্রপরিচালনার অভিজ্ঞতা আমাদের কী সাক্ষ্য দেয়?

আমরা জানি যে, বাংলাদেশে এই মুহূর্তে মোটাদাগে দুটি পক্ষ রাষ্ট্রক্ষমতার দাবিদার হয়ে ভোটে লড়ছে। এই প্রথম একটি দলীয় সরকারের অধীনে স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশে এই ইতিহাস তৈরিরও যে ইতিহাস রয়েছে তা আমাদের জানতে হবে এবং বুঝতে হবে যে, এটা আরও আগেই হওয়ার কথা ছিল। আরও আগেই বাংলাদেশে নির্বাচনি ব্যবস্থা আর দশটি স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক দেশের মতোই হতে পারতো। কিন্তু সেটা হতে পারেনি। কারণ, বাংলাদেশের গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে দেওয়া হয়েছিল ৭৫-এর নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে। দুই দুটি সামরিক সরকার এদেশে জোর করে ক্ষমতা দখল করেই ক্ষান্ত হয়নি, তারা দেশের সংবিধান সংশোধন করে দেশের রাষ্ট্র চরিত্র বদলানোর সঙ্গে সঙ্গে ধর্মভিত্তিক রাজনীতিতে ফিরিয়ে এনে দেশে এমন রাজনৈতিক শক্তিকে জন্ম দিয়ে গেছে যে, যারা কেবল ক্ষমতা বোঝে, বোঝে কেবল দেশকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলা। লক্ষ্য করে দেখুন, আপনার চারপাশে, একটু চোখ বন্ধ করে ভেবে দেখুন– এদেশে কখন থেকে গণতন্ত্র উল্টোপথে হাঁটতে শুরু করেছে? কখন এদেশে নির্বাচনের নামে প্রহসন শুরু হয়েছে? হ্যাঁ-না ভোটের নামে গণতন্ত্রকে এদেশে হাস্যকর করে তোলা হয়েছে কবে থেকে? দেশের টাকায়, জনগণের টাকায় রাজনীতিবিদদের কিনে এনে রাজনৈতিক দল গঠন করা হয়েছে কখন থেকে? কিন্তু তারপরও এদেশের মানুষ গণতান্ত্রিক চেতনাবোধ থেকেই বিকল্প সেসব রাজনৈতিক দলকে গ্রহণ করেছিল। ভোট দিয়েছিল নির্বাচনে। কিন্তু কোটি কোটি ভুয়া ভোটার আর নির্বাচন ব্যবস্থাকে ব্যর্থ করার মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলকে দেশের মানুষ মেনে নেয়নি। তাই তারা নির্বাসিত হয়েছিল।

সবচেয়ে বড় কথা হলো, একটি গোটা শাসনামল যখন জঙ্গিবাদের হিংস্র থাবার তলে বাংলাদেশ গিয়ে দাঁড়িয়েছিল তখন মানুষ শ্বাস নেওয়ার ক্ষমতা হারিয়েছিল। সেই লিগেসি’তেই বাংলাদেশে হোলি আর্টিজানের মতো ঘটনা ঘটেছে এবং প্রকাশ্যে তাদের মদত দিয়েছে এ দেশেরই মানুষ, যাদেরকে বিশ্বাস করে ভোট দেয় সে রকম রাজনৈতিক পক্ষসমূহ। তারা যুদ্ধাপরাধী রাজাকারদের বাঁচানোর লক্ষ্যে রাজনীতি করেছে, তারা কেবলমাত্র একটি নির্দিষ্ট সেনা শাসকের পরিবারকে বাঁচানোর জন্য গত ১০ বছর প্রকাশ্যেই কাজ করে গেছে। অথচ জনগণের জন্য একটি মিছিলও তারা খরচ করেনি, একটি জনসভাও তারা করেনি। হয়তো প্রশ্ন করতে পারেন যে, তাদের জনসভা করতে দেওয়া হয়নি। জনগণের জন্য জনসভা করতে চাইলে জনগণই তার ব্যবস্থা করে দিতো বলে আপনি নিশ্চয়ই বিশ্বাস করেন? আপনার জন্য, আপনার পরিবারের জন্য, আপনার দেশের দেশের জন্য কোনো কর্মসূচি গত ১০ বছরে তাদের করতে দেখেননি বলেই তারা কোনও জনসভা করার সুযোগ পায়নি। কিন্তু তারা প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে দেশ ও জনগণের বিরুদ্ধে কাজ করে গেছে সমানে। তারা বিদেশি শক্তিকে অর্থ দিয়ে বাংলাদেশের বিপক্ষে কাজ করিয়েছে। সরকার-বিরোধিতার নামে তারা বিদেশিদের দিয়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, অবকাঠামো-উন্নয়নের প্রক্রিয়াকে থামিয়ে দিতে চেয়েছে। ব্যর্থ হয়েছে বারবার কিন্তু তারপর নতুন করে অর্থায়ন করেছে বাংলাদেশকে একটি অগণতান্ত্রিক দেশ প্রমাণ করার জন্য।

আজকে বিশ্বের নামকরা তাবৎ গণমাধ্যম বাংলাদেশকে একটি সমৃদ্ধশালী গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে কিন্তু অপপ্রচার যে কথা বলে, তার প্রমাণ দিয়ে তারা বলতে চাইছে যে, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুপস্থিত ছিল। কিন্তু প্রশ্ন করে দেখুন নিজেকে, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কোন কর্মকাণ্ডটি আপনার অজ্ঞাত ছিল? গত তিন বছরের কথাই ভেবে দেখুন, প্রতিদিন যদি একটি করেও সংবাদ সম্মেলন করে থাকে বিরোধী দল তাহলেও প্রতি সপ্তাহে সাতটি করে সংবাদ সম্মেলন ও সেখানে উত্থাপিত বক্তব্য আপনি জেনেছেন দেশের একাধিক টেলিভিশন ও সংবাদমাধ্যমের কল্যাণে। প্রকাশ্যেই গণমাধ্যম বিরোধী রাজনীতির পক্ষ নিয়ে একাধিকবার মিথ্যা প্রচারণা চালিয়েছে, জনগণ তা ধরিয়ে দিয়েছে কিন্তু তারা সে অপপ্রচার বন্ধ রাখেনি। তাহলে আপনি কাকে বলবেন গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি? যুদ্ধাপরাধী, দেশের সম্পদ বিনষ্টকারী, অগ্নি-সন্ত্রাসীদের পক্ষে প্রচারণা চালানোয় বাধা দেওয়াকে? নাকি দুর্নীতির দায়ে সাজাপ্রাপ্তদের মুক্তির দাবিতে জনসভা করতে না দেওয়াকে? নাকি আপনিও মনে করেন যে, হাওয়া ভবনই ভালো ছিল? কিংবা পর পর পাঁচবার দেশকে দুর্নীতিকে বিশ্ব-চ্যাম্পিয়নকারীরাই ভালো?

আমাদের একটি দেশ আছে যাকে নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি। যার জন্য প্রাণ দেওয়ার ইতিহাস রয়েছে, যার জন্য যুগ যুগ ধরে আন্দোলন-সংগ্রাম-রক্তদানের ইতিহাস রয়েছে। একটি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে সমৃদ্ধ যে দেশ সে দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন বহুবিধ ষড়যন্ত্র হয়, যখন দেশটিকে এক লহমায় তুলে দেওয়ার চক্রান্ত হয় দেশবিরোধী, উন্নয়নবিরোধী এবং স্বার্থান্বেষীদের হাতে, তখন আমাদের সবারই ভেবে দেখা দরকার যে, আমরা দেশটিকে একটি স্থিতিশীল, শক্তিশালী অর্থনীতি ও দৃঢ় গণতন্ত্রের ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে চাই কিনা? আমরা কি দেশটিকে আফগানিস্তান বা সিরিয়ার মতো একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করতে চাই কিনা? পরাশক্তি ও বাণিজ্যিক শক্তিসমূহের অবারিত রাজনৈতিক খেলা আর মুনাফালাভের ক্রীড়াক্ষেত্র বানাতে দিতে চাই কিনা?

আমরা নিশ্চিতভাবেই জানি যে, এ দেশের ব্যাংকিং সেক্টরে অনিয়ম হয়েছে এবং তা দেশের অর্থনীতির জন্য শঙ্কাও তৈরি করেছে। কিন্তু একথাও কি সত্য নয় যে, এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়টি আমরা ত্বরিত জেনেছি, গণমাধ্যমে তা এসেছে, সরকার সেগুলো সামাল দেওয়ার চেষ্টা অন্তত করেছে। কিন্তু আমরা কি এখন স্মরণ করতে পারি যে, এমন একসময় ছিল যখন রাষ্ট্রক্ষমতার মালিকেরা শত শত স্যুটকেস নিয়ে পিকনিক করতে গিয়েছে সৌদি আরব কিংবা প্রধানমন্ত্রীর পুত্রেরা বিদেশি কোম্পানির কাছ থেকে প্রকাশ্যে ঘুষ নিয়েছে এবং সরকার সেগুলো এ দেশে ফেরত আনতে সক্ষম হয়েছে? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে এফবিআই এসে সাক্ষ্য দিয়ে গেছে সেসব অপকর্মের, কিন্তু ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় আমরা সেসব জানতেও পারিনি। রাষ্ট্র একদিনে নির্মিত হয় না। ক্রমশ জবাবদিহির সংস্কৃতি তৈরি হয়। আজকে আমরা সেই জায়গায় পৌঁছেছি যেখানে কেউ জবাবদিহির বাইরে নয়। যেকোনও খাতই জনগণের কাছে দায়বদ্ধ সেই সংস্কৃতি গ্রহণের প্রক্রিয়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে সর্বত্র।

আপনার সিদ্ধান্ত যেন বাংলাদেশকে কোনোভাবেই পিছিয়ে না দেয় সেটাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা নিশ্চিতভাবেই জানি যে, একজন প্রধানমন্ত্রীকে কেবল দলীয়ভাবেই নেতা হলে চলে না, তাকে যেমন দেশের জনগণের নেতা হতে হয় তেমনই তাকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও নেতৃত্ব দিয়ে দেশের পক্ষে স্বার্থ আদায়ে সমান পারদর্শী হতে হয়। বাংলাদেশে যে দুটি প্রধান পক্ষ আপনার সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছে তাদের মধ্যে আপনি কাকে বেছে নেবেন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কাণ্ডারি হিসেবে সেটা আপনারই সিদ্ধান্ত। কিন্তু একথাও কি সত্য নয় যে, একটি পক্ষ আপনাকে বলছে যে, চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ ও সাজাপ্রাপ্তকে কারাগার থেকে বের করে এনে প্রধানমন্ত্রী বানাবে, যার অতীত কর্মকাণ্ড বাংলাদেশকে দুর্নীতিবাজ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা ছাড়া আর কিছুই নয়। কিংবা একথা তারা এখনও স্পষ্ট করছে না যে, কে হবে সেই প্রধানমন্ত্রী যিনি আগামীর বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেবেন?

কিন্তু আরেকটি পক্ষ আপনাকে স্পষ্ট করেই বলছে যে, এই সেই সাহসিকা যিনি বাংলাদেশকে বিশ্বসভায় একটি সম্মানজনক স্থানে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করিয়েছেন; যিনি গণতন্ত্রকে ও নির্বাচনি ব্যবস্থাকে শক্তিশালী ও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে ক্ষমতাসীন হয়েও একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সাহসী হয়েছেন; যিনি দেশের অবকাঠামো ও অর্থনৈতিক ভিতকে মজবুত করার লক্ষ্যে যেকোনও ঝুঁকি নিচ্ছেন চোখ বন্ধ করে; বাংলাদেশ ও বাঙালির প্রতি যার ভালোবাসা প্রশ্নাতীত– যিনি একুশ শতকের উপযুক্ত রাষ্ট্রনেতা এবং বাংলাদেশকে যিনি একাত্তরের কলঙ্ক থেকে মুক্ত করেছেন যুদ্ধাপরাধের বিচার করে আর পথ দেখিয়েছেন সমৃদ্ধির।

সিদ্ধান্ত অবশ্যই আপনার। একদিকে আপনার সামনে চিহ্নিত ও সাজাপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী ও দুর্নীতিবাজদের রাষ্ট্রক্ষমতায় বসানোর সুযোগ, অপরদিকে বাংলাদেশকে একটি সুস্থ, স্বাভাবিক, গণতান্ত্রিক ও অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত করার সুযোগ। কোন সুযোগটি গ্রহণ করবেন সেই পরীক্ষার মুখোমুখি আপনি। বাংলাদেশকে নাকি বাংলাদেশের বিপক্ষে আপনি দাঁড়াবেন সেটা ভেবেচিন্তেই ভোটকেন্দ্রে যাবেন। আপনার ভোট আপনার দেশকে বাঁচাবে– এই হোক আপনার সিদ্ধান্ত গ্রহণের মূলসূত্র।

/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ