X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ফলাফল দেখে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী
০৩ জানুয়ারি ২০১৯, ১৪:৩৫আপডেট : ০৩ জানুয়ারি ২০১৯, ১৬:৩৮

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী ২০১৪ সালের ভারতের লোকসভা নির্বাচনে আমরা অকল্পনীয় ফলাফল দেখেছিলাম, যা বিশ্বাস করতে মন চায়নি। ১৩০ বছরের প্রাচীন দল কংগ্রেস পেয়েছিল মাত্র ৩৯ আসন। এবার বাংলাদেশের একাদশ সংসদ নির্বাচনেও অনুরূপ এক ফলাফল পেলাম আমরা। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ পেয়েছে ২৫৯টি আসন। জাতীয় পার্টি (এরশাদ) পেয়েছে ২০টি আসন, শক্তিশালী মাঠের বিরোধী দল বিএনপি পেয়েছে পাঁচটি আসন, গণফোরাম পেয়েছে ২টি আসন। এছাড়া জাসদ (ইনু) পেয়েছে ২টি আসন, ওয়ার্কার্স পার্টি পেয়েছে ৩টি আসন, তরিকত ফেডারেশন ১টি ও জাতীয় পার্টি (মঞ্জু) পেয়েছে ১টি আসন। আর স্বতন্ত্র প্রার্থী পেয়েছে ৩টি আসন।
এবারের একাদশ সংসদ নির্বাচনে যে বাঙালি জাতি চমকের ফলাফল নির্ধারণ করেছে তা নয়, এর আগেও তারা অনুরূপ ফলাফল সৃষ্টি করেছিল। ১৯৭০ সালের নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ এককভাবে পেয়েছিল ১৬২ আসন, আর বিরোধী পক্ষ থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন শুধু নুরুল আমিন আর রাজা ত্রিদিব রায়। ১৯৫৪ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে নির্বাচন করেছিল, তখন মুসলিম লীগ পেয়েছিল মাত্র ৯ আসন। চট্টগ্রামের রাউজান কেন্দ্রে মুসলিম লীগ প্রার্থী আবুল কাসেম সাব জর্জ-এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন ফজলুল কাদের চৌধুরী। ফজলুল কাদের জিতে এসে পুনরায় মুসলিম লীগে যোগদান করায় সংসদে মুসলিম লীগের সদস্য সংখ্যা হয়েছিল ১০ জন। বাঙালি জাতির এ অভ্যাস সর্বজনবিধিত যে, তারা যে দল থেকে তাদের বিশ্বাস প্রত্যাহার করে নেয় তবে নির্বাচনে সে দলকে তুলে-মূলে বিনাশ করে দেয়। এবারের নির্বাচনে বিএনপি বাঙালি জাতির অনুরূপ রোষানলে পড়েছে।

১৯৫৪ সালে মুসলিম লীগ জনগণ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে আর কখনও উঠে দাঁড়াতে পারেনি। এবার বিএনপিরও একই অবস্থা হবে যদি আওয়ামী লীগ সঠিকভাবে রণকৌশল নির্ধারণ করতে পারে। আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকে এ কথা বলে আফসোস করতে দেখেছি যে দেশে একটা শাসনতান্ত্রিক বিরোধী দল নেই। এখন শূন্যমাঠে একটা শাসনতান্ত্রিক বিরোধী দল গঠনে আওয়ামী লীগ সহায়তা করতে পারে। আমার এ পরামর্শ শুনে অনেক বিজ্ঞজন হয়তো হাসবেন যে সরকারি দলের সহায়তায় একটা শাসনতান্ত্রিক বিরোধী দল গড়ে তোলার পরামর্শ দিচ্ছি।

আমি এ প্রসঙ্গে একটা পুরনো কথার উদাহরণ দেবো। ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পর ভারতীয় পার্লামেন্টে অধিকাংশ সদস্যই ছিলেন কংগ্রেস দলের। তখন মহাত্মা গান্ধী নেহরুকে ডেকে পরামর্শ দিয়েছিলেন এই বলে, ‘রাজকুমার (গান্ধী নেহরুকে রাজকুমার বলে সম্বোধন করতেন) তুমি কংগ্রেসের এক-তৃতীয়াংশ সদস্যকে দল থেকে বের করে দিয়ে পার্লামেন্টে একটা বিরোধী দল গঠন করে দাও। স্থান কোনও দিন শূন্য থাকে না। নয়তো হিন্দু মহাসভা এ জায়গাটা দখল করে নেবে। তখন ভারতকে তার বিষফল ভোগ করতে হবে।’

নেহরু মন্ত্রিসভায় তখন হিন্দু মহাসভার সভাপতি শ্যামা প্রসাদ মুখার্ মন্ত্রী। তিনি খুবই পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন। নেহরু নব ভারত গঠনে তার সাহায্য কামনা করেছিলেন বলে তিনি মন্ত্রিসভায় যোগদান করেছিলেন। নেহরু মনে হয় হিন্দু মহাসভার সবাইকে শ্যামা প্রসাদ মুখাজি বলে মনে করে ছিলেন। সেখানে যে দীন দয়াল উপ্যাধয়, অটল বিহারী বাজপেয়ী আর লালকৃষ্ণ আদভানীর মতো দুষ্টলোকেরা আছে সম্ভবত সেটা কল্পনাও করেননি। গান্ধীজির পরামর্শ মতো নেহরু বিরোধী দল গঠনের কোনও উদ্যোগই নেননি।

এখন বিজেপি ক্ষমতায় আর বিজিপি হচ্ছে সেই হিন্দু মহাসভার ঔরসজাত সন্তান। তারাই বলছে ঘরওপাসি অর্থাৎ যেসব হিন্দু ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান আর খ্রিস্টান হয়েছিল তারা আবার হিন্দু হয়ে যাও। ঘরে ফেরত আসো। মহাত্মার কথা হাতে হাতে প্রমাণ হলো। এ কথাটা ভারতের সংহতি বিনষ্ট হওয়ার কথা। মহাত্মার সংশয় অহেতুক ছিল না। এখন সময় এসেছে জাতীয় পার্টিকে সংসদে এবং সংসদের বাইরে বিরোধী দল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। বিরোধী আসনেও তারা আবার মন্ত্রিসভায়ও তারা– আমরা প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করবো অনুরূপ ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি না হয়।

২০১৪ সালের প্রেক্ষাপট আর বর্তমান অবস্থা এক নয়। দেশ গঠনের সুযোগ যখন জাতি তাকে বারবার দিচ্ছে তখন প্রধানমন্ত্রীর উচিত হবে গণতান্ত্রিক কাঠামোর মাঝে দেশটাকে গড়ে তোলা। দীর্ঘ চার দশক পরে বিএনপি নামক গড়ে ওঠা ষড়যন্ত্রের আখড়াটির ভিত্তিমূলে আঘাত লেগেছে। এ আখড়াকে আবার মাথা তুলতে দেওয়া কখনও সুচিন্তিত কাজ বলে বিবেচিত হবে না।

তবে গান্ধীজির কথা পুনরাবৃত্তি করে বলবো, স্থান কখনও শূন্য থাকে না। বিকল্প যদি গড়ে তুলতে গণতন্ত্রকামী মানুষ ব্যর্থ হয় তবে ষড়যন্ত্রের আখড়াটা আবার হয়তো ফিরে আসবে। প্রতিপক্ষকে গ্রেনেড মেরে হত্যা করার সংস্কৃতি আর প্রতিপক্ষের হাত কাটা, রগ কাটা, হত্যা করা মৃতদেহ ম্যানহোলের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়ার রাজনীতি বিএনপি-জামায়াতই এ দেশের রাজনীতিতে ঢুকিয়েছে। এ অপশক্তির অবসান হওয়া উচিত।

আর রাজনীতিকে ব্যবসায় রূপান্তরিত করেছে বিএনপি। ত্যাগ, তিতিক্ষাকে ঝাটিয়ে রাজনীতি থেকে বিতাড়িত করেছে তারা। তাদের এ দুরাচার সংক্রমিত হয়ে বাম দলগুলো আর ইসলামপন্থী দলগুলোর মাঝেও ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও সে পথের পথিক হচ্ছে। রাজনীতি থেকে সব সৎগুণ বিতাড়িত হয়ে যদি নিষ্ফলা বৃক্ষের মতো হয়ে যায় তবে তাতে তো বানরও উঠবে না। রাজনীতি তো একটা মহৎ কাজ। রাজনীতি নিষ্ঠার সঙ্গে পরিচর্যা করলে সমাজ জীবনে লালিত্য বৃদ্ধি পায়। তা তো হারিয়ে যাচ্ছে। তার পরিচর্যার দায়িত্বও প্রধানমন্ত্রীকে নিতে হবে।

বাম ধারার রাজনীতি এ উপমহাদেশের প্রাচীন ধারার রাজনীতি। ইসলামপন্থীদের রাজনীতিও নবীন নয়। অথচ তারা সমাজকে কিছুই দিচ্ছে না। ‘মন্দের ভালো’ কথা একটা বলে ঝিমুচ্ছেন। মনে রাখতে হবে তাদের মাঝে অনেক ভালো সৎ মানুষ রয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে তারা সক্রিয় নন। বামপন্থীরা সক্রিয় হলে কিছু চারু মজুমদারের অভ্যুদয় ঘটে আর ডানপন্থী মৌলভীরা সক্রিয় হলে বর্বর তালেবানদের আবির্ভাব হয়। এটা তাদের চিন্তার অসংলগ্নতা। তাদের চিন্তার এ অসংলগ্নতা পরিহার করে সময় উপযোগী, সমাজ উপযোগী চিন্তাধারায় তাদের ফিরে আসতে হবে। তবেই দেশে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে তাদের বিচরণ করা সম্ভব হবে।

যাক, লিখছিলাম নির্বাচন নিয়ে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে নির্বাচনে ভেনটিলেশন দিয়ে কিছু ছাইভস্ম ঢুকে আমাদের নির্বাচনও তার থেকে পৃথক কিছু নয়। আমেরিকা, রাশিয়া, চীন, ভারত, সৌদি আবর সবাই শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়ে নির্বাচনের ফলাফলের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। শেখ হাসিনা আবারও আগামী পাঁচ বছর দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিচ্ছেন এটাই শেষ কথা। তাকে আমরা অভিনন্দন জানাই।

জয় যেমন বড়, দায়িত্বও বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। শেখ হাসিনার জন্য এবারের দায়িত্বের বোঝা খুবই ভারি হবে। কারণ, একটানা ক্ষমতা ও জনপ্রিয়তা মানুষকে অনেক সময় নিজের মতো পথ ইত্যাদির প্রতি একরোখা করতে প্রলুব্ধ করে, তখন শাসক স্বৈরাচার হয়ে যান। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি তিনি যেন আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে সে বদগুণে আক্রান্ত হওয়া থেকে রক্ষা করেন। টানা ক্ষমতার কারণে সংগঠনেও তার প্রতিক্রিয়া হতে পারে। আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের কর্তৃত্ব প্রধানমন্ত্রীর হাতে, তাকে ছাড়া তারা আর কারো কথা শুনে না। সুতরাং প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করবো, সংগঠন যেন কোনও বেয়াড়া আচরণ না করে, তার লাগাম যেন টেনে ধরেন।

নির্বাচনের আগে শান্তি-শৃঙ্খলা স্থিত রাখার জন্য বিএনপি-জামায়াতকে চাপে রেখেছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তবুও ২০ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। তার অর্ধেকই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী। তখন বহু মানুষকে পুলিশ গ্রেফতার করেছিল। অনেককে বিভিন্ন পুরনো মামলায় আটক দেখিয়ে হয়রানি আর সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। শুধুমাত্র ভিন্ন রাজনীতির সমর্থক হলে কাউকে জেলে রাখা অন্যায় হবে। শেখ হাসিনা দীনের পথে চলেন, তিনি কোনও অন্যায়কে প্রশ্রয় দিতে পারেন না। আমি এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীকে বিশেষ অনুরোধ করবো তিনি যাতে একটি বিশেষ সেল গঠন করে দেন। এই সেল ভোটকে কেন্দ্র করে পুলিশ যেসব নিরীহ মানুষকে গ্রেফতার করেছে, মিথ্যা মামলা দিয়েছে, তদন্ত করে তাদের ছেড়ে দেওয়ার সুপারিশ করবে।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ