X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন

দাউদ হায়দার
৩১ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৮:২১আপডেট : ৩১ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৮:৫৬

দাউদ হায়দার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে সিনিয়র ছিলেন খুকু (নীলাঞ্জনা। চিত্রপরিচালক গৌতম ঘোষের সঙ্গে বিয়ের পরে নীলাঞ্জনা ঘোষ)। ওঁর মুখেই শুনি মৃণাল সেনের সঙ্গে গৌতমের সুসম্পর্ক। মৃণালের বাড়িতে যান, আড্ডা দেন। চেহারা যতই রাগী হোক, গম্ভীর হোক, আদৌ তেমন নন, বরং উল্টো, দিলখোলা।
দেখার বাসনা জাগে। হেতু, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে ‘বাইশে শ্রাবণ’, ‘কলকাতা ৭১’ (এই ছবিতে বাংলাদেশের চিত্রপরিচালক-অভিনেতা সুভাষ দত্ত অভিনয় করেছেন) দেখেছি।
খুকুর দৌলতে গৌতমের সঙ্গে পরিচয়। গৌতমই নিয়ে যান মৃণাল সেনের বাসায় (কলকাতার ভাষায় ‘বাড়ি’।) থাকেন দেশপ্রিয় পার্কের ‘প্রিয়া’ সিনেমা হলের পেছনের এক গলিতে। দোতলায়।
কবে প্রথম যাই, তারিখ মনে নেই। শনি বা রবিবার সকাল হবে। সাল ১৯৭৫, জুলাই। মৃণাল সেন জানতে চান নাম কী, দেশের বাড়ি (কোন জেলায়) কোথায়, কলকাতায় কেন, কী করছি। জেনে, ‘আজ চা হবে না, অন্যদিন এলে খাবে’। ঘরে অনেকেই, সকলের হাসি। কে একজন বললেন, ‘আজকের মতো কোটা শেষ’। মৃণাল সেনের আচমকা প্রশ্ন: ‘তোমার ডাকনাম কী?’ জেনে, ‘ওহ! খোকাবাবু?’

-না, খোকন।

মৃণাল সেন: চেহারা কচি-কচি। কলকাতায় সবাই ‘বাবু’। খোকাবাবুই মানানসই। বছর না ঘুরতেই পারিবারিক হয়ে গেলুম। কেন, কী সুবাদে, অজানা।

অবাক হয়েছিলুম শুনে (প্রথমে) কুনাল বাবাকে ডাকছেন ‘বন্ধু’। অবশ্য, মাকে বান্ধবী নয়। মৃণালদার সাবধানবাণী, ‘তাই বলে আমাকে তুমি ‘বন্ধু’ ডাকবে না। মৃণালদা ডাকতে পারো। সকালে আসবে, ১০/১৫ মিনিটের বেশি থাকবে না’।– তিনি যখন কলকাতায় (দেশের বাইরে নন, কিংবা কাজ নিয়ে ব্যস্ত নন) প্রায় শনি-রবিবারে সকাল ন’টার পরে হাজির। ঘণ্টাখানেক কাটে। সকালের ব্রেকফাস্টও হেঁসেলে। গীতাদি একবার, ‘হাফ কলা খাও, তোমার দাদা হাফ খেয়েছেন’। নিশার ছোট বোন, কুনালের শ্যালিকা জাগ (জাগৃতি রুপারেল) যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে, সেই সুবাদে বন্ধু হয়ে যান। ঘনিষ্ঠ।

আমাদের পরিবারের সঙ্গে চমৎকার সম্পর্ক ছিল মৃণালদার, ঢাকা থেকে আত্মীয়কুল এলে মৃণালদার বাড়িতে যাবেই, যেন অধিকার। তিনিও খুশি হতেন খুব। খুশির মাত্রা চড়াতেন, ‘দিনটা ভালো যাবে’।

চিঠি চালাচালির বদলে ফোনালাপ, শেষে, ‘ধরো, গীতার সঙ্গে কথা বলো’। বার্লিন থেকে কলকাতায় গেলে, মৃণালদার সঙ্গে দেখা করা পবিত্র কর্তব্য, ঘরে ঢুকতেই, ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’। বার্লিনে আসছেন, কবে, কোন হোটেলে উঠছেন, কলকাতা থেকে আগেই জানাচ্ছেন ফোনে।

এসে, নির্দেশের সুরে, ‘ধীরাজ (রায়) শালাকে ফোন করো’। তার মানে ধীরাজ রায়কে আগমনবার্তা জানাও।

বলা দরকার, মৃণাল সেন প্রথম যখন বার্লিনে (পশ্চিম বার্লিনে), ধীরাজ রায়ই গাইড, দেখভাল করেন। ধীরাজ রায়ের বাসায় দুইবেলা খাওয়াদাওয়া। ধীরাজ রায় ফরিদপুরের এবং একই গ্রামের। দু’জনের বয়স কাছাকাছি (চার বছর ছোট বড়ো)।

মৃণাল সেনের ‘শালা’ শুনে আমরা অভ্যস্ত। কখনও রাফ, কখনও উত্তেজনাবশত। ‘বুঝলে, এটা ফরিদপুরের অরিজিনাল ভাষা। শালা স্নেহ, আদর, রাগ অভিমানের ভাষা। যদি বলো, ‘আরে শালা কেমন আছিস, বন্ধুতা প্রকাশ। যদি বলো, দাঁত খিঁচিয়ে, চোখমুখ উল্টিয়ে, তখন ভয়ঙ্কর। শালা তখন শত্রু’।

মৃণালদার অভ্যেস ছিল বন্ধু, সমসাময়িক, স্নেহভাজনের কাঁধে হাত রেখে কথা বলা কিংবা পথ-হাঁটা।

একবার, বার্লিনের বিখ্যাত রাস্তা কুদাম (ক্যুরফুরস্টেনডাম)-এ হাঁটছি, কাঁধে হাত দিয়েছেন মৃণালদা, ‘তোমার বান্ধবীর সঙ্গে দেখা করলে না?’

–দেখা করতেই এসেছিল, ওই যে দেখছেন তরুণী, চলে যাচ্ছে’।

কেন?

–কাঁধে হাত দিয়েছেন। এদেশে পুরুষ-পুরুষ হাত ধরে কিংবা কাঁধে হাত রেখে চললে সম্পর্ক কী, জানেন। সমকামী। তা বয়সের ফারাক যতই হোক। ‘ধুশ শালা’। বলে, কাঁধ থেকে হাত নামান না আর।

ঠিক যে বার্লিন দেওয়াল ধসের আগে, দুই জার্মানির একত্রীকরণের আগে, পূর্ব ইউরোপের পশ্চিমাপ্রেমের আগে সত্যজিৎ রায় নন, মৃণাল সেনই কমিউনিস্ট পূর্ব জার্মানি থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নে অধিকতর খ্যাতিমান। ১৯৮৭ থেকে ১৯৮৯ পর্যন্ত পূর্ব জার্মানির টিভিতে, সত্যজিতের নয়, মৃণালের ছবিই মূলত প্রদর্শিত। পূর্ব ইউরোপে তিনি ছিলেন ভারতীয় ছবির আইকন।

মৃণাল সেনের মৃত্যুতে জার্মান মিডিয়া ‘শোকগ্রস্ত’। টিভিতে খবর প্রচারিত। মৃণালের দু’টি ছবির অংশ (দৃশ্য) প্রদর্শিত। প্যারিস থেকে শিল্পী শাহাবুদ্দিন জানালেন, (ফোনে) ‘ফরাসি’ টিভিতেও মৃণালদা।

উল্লেখ্য, কলকাতায় শাহাবুদ্দীনের একটি প্রদর্শনীতে মৃণাল সেন-শাহাবুদ্দীন-গনেশ পাইন-সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় একসঙ্গে, প্রায়-জড়াজড়ি, দাঁড়িয়ে। ছবিটি শাহাবুদ্দীনের ঘরে শোভিত।

কলকাতায় গিয়েছি, মৃণালদার বাড়িতে, ‘গীতা, খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন। কাল (রবিবার) বারোটায় চলে আসবে। তোমাদের আঁতলাদের (আঁতেল) ‘আমার ভুবন’ দেখাবো, গর্কি সদনে। একসঙ্গে যাবো’। যাই। দেখি।

দাউদ হায়দারকে লেখা মৃণাল সেনের চিঠি

শেষ দেখা ২০১৪ সালে, জানুয়ারি। দুপুরে লাঞ্চ। দুই ঘণ্টা ছিলুম। নির্দেশ, ‘কবিতা লেখা ছেড়ে গদ্য লেখো, ফেলে-আসা দেশ নিয়ে আত্মজীবনী লেখো’। মৃণাল সেনের সঙ্গে কী সম্পর্ক ছিল, চিঠিতেই প্রকাশিত। ছবিতেও। 

লেখক: কবি ও সাংবাদিক

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখলে আমাদের লজ্জা হয়: শাহবাজ
বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখলে আমাদের লজ্জা হয়: শাহবাজ
৬ ম্যাচ পর জয় দেখলো বেঙ্গালুরু 
৬ ম্যাচ পর জয় দেখলো বেঙ্গালুরু 
সাদি মহম্মদ স্মরণে ‘রবিরাগ’র বিশেষ আয়োজন
সাদি মহম্মদ স্মরণে ‘রবিরাগ’র বিশেষ আয়োজন
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ