X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

কল্পনার বাইরে প্রত্যাশিত বিজয়

আনিস আলমগীর
০১ জানুয়ারি ২০১৯, ১৪:৫০আপডেট : ০১ জানুয়ারি ২০১৯, ১৪:৫১

আনিস আলমগীর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেমন হলো এই নিয়ে টক শোতে হোস্ট হিসেবে ৩০ ডিসেম্বর রাতে অনেককে প্রশ্ন করতে হলো। শো’র বাইরে মতামত নিতে হলো। আবার নিজের মতামতও দিতে হলো। কিন্তু একটা বিষয়ে সবার মিল পেয়েছি যে, ফলাফল কারও কাছে অপ্রত্যাশিত ছিল না। শুধু বিস্ময়কর ছিল ভোটে বিরোধীদের এত কম আসন প্রাপ্তি আর কিছু কিছু আসনে ভোটের ব্যবধান। বিভিন্ন আসনের ফলাফলে নৌকা প্রতীকের বিপরীতে ধানের শীষের যে ভোট দেখা গেছে, সেটি অতীতের ফলাফলের সঙ্গে তুলনা করলে বিস্তর ব্যবধান মনে হয়েছে। আওয়ামী লীগের প্রার্থী অনেক আসনে বিএনপির প্রার্থীর চেয়ে দশগুণ বেশি ভোট পেয়েছেন।
আমরা এত সংগ্রামের পর ১৯৯৬ সালে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পেলাম ২০০১ সালে বিচারপতি লতিফুর রহমান সেটিকে পক্ষপাতদুষ্ট বানালেন। ২০০৬ সালে এসে বেগম খালেদা জিয়া বিকলাঙ্গ করে দিলেন ইয়াজউদ্দিন আহমেদকে দিয়ে। এরপর শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে এই নির্বাচন পদ্ধতিকে বাদ দিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করলেন। দলীয় সরকারের অধীনে অতীতের নির্বাচনগুলো কখনও তেমন গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। শেখ হাসিনা সরকারের এই দুই নির্বাচনের প্রথমটা অংশগ্রহণমূলক ছিল না বলে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, দ্বিতীয়টা অংশগ্রহণমূলক হলেও ব্যাপক হারে বিজয়ের জন্য প্রশ্ন উঠছে। এমনকি কড়া সমর্থকরাও বলছেন, বিজয় চেয়েছি তবে এতটা হবে ভাবিনি। সব জল্পনা কল্পনার বাইরে এ বিজয়।

আমাদের নির্বাচন কোনও সহজ সরল ‘সেরা জিনিস বেছে নাও’ ধরনের প্রতিযোগিতা নয়, তা হওয়া সম্ভবও নয়। আমাদের নির্বাচনটা জটিল বহু মাত্রিক এক প্রক্রিয়া। মানুষকে ফাঁকি দিয়ে এ নির্বাচনটা উত্তরণ কোনোভাবেই সহজ নয়। টানা দশ বছরের শাসনের পর এন্টি ইনকামবেনসি ফ্যাক্টরে এই সরকারকে পছন্দ না করাটা অস্বাভাবিক ছিল না কিন্তু শেখ হাসিনা তার নেতৃত্বের প্রতি দেশের মানুষকে আস্থাশীল করে গড়ে তুলেছেন। যে কারণে দেশের মানুষ তার নেতৃত্বকে অবহেলা না করাকে উত্তম বিবেচনা করেছে। সর্বোপরি তার বিপরীতে কোনও উত্তম বিকল্পও ছিল না। দেশের মানুষের পক্ষে তাকে ক্ষমতায় রাখা ছাড়া উপায়ওবা কী ছিল? যাকে আস্থায় রেখে মানুষ প্রতারিত হয় না তার প্রতি বারবার আস্থা স্থাপন তো স্বাভাবিক পরিণতি।

জওহরলাল নেহেরু আমৃত্যু ভারতীয়দের আস্থার মানুষ ছিলেন। সুতরাং তারা নেহেরুকে শাসন ক্ষমতা থেকে সরানোর কোনও প্রয়োজনই কখনও অনুভব করেননি। দীর্ঘ একটানা ১৭ বছর তিনি ভারতীয় ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রীত্ব করেছেন। তার কন্যা ইন্দিরা গান্ধীও তার পরে (মধ্যে লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর কয়দিন ছাড়া) ১৭ বছর ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। শুধু ১৯৭৭ সালের নির্বাচনে ইন্দিরার জরুরি আইনের বাড়াবাড়ির কারণে তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন সত্য কিন্তু জনতা দলের ব্যর্থতার পর পুনরায় ১৯৮০ সালের অন্তবর্তী লোকসভার নির্বাচনে তিনি তিন শতাধিক আসনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছিলেন।

ভারতের মানুষ শৃঙ্খলা রক্ষার নামে ইন্দিরার আরোপিত স্বাধীনতা হরণ যেমন পছন্দ করেনি ঠিক তেমনিভাবে জনতা দলের অন্তর্কলহকেও প্রশ্রয় দেয়নি। ১৯৮০ সালে লোকসভার অন্তর্বর্তী নির্বাচনে তারা ইন্দিরাকে ক্ষমতা ফিরিয়ে দিয়েছিল। গণতন্ত্র এই জন্যই উত্তম যে জনগণের নিয়ন্ত্রণ থাকে সরকারের ওপর। অ্যারিস্টটল বলেছেন, ‘অযোগ্য শাসনকর্তার মতো দেশ ও জাতির বড় ক্ষতি আর কেউ করতে পারে না।’ আমরা খুবই আনন্দিত হয়েছি এটা দেখে যে, বাঙালি জাতি সেই বিষয়টা হৃদয়ঙ্গম করেছে উত্তমরূপে যার প্রতিফলন হয়েছে গত ৩০ ডিসেম্বর একাদশ সংসদ নির্বাচনে।

শেখ হাসিনার প্রতিদ্বন্দ্বী কে হবেন গণফোরামের ড. কামাল না তারেক রহমান তা নিয়ে সংশয় ছিল। যখন ড. কামাল নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেন না এবং তারেক রহমান টেলি-কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রার্থী থেকে আরম্ভ করে নির্বাচনের সব কিছু ঠিক করে দিলেন তখন মানুষ নিঃসংশয় হলেন যে বিএনপির প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন তারেক রহমান। বিএনপির সর্বনাশের মূল কারণ হলো এটাই। বিএনপির সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী দেখে মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে বিএনপি থেকে। বিএনপির মাত্র ৫/৬টি আসনে বিজয়ী হওয়া তথা নির্বাচনে ভরাডুবির জন্য ঐক্যফ্রন্ট নেতারা রাষ্ট্রযন্ত্রের হাতকে দায়ী করলেও তাদের পুরো নির্বাচন পরিকল্পনাতেও গলদ ছিল। আর মনোনয়ন বাণিজ্যও ব্যাপক ক্ষতি করেছে বিএনপির। আওয়ামী লীগের অনেক নেতাও নাকি বিএনপির স্থায়ী কমিটির অনেক নেতাকে টাকা দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে দুর্বল, অখ্যাত, জনবিচ্ছিন্ন প্রার্থী মনোনায়ন দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। এত ত্রুটি নিয়ে দল জিতে কিভাবে?

ড. কামাল হোসেন নির্বাচনের ফল প্রকাশ শেষ হওয়ার আগেই সাংবাদিক সম্মেলন করে নির্বাচনে পরাজিত হলে মানানসই যেসব অভিযোগ করা যায় তা সবই করেছেন। আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নতুন নির্বাচন করার দাবিও পেশ করেছেন। আন্দোলন করার ভয়ও দেখিয়েছেন। বিএনপিওয়ালদের আন্দোলনের ভয় দেখানো নতুন নয়। এই দলের যারা নেতৃত্বে আছেন তারা সর্বত্র বাণিজ্য করে। কমিটি অনুমোদনের সময়েও নাকি টাকা দিতে হয়। আগাগোড়া যদি দুর্নীতি পরায়ন ব্যক্তিরা নেতৃত্বে থাকেন এবং সংগঠনের নেতা কর্মীরাও যদি তাদের বাণিজ্যের শিকার হয়ে থাকেন তবে এ সংগঠনটা তো অচিরেই মরে যাবে।

১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগ যখন ৯ আসন পেয়ে পরাজিত হলো আর কখনও তারা গণমানুষের সংগঠন হয়ে উঠতে পারলো না। আমি চিন্তা করছি বিএনপি এরূপ কোনও অবস্থার সম্মুখিন হচ্ছে কিনা। গত ১২ বছর বিএনপিওয়ালারা বিরোধী দলে। এখন শেখ হাসিনা পুনরায় পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতায় আসলেন। মেয়াদপূর্ণ হলে দীর্ঘ ১৭ বছর বিএনপিকে মাঠে ময়দানে ঘুরে দিন কাটাতে হবে। আওয়ামী লীগ ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল দীর্ঘ ২১ বছর মাঠে ময়দানে সংগ্রাম করে দিন কাটিয়েছে। বিএনপি কর্মীদের সে ধৈর্য্য কুলাবে কিনা। বিএনপিতে তো রক্ত দেওয়ার মজনুর চেয়ে দুধ খাওয়ার মজনুর সংখ্যা বেশি। বিএনপি শেখ হাসিনাকে শারীরিকভাবে হত্যা করতে চেয়েছে। শেখ হাসিনা হয়তো তাদের রাজনৈতিকভাবে ‘খতম’ করে ছাড়বেন।

ড. কামাল হোসেনের বয়স হয়েছে। রাজনীতিতে অবসরে যাওয়ার বয়সসীমা নেই বলে তিনি রাজনীতিতে আছেন। আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের নির্বাচনি প্রস্তুতি থাকার পর আর প্রধানমন্ত্রীর একটা ক্লিন ভাবমূর্তি থাকার পর তিনি নির্বাচনের তিন মাস আগে বিএনপিকে নিয়ে মাঠে সক্রিয় হলেন প্রধানমন্ত্রী আর আওয়ামী লীগকে চ্যালেঞ্জ করে। সঙ্গে নিলেন যুদ্ধাপরাধীদের এবং তাদেরকেও ধানের শীষ ধরিয়ে দিলেন। আমার মনে হয় দু’ চারটা বড় সমাবেশে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য তার এ কাজটা করা কোনোভাবেই যুক্তিযুক্ত হয়নি।

ড. কামাল হোসেন কিভাবে ধরে নিলেন যে আওয়ামী লীগের চেয়ে বিএনপি উত্তম? রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় এমন বড়সড় গলদ থাকা অনুচিত। সর্বোপরি তার বাকসৃষ্ঠতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। অ্যাটর্নি জেনারেল, সাংবাদিক, প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে তার আচরণ ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। উনাকে রাজনীতি থেকে অবসর নেওয়ার বিষয়ে চিন্তা করার জন্য অনুরোধ জানাবো।

যাক, তৃতীয় বিশ্বের নির্বাচন একেবারে ত্রুটি বিচ্যুতিবিহীন হয় এমন নজির খুবই কম। আমাদের একাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রধান ত্রুটি ছিল বিরোধীদের নির্বাচনি প্রচারে মাঠে নামতে না দেওয়া। দেখেছি একমাস ধরে বিএনপি জামায়াতকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চাপে রেখেছিলো। তাদের অনেক নিরপরাধ সমর্থককেও গ্রেফতার করা হয়েছে। অনেকে বলছেন, চাপে রাখারও প্রয়োজন ছিল। কারণ নির্বাচনের আগে পরে ২০ জন লোককে হত্যা করা হয়েছে তার মধ্যে ১০ জন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী। বিএনপির আহত কর্মী আছে সত্য তবে নিহত কেউ নেই। আওয়ামী লীগের ভাগ্য ভালো, তারা নির্বাচনে জিতেছে, না হয় আরও কত যে কর্মী হত্যার শিকার হতো জানি না। ১৯৬৫ সালে ক্ষমতা পরিবর্তনের পর ইন্দোনেশিয়ায় অনুরূপ হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হওয়ার নজির রয়েছে। বর্তমানে অনেক লোক জেলে আছে। আমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নির্বাচিত হওয়ার জন্য অভিনন্দনও জানাবো আবার সঙ্গে অনুরোধও জানাবো যেন নিরাপরাদ লোকজনকে মুক্তি দেওয়া হয়।

এক’শো ভাগ বিজয় নিশ্চিত করার জন্য যে সমস্ত এমপি প্রার্থী প্রতিপক্ষের ইনোসেন্ট সমর্থকদেরকে নির্বাচনের আগে ৪/৫টা মিথ্যা মামলা দিয়ে জেলে ভরে রেখেছেন, তাদেরকে অনুরোধ করবো দয়া করে এবার নিরাপরাধ লোকজনকে ছাড়ানোর উদ্যোগ নিয়ে সবার এমপি হোন। বিজয়ীতো হলেন, আপনার ‘পোষ্য চেলাদের’ যৌথ ব্যবসাটা বন্ধ করে নিজ নিজ এলাকার মানুষদের শান্তি দিন। আগামীতে এমপি হিসেবে আপনার দরকার নাও থাকতে পারে কিন্তু আওয়ামী লীগ নামের সংগঠনটির দরকার আছে। নিজের স্বার্থে সেটি ধ্বংস করার কাজ করবেন না। কাউকে সমর্থন করা অপরাধ হিসেবে নিলে পুরো দেশটাতে ঘরে ঘরে জেলখানা বানাতে হবে। প্রতি ছাদের নিচে ভিন্নমতের লোক আছে। পুলিশকে পেট্রোল-আগুন সন্ত্রাসী, দাগী আসামি, দুর্নীতিবাজদের শুধু জেলে রাখতে বলুন।

বিরোধী দলের সমর্থকদের উদ্দেশ্যে বলবো যে, যেসব বিরোধী দলীয় এমপি প্রার্থী সমর্থকদের মাঠে রেখে নির্বাচনের সময় পলাতক ছিল, একদিনও মাঠে যায়নি এদেরকে দেখলেই ‘থুতু’ মারেন। রাজনীতিতে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করুন। যারা আপনার কোনও কাজে আসে না, আপনার দলের কাজে আসে না, তারা দেশের কী ঘোড়ার ডিম কাজ করতো, ভাবুন। তাদের পরাজয়ে কষ্ট পাওয়ার কিছু নেই।

পরিশেষে নববর্ষে প্রত্যাশা করবো, সবাই সব ধরনের রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, সন্ত্রাস, বোমাবাজির চিন্তা বাদ দিয়ে আমরা যেন একটি সুন্দর সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশটিকে আমরা সবাই আরও অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে যাই। যতই আমরা তার সমালোচনা করি, নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলি না কেন, এই মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার বিকল্প নেই। তিনি আমাদের সবার প্রধানমন্ত্রী।

সবাইকে নববর্ষের শুভেচ্ছা।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

 

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘বয়কট’ করা তরমুজের কেজি ফের ৬০ থেকে ১২০ টাকা
‘বয়কট’ করা তরমুজের কেজি ফের ৬০ থেকে ১২০ টাকা
উবারের ‘নো কমেন্টস’ এর পরে কমেন্টস
উবারের ‘নো কমেন্টস’ এর পরে কমেন্টস
ট্রাকের সঙ্গে সংঘর্ষে বাস উঠে পড়লো রেললাইনে, ট্রেন থামিয়ে যাত্রীদের উদ্ধার
ট্রাকের সঙ্গে সংঘর্ষে বাস উঠে পড়লো রেললাইনে, ট্রেন থামিয়ে যাত্রীদের উদ্ধার
আপিল বিভাগে নিয়োগ পেলেন তিন বিচারপতি
আপিল বিভাগে নিয়োগ পেলেন তিন বিচারপতি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ