X
মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪
৫ চৈত্র ১৪৩০

সংঘাতে ধর্ষণ কেন অস্ত্র?

জোবাইদা নাসরীন
১২ জানুয়ারি ২০১৯, ১৪:০৯আপডেট : ১২ জানুয়ারি ২০১৯, ১৪:১৫

জোবাইদা নাসরীন এবার ঘটনাটি ঘটলো জাতীয় নির্বাচনে ভোট দানকে কেন্দ্র করে। ঘটনাটির স্থান নোয়াখালীর সুবর্ণচর। খুব বেশি বয়সী চর নয় এটি। সেই রাতে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন একজন নারী। পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন মতে সেই নারী এবং তার পরিবারের সদস্যরা বিএনপির প্রতীক ধানের শীষে ভোট দিয়েছেন এবং এর আগেও নাকি স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ধর্ষণের শিকার নারীর স্বামী ধানের শীষের প্রার্থীর পক্ষে প্রচারে অংশ নিয়েছেন। ধর্ষণের শিকার নারী দাবি করেছেন, নৌকার সমর্থকদের সঙ্গে বাগবিতণ্ডার জেরে তিনি ধর্ষণের শিকার হয়েছেন।
এ বছরের প্রথম দিন থেকেই ঢাকাসহ নানা জায়গায় এই ঘটনার প্রতিবাদ তৈরি হয়। ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে সেই উপজেলার আওয়ামী লীগের খোদ প্রচার সম্পাদকের বিরুদ্ধে। তিনি তার সঙ্গীদের নিয়ে গিয়েছিলেন সেই নারীকে ধর্ষণ করতে। তাই সদ্য নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া আওয়ামী লীগের জন্য এটি এ মেয়াদের প্রথম কাঁটা। এখন পর্যন্ত মোট পাঁচজনকে এ মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে সেই নারী বিচার আদৌ পাবে কিনা সেটিই দেখার বিষয়। কেন এই প্রশ্ন মনে? কারণ বেশিরভাগ ধর্ষণের ঘটনাতেই আসামিদের গ্রেফতার করা হয় এবং তারা এক সময় জামিনে ছাড়া পায়।

বাংলাদেশে নির্বাচন পরবর্তী ধর্ষণ এই প্রথম নয়। মানুষের মন থেকে এখনও ২০০১ সালের নির্বাচন পরবর্তী হত্যা, ধর্ষণ এবং নিপীড়নের স্মৃতি বিস্মৃত হয়নি। সময়ের ফারাক ১৭ বছরের বেশি। তবুও মানুষ মনে রেখেছে সেই আতঙ্ক, নিপীড়নের অভিজ্ঞতার স্মৃতি। স্মৃতি-বিস্মৃতির বিষয়টিও অনেক বেশি রাজনৈতিক। মানুষ কোনও ঘটনাকে মনে রাখবে আর কোনোটাকে ভুলে যাবে সেটিও রাজনীতির অংশ। এমন কিছু বিষয় থাকে যাকে বলা হয়– ‘Remember not to forget’ (অর্থাৎ ভুলে না যাওয়ার জন্যই মনে রেখো), আর ২০০১ সালের নির্বাচনের পর নির্যাতন ছিল সেরকমই। গণমাধ্যমের প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০১ সালের নির্বাচনের দিন থেকে অর্থাৎ ১ অক্টোবর থেকে ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন ৬১ জন সংখ্যালঘু নারী। পূর্ণিমা এখনও সেই নির্যাতনের সরব উদাহরণ এবং বিএনপির জন্য এখনও এক মহা দুঃস্বপ্ন। সন্দেহ না রেখেই বলা যায় সেই সময়ের ঘটনার খেসারত বিএনপিকে দিতে হয়েছে এবং বিএনপির বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থার পেছনে ২০০১-এর নির্বাচন পরবর্তী হামলা– নারী নিপীড়ন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

সেই সময় নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন ৬৪ জন। ১৭ জন খুন হন এবং আহত  হয়েছিলেন ৬০০ জন। সবার অপরাধ ছিল, তারা সংখ্যালঘু। ধারণা করা হয় এদেশের সংখ্যালঘুরা নৌকায় ভোট দেয়। তাই সেবছর নৌকা না জিতলেও এদের নৌকার সমর্থক মনে করে এই ‘শাস্তি’ দেওয়া হয়েছিল। এই সব ঘটনাতে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল বিএনপি নেতা কর্মীরা জড়িত ছিলেন বলেই অভিযোগ ছিল। ২০০২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন জায়গায় এই ধরনের অনেক ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু বেশিরভাগ মামলারই কোনও ধরনের সুরাহা হয়নি।

শুধু ২০১৮ এর ৩০ ডিসেম্বরই নয়, কিংবা ২০০১ সালের নির্বাচনের পর নারী নির্যাতনের মতই আমরা দেখছি এদেশে পার্বত্য চট্টগ্রাম বা সমতলে যত সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটেছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেসব ঘটনায় নারী নিপীড়ন এবং ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। তাহলে প্রশ্ন আসে কেন এই ধরনের নির্বাচনকালীন সংঘর্ষ কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অথবা সাম্প্রদায়িক হামলায় নারীকে টার্গেট করা হয় এবং সেটি কীভাবে অন্য ধর্ষণের চেয়ে পৃথকভাবে পাঠ করা জরুরি হয়ে ওঠে। অনেকেই যুক্তি দেখান যে, ধর্ষক কোনও দল, জাতি বা ধর্মের প্রতিনিধিত্ব করে না। তাই সেই ধর্ষকের রাজনৈতিক পরিচয় গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবে ধর্ষণ যখন রাজনীতির কিংবা যুদ্ধের হাতিয়ার হয় তখন নিশ্চয়ই সেই ধর্ষণটি শুধুমাত্র পুরুষতান্ত্রিক নিপীড়ন হিসেবে বোঝাবোঝি তৈরি করা যাবে না। কারণ এই ধর্ষণটির পেছনে দীর্ঘ মেয়াদী উদ্দেশ্য আছে। তাই সেটি হয়ে পড়ে ‘রাজনৈতিক ধর্ষণ’। কারণ এটিকে তখন শুধুমাত্র পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতা প্রদর্শন ছাড়াও রাজনৈতিক প্রতিহিংসা কিংবা প্রতিশোধের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এর অস্ত্রটির ধার সবাই জানে বলেই ১৯৭১ সালে পাকিস্তানিরা অন্যান্য অস্ত্রের সঙ্গে এই ধারালো অস্ত্রটিকে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেছেন এদেশের মানুষকে স্তব্ধ করতে।

ধর্ষণ কোনও ‘ঘটনা’ নয়, এটি হলো যুদ্ধাপরাধ। কেন এই অস্ত্রটিকে ব্যবহার করা হয় শত্রু বা শত্রুপক্ষকে ঘায়েল করতে? কারণ ধারণা করা হয় এটির মধ্য দিয়ে একজন নারী শারীরিক এবং সামাজিকভাবে ‘হেয়’ হবেন এবং সঙ্গে সঙ্গে ‘মর্যাদাহীন’ করা হবে তার পরিবারকে। পুরো পরিবারই এক নাজুক অবস্থায় পড়বে। তবে ধর্ষণের রাজনৈতিক অর্থনীতিও রয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশে যত সাম্প্রদায়িক হামলা হয়েছে সেখানে বেশিরভাগ গুলোতেই নারী ধর্ষণ এবং নারী নিপীড়ন হয়েছে এবং একটা সময়ে সেই পরিবারগুলোর বেশিরভাগই দেশ ছেড়ে চলে গেছে। সুতরাং এর পেছনে বড় ধরনের রাজনৈতিক অর্থনীতি কাজ করে। তাই এই ধরনের ধর্ষণে পুরষতান্ত্রিক ক্ষমতার পাশাপাশি রাজনৈতিক ক্ষমতা, অর্থনৈতিক ক্ষমতা এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসা কাজ করে। ২০১০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ি জেলার দীঘীনালা উপজেলায় তিন বছরের একটি চাকমা মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছিল, কারণ এর আগেরদিন কাছের একটি এলাকায় বাঙালি-পাহাড়ি সংঘর্ষ হয়েছিল। তার প্রতিশোধ নিতেই ধর্ষণ করা হয়েছিল সেই শিশুটিকে।

নির্বাচনের রাতেই এই ধরনের ধর্ষণের খবর আমাদের শঙ্কিত করে। শঙ্কার কারণ পরপর তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় বসা দলের নেতা-কর্মীরা হয়ে উঠতে পারে আগ্রাসী এবং অপ্রতিরোধ্য। এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের একচেটিয়া বিজয় এবং সে অর্থে কার্যকর বিরোধী দল না থাকার কারণে আওয়ামী লীগকে দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে সতর্কতার নিক্তি আরও বাড়াতে হবে। কারণ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সহিংসতা এবং কোনও ধরনের নারী নিপীড়ন ঘটলে এর দায়ভার ক্ষমতাসীন দল হিসেবেই আওয়ামী লীগকেই যে নিতে হবে এবং সেটিও রাজনৈতিক ধর্ষণ হিসেবেই বিবেচিত হবে। শুধু গ্রেফতার নয়, এই ধরনের ঘটনার বিচার যেন অতি দ্রুত হয় সেই বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে।

আমাদের মনে রাখতে হবে ধর্ষণ, সহিংসতার মতো বিষয়ে রাজনৈতিক আসকারা এই সব ধরনের অপরাধ সংঘটিত করার ক্ষেত্রে উৎসাহ জোগাবে। তাই দলের অপরাধ প্রবণতাবাহী নেতাকর্মীদের নিয়ন্ত্রণের নাটাইটি এখন থেকেই শক্তভাবে চালাতে হবে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগকে।

লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ইমেইল: [email protected]

 

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
দোয়া চেয়ে আইপিএল খেলতে গেলেন মোস্তাফিজ
দোয়া চেয়ে আইপিএল খেলতে গেলেন মোস্তাফিজ
‘চোখের পানি ফেলে বাজার থেকে ফিরতে হয়’
‘চোখের পানি ফেলে বাজার থেকে ফিরতে হয়’
ওয়ালটন ফ্রিজ কিনে মিলিয়নিয়ার হলেন কুমিল্লার হুমায়ুন
ওয়ালটন ফ্রিজ কিনে মিলিয়নিয়ার হলেন কুমিল্লার হুমায়ুন
কলেজ চত্বর থেকে অসুস্থ ভুবন চিল উদ্ধার
কলেজ চত্বর থেকে অসুস্থ ভুবন চিল উদ্ধার
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ