X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

নতুন মন্ত্রিসভার ভালো-মন্দ এবং প্রত্যাশা

আনিস আলমগীর
০৮ জানুয়ারি ২০১৯, ১৫:৪০আপডেট : ০৮ জানুয়ারি ২০১৯, ১৬:৫০

আনিস আলমগীর রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য এবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২৪ জন মন্ত্রী, ১৯ জন প্রতিমন্ত্রী এবং তিনজন উপমন্ত্রী নিয়ে নতুন বছরের শুরুতে নতুন একটি মন্ত্রিসভার যাত্রা শুরু হলো। এদের মধ্যে ২৭ জনই মন্ত্রী হিসেবে নতুন মুখ। এদের মধ্যে আ ক ম মোজাম্মেল হক ছাড়া প্রায় সবাই বয়সে প্রধানমন্ত্রীর চেয়ে ছোট, কিন্তু নবীন বলা যাবে না। আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার টানা তিনবারের শাসনে এসে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়েছেন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রবীণ নেতা।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ হাসিনার মতো এত অধিক সময় কেউ রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন না। এর আগে ১৯৯৬ সালসহ চারবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ারও বাংলাদেশের ইতিহাসে কারও নজির নেই। তিনি আমাদের রাজনীতির সমকালীন দুনিয়ায় এক বিরল মানুষ। যারা তার কাছাকাছি এসেছেন, তাকে কাছ থেকে দেখেছেন, তাদের পক্ষে এমন মানুষের গুণমুগ্ধ হয়ে পড়া স্বাভাবিক। তিনি খুবই পরিশ্রমী এবং সর্বোতভাবে দেশ নিয়েই তার সার্বক্ষণিক চিন্তাভাবনা। ফলে দেশের সমস্যা তার নখদর্পণে।

মানুষ সহজে কারও প্রশংসা করে না। সরকার প্রধান হলে তো আরও মুশকিল। যত দোষ সব সরকারের এবং তার প্রধানমন্ত্রীর। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা যখন প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন তখন বিদ্যুৎ চলে গেলে বলতো ‘শেখ হাসিনা চলে গেলো’। আবার এলে বলতো ‘শেখ হাসিনা আসলো’। তখন বিদ্যুৎ উৎপাদন ছিল ৩ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট। তা দিয়ে চলতো না। ঘন ঘন বিদ্যুৎ বিভ্রাট হতো। পর্যায়ক্রমে এলাকায় এলাকায় লোডশেডিং করতে হতো। গত দশ বছর টানা ক্ষমতায় থাকার ফলে শেখ হাসিনার সরকার তা থেকে দেশকে পরিত্রাণ দিয়েছেন। এখন ২০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পর্যায়ে গিয়ে দেশ পৌঁছেছে। এখন আর আগের মতো বিরক্তিকর পর্যায়ে বিদ্যুৎ বিভ্রাট হয় না। উপহাসের ভাষা ‘হাসিনা চলে গেছে’ শুনতে হয় না।

উত্তরবঙ্গের সেই মঙ্গা এখন আর নেই। কৃষিতে বিপ্লব হয়েছে। দেশে যখন ৭ কোটি মানুষ ছিল তখন ২৯ লক্ষ টন খাদ্য ঘাটতি ছিল। এখন ১৬ কোটি মানুষ কিন্তু খাদ্য ঘাটতি নেই। অথচ ১ ইঞ্চি কৃষি জমি বাড়েনি বরং বসতি বাড়ার কারণে জমি কমেছে। টানা কৃষিমন্ত্রী ছিলেন মতিয়া চৌধুরী। সৎ মানুষ হিসেবে তার খ্যাতি আছে। তিনি কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষকদের বলেছিলেন লবণের হাঁড়িতে ধান উৎপাদন করতে হবে। গবেষকদের সাধুবাদ জানাই এখন বরগুনা অঞ্চলে লবণাক্ত জমিতেও ধান উৎপাদনে তারা সক্ষম হয়েছেন।

আমাদের অর্থমন্ত্রী আবদুল মাল মুহিত নানা সময়ে সমালোচিত হলেও সৎ ব্যক্তি এবং তার অর্থনীতিতে পারঙ্গমতা প্রশংসনীয়। তিনি এ পর্যন্ত ১৩টা বাজেট দিয়েছেন। লক্ষ কোটি টাকার বাজেট দেওয়ার সাহস দেখিয়েছেন তিনিই। অর্থনীতির একটা বৃহৎ এবং সামগ্রিক লক্ষ্য থাকে। ক্ষুদ্র এবং সংকীর্ণ রাজনীতি সেই লক্ষ্য পূরণের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু আমাদের অর্থনীতিতে ক্ষমতাবান গোষ্ঠী হস্তক্ষেপ করে জনস্বার্থকে বিঘ্নিত করতে উল্লেখযোগ্যভাবে সফল হননি। অর্থমন্ত্রীর পদটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কপাল পুড়েছে একজন ভালো অর্থমন্ত্রী পায়নি বলে। অরুণ জেটলি ভালো আইনের মানুষ, অর্থনীতির মানুষ নন। আমাদের প্রধানমন্ত্রী মুহিত সাহেবের মতো একজন অর্থনীতিবিদকে অর্থমন্ত্রী করে ভালোই করেছিলেন।

বর্তমান মন্ত্রিপরিষদে অর্থমন্ত্রী হিসেবে আ হ ম মুস্তফা কামাল (লোটাস কামাল) শপথ নিয়েছেন। তিনি চাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। সাইফুর রহমানও চাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট ছিলেন। হিসাব কিতাবের লোকরা সাধারণত রক্ষণশীল হন। আশা করি তার সময়ে ব্যাংক ব্যবস্থাকে তিনি ঢেলে সাজাবেন এবং ব্যাংকগুলোকে আর ডুবতে দেবেন না।

রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রতি বছর নতুন নতুন ব্যাংক খোলার অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে। অর্থনীতির সংজ্ঞা অনুসরণ করলে এটাও কোনও ভালো ব্যবস্থা নয়। আমাদের দেশের অর্থনীতি এত ব্যাংক সাপোট করে না। সেটি বিবেচনায় না এনে অসংখ্য ব্যাংক খোলার অনুমতি দিলে তো ব্যাংকিং সেক্টর এক সময়ে নিজেই একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। এখনও ব্যাংকিং সেক্টরে সমস্যার অন্ত নেই। বাংলা ট্রিবিউনের খবরে দেখলাম, আরও  ৩টি ব্যাংক অনুমোদন পেতে যাচ্ছে। এই পর্যন্ত লাইসেন্স পাওয়া ৫৮টি বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে ৫৭টি কার্যক্রম চালাচ্ছে। সর্বশেষ গত অক্টোবরে চূড়ান্ত অনুমোদন পায় পুলিশ সদস্যদের মালিকানায় ‘কমিউনিটি ব্যাংক অব বাংলাদেশ’। এটি এখনও কার্যক্রম শুরু করেনি।

নবাগত অর্থমন্ত্রী মোস্তফা কামালের উচিত হবে ব্যাংকিং খাতের অনিয়ম দূর করতে দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করা। মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং ডিভিশন আর বাংলাদেশ ব্যাংক– এই দুই প্রতিষ্ঠানের দ্বৈত শাসনে ব্যাংকগুলো পরিচালিত হচ্ছে। দ্বৈতশাসন কখনও ভালো ফল প্রদান করে না। পাকিস্তানের সময়েও অনুরূপ ব্যবস্থা ছিল না। বিষয়টা বর্তমান অর্থমন্ত্রী সক্রিয়ভাবে বিবেচনায় নেবেন বলে আশা করি। ৭ জানুয়ারি গঠিত নতুন সরকারে এত নতুন মুখ দেখে এবং পুরনোদের বিদায়ে সরকার কীভাবে চলবে– এই নিয়ে অনেকে উদ্বিগ্ন। আমার দৃষ্টিতে নতুন মুখ কোনও সমস্যা হবে না। ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী যখন প্রথম মন্ত্রিসভা গঠন করেন তখন আব্দুস সামাদ আজাদ ছাড়া কোনও পূর্ব অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মন্ত্রী ছিলেন বলে মনে পড়ে না। খোদ প্রধানমন্ত্রই ছিলেন নতুন লোক কিন্তু প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রীদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় দেশ পরিচালনায় তখনও কোনও অসুবিধা হয়নি।

এবারের মন্ত্রিসভায় আওয়ামী লীগের প্রবীণ সদস্যদের যেমন অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি তেমনি দলের বাইরে কাউকেও মন্ত্রিসভায় নেওয়া হয়নি। এটা সম্পূর্ণভাবে আওয়ামী লীগের মন্ত্রিসভা। এখন পর্যন্ত মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়ার কারণে কারও তেমন উচ্চবাচ্য নেই। আশা করি সবাই এ সিদ্ধান্ত মেনে নেবেন। অভ্যন্তরীণ কলহের কোনও সূত্রপাত করবেন না। অনেক পুরনো মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ছিল, তাদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে নানা বিতর্ক ছিল, দক্ষতা ছিল না, সর্বোপরি বয়স হয়েছে তাদের। সুতরাং তাদের মন্ত্রিসভায় না নেওয়াই স্বাভাবিক পরিণতি। একবার চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির অভিযোগ তুলেছিলেন অর্থ বরাদ্দের ব্যাপারে মন্ত্রণালয় তার কাছে ঘুষ দাবি করেছিল। মেয়র ঘুষ দেবেন কোন খাত থেকে? সেবার চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন একটা সাধারণ পৌরসভার চেয়েও কম বরাদ্দ পেয়েছিল।

মন্ত্রিসভা গঠনের সময় নিশ্চয়ই এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধেও অভিযোগের সীমা ছিল না। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধেও অভিযোগ ছিল। খাদ্য কিনে নিম্নমানের খাদ্য সরবরাহ করায় খাদ্য ফেরত পাঠাতে হয়েছিল। মন্ত্রণালয়ের এসব কর্মকাণ্ডে অনেক সময় খোদ প্রধানমন্ত্রীকেও বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়েছে।

যাক, পুরনোদের এই পরিণতিতে অনেকে খুশি। এর মাধ্যমে বিভিন্ন স্তরে, পর্যায়ে নেতৃত্ব গড়ে তোলার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কেউ চিরদিন থাকেন না। এটিও নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগের শেষ মন্ত্রিসভা না। আওয়ামী লীগকে আবারও রাষ্ট্রক্ষমতায় আসতে হলে নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টি করতে হবে। কিছু অভিজ্ঞ লোক এই প্রক্রিয়ায় তৈরি হয়ে যাবেন, যারা ভবিষ্যতে সরকার পরিচালনা করতে পারবেন। নতুন মন্ত্রিসভার মাধ্যমে সে সুযোগ এলো। প্রধানমন্ত্রী যে বিতর্কিত এবং অধিক বয়স্কমুক্ত একটি মন্ত্রিসভা গঠনের নির্মম সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছেন, তার জন্য তাকে ধন্যবাদ জানাই।

ভারতে পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুর প্রধানমন্ত্রিত্বের সময় কংগ্রেসে যখন সাংগঠনিক অবক্ষয় দেখা দিয়েছিল তখন তিনি কংসগ্রেস নেতা কে কামরাজকে দিয়ে একটি পরিকল্পনা পেশ করেছিলেন যা ‘কামরাজ প্ল্যান’ নামে পরিচিত। সেই প্ল্যান অনুযায়ী কংগ্রেসে কঠোরভাবে ঝাড়াই-বাছাই শুরু হয়েছিল। অনেক বড় বড় নেতাকে নেতৃত্বের পদ থেকে সরে দাঁড়াতে হয়েছিল। কংগ্রেসের প্রাক্তন সভাপতি কে কামরাজ-এর প্ল্যানে বলা হয়েছিলো প্রবীণেরা এখন সংগঠনে মনোযোগ দেবেন। অবশ্য মোরারজি দেশাই তার ‘হিস্ট্রি অব মাই লাইফ’–এ লিখেছেন যে সেটি ছিল তাদেরকে তাড়ানোর জন্য কামরাজকে দিয়ে নেহেরুর কূটবুদ্ধি। কংগ্রেসের প্রবীণরাতো দলে মনোযোগ দিয়েছিলেন, আমাদের বিদায়ী প্রবীণেরা কী করেন কী জানি?

১৪ দলীয় জোটের জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টির ও জেপির মন্ত্রীরাও বাদ পড়েছেন। তারা নাকি এখনও মন্ত্রিত্বের ডাক পাওয়ার আশা ছাড়ছেন না। আমি মনে করি এখন তারা তাদের সংসদ সদস্য নিয়ে ট্রেজারি বেঞ্চে না বসে জাতীয় পার্টির মতো বিরোধী পক্ষের আসন নেওয়া উচিত। যেন সরকারের বিরুদ্ধে গঠনমূলক সোচ্চার বিরোধী দল হয়। গত দশ বছর সংসদে কোনও শক্তিশালী বিরোধী দল ছিল না। রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু, মাঈনুদ্দিন খান বাদল, ফজলে হোসেন বাদশা প্রমুখ নেতা বিরোধী আসনে বসলে সত্যই একটা চমৎকার বিরোধী দল হবে। তখন জাতি একটা উপভোগ করার মতো সংসদও পাবে। বিরোধী আসনে শত শত সাংসদ থাকতে হয় না। সংসদে শ্যামা প্রসাদ মুখারজি্ আর রাম মনোহর লোহিয়ার ভয়ে লোকসভায় তটস্থ থাকতেন নেহরু।

এনজিও সুজন কুষ্ঠি বিচার করে বলেছে বাংলাদেশের এবারে নির্বাচিত ২৯৮ জন সংসদ সদস্যের মধ্যে নাকি ২৪৪ জন কোটিপতি। বিষয়টি আনন্দের আবার আতঙ্কেরও। শেরেবাংলার মতো প্রজা দরদী নেতা বেঙ্গল পার্লামেন্টে প্রিমিয়ার থাকার পরও প্রজার অনুকূলে বিল আনা কঠিন হয়েছিল। কারণ, পার্লামেন্ট সদস্যরা ছিলেন অধিকাংশ জমিদার। আমাদের প্রধানমন্ত্রী টানা দশ বছরে দেশের বহুবিধ উন্নয়ন করেছেন। আগামী পাঁচ বছরে সুশাসন চললে আল্লাহর রহমতে আরও উন্নয়ন হবে। শত শত কোটিপতিও আত্মপ্রকাশ করবে। কিন্তু মাথায় রাখতে হবে সমাজের সম্পদ পুঞ্জিভূত হয়ে কোনও গোষ্ঠীর হাতে আটকা পড়লে মানুষের দুঃখ-দুর্দশা বাড়বে। সুতরাং প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী সম্পদ বণ্টন ব্যবস্থায় ভারসাম্য আনার ব্যবস্থা করবেন, এই প্রত্যাশাই করি।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
শিশুকে পালাক্রমে ধর্ষণের অভিযোগে ৪ কিশোর সংশোধনাগারে
শিশুকে পালাক্রমে ধর্ষণের অভিযোগে ৪ কিশোর সংশোধনাগারে
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ