X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

আমেরিকায় উদ্ভূত জটিল পরিস্থিতি

আনিস আলমগীর
২২ জানুয়ারি ২০১৯, ১৪:৩৬আপডেট : ২২ জানুয়ারি ২০১৯, ১৬:১৯

আনিস আলমগীর ষোড়শ শতাব্দীর ফারাসি এক জ্যোতিষী আমেরিকার জন্মের আগে আমেরিকার এক কুষ্ঠি লিখে বলেছিলেন, ‘কৃষ্ণাঙ্গ এক প্রেসিডেন্ট হবেন। তিনি হবেন আমেরিকার শেষ প্রেসিডেন্ট’। বারাক ওবামা আমেরিকার ৪৪তম প্রেসিডেন্ট। তিনি ছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ। ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন।  আড়াই মিলিয়ন পপুলার ভোট বেশি পেয়েছিলেন ডেমোক্র্যাট দলীয় প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন কিন্তু ইলেকট্রোরাল ভোট বেশি পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প। ট্রাম্প কারচুপির মধ্য দিয়ে নির্বাচিত হয়েছেন বলে ডেমোক্র্যাটদের ধারণা। সে নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে রাশিয়ার ষড়যন্ত্র ও ব্যাপক সাইবার কারসাজিতে সবকিছু ওলট-পালট হয়েছে বলে ডেমোক্র্যাটদের অভিযোগ। ডেমোক্র্যাটরা বলেন, ট্রাম্প চরিত্রহীন, লম্পট, দুর্নীতিগ্রস্ত, মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন, অনুপযুক্ত ব্যক্তি। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার পূর্বে কখনও রাজ্য বিধানসভার সদস্যও ছিলেন না। সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ ব্যক্তি। আবার অনেক আমেরিকানদের ধারণা, শ্রেষ্ঠত্ববাদের কথা বলে শ্বেতাঙ্গদের উত্তেজিত করে তিনি নির্বাচিত হয়েছেন।

ট্রাম্পের কাছে আমেরিকান শ্রেষ্ঠত্ববাদ মানে শ্বেতাঙ্গদের আধিপত্য। আমেরিকা হচ্ছে অভিবাসীদের দেশ। দুনিয়ার প্রায় অঞ্চল থেকে লোক এসেছে আমেরিকায়। আদিবাসী রেড ইন্ডিয়ানরা নিঃশেষ হয়ে গেছে। অভিবাসীদের মাঝে ইউরোপের লোক বেশি। স্থপতিরা এ মিশ্র-অভিবাসী নিয়েই আমেরিকান জাতি গঠন করেছিলেন। গত দুই শতাধিক বছরের মধ্যে সবাই সব জাতিসত্তা বিলীন করে দিয়ে এক আমেরিকান জাতি গঠনের প্রয়াস চালিয়েছিলেন। ভিন্ন সুরে কোনও কথা কখনও কেউ বলেননি। আব্রাহাম লিংকনের সময়ে গৃহযুদ্ধ হয়েছিল বৈচিত্রের মাঝে ঐক্যের ব্যাহতের কারণে নয়, দাস প্রথার অব্যাহতি রাখা না রাখা নিয়ে।

আমেরিকার দক্ষিণ অংশ কৃষি প্রধান এলাকা। তাদের কৃষি কাজের জন্য দাস প্রয়োজন ছিল। তারা আফ্রিকা থেকে নিয়া আসা লোকদের দাস ব্যবসায়ীদের থেকে কিনে নিয়েছিলো তাদের কৃষি কাজে নিয়োগের জন্য। দক্ষিণের লোক আতঙ্কিত হয়েছিলো, দাস প্রথা উঠে গেলে তাদের আবাদি ব্যবস্থা লোকের অভাবে বিরান হয়ে যাবে।

গত দুই শতাধিক বছর ধরে আমেরিকান সমাজে শ্বেতাঙ্গদের আধিপত্য ছিল। এ নিয়েও কখনও কোনও ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলো প্রশ্ন তোলেনি। বরং মিলেমিশে ছিল। কৃষ্ণাঙ্গদের নিয়ে যে বিভেদ ছিল তাও শেষ পর্যন্ত মিটে যায়। কৃষ্ণাঙ্গরা শত অত্যাচার সহ্য করেও কখনও আমেরিকান জাতি গঠনের প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করেনি। একবিংশ শতাব্দীর দুই দশকে এসে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বর্ণবাদী কথাবার্তা বলে সাম্প্রদায়িকতাকে উসকানি দিচ্ছেন, যা আমেরিকার সংহতির জন্য খুবই বিপজ্জনক। অথচ আমেরিকানরা গত দুই দুইবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কৃষ্ণাঙ্গ বংশ উদ্ভব বারাক ওবামাকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করে সংহতির ও আমেরিকার গণতন্ত্রের মহাত্ম প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এ জন্য অনেকে সন্দেহ করছেন ট্রাম্প কারও, বিশেষ করে রাশিয়ার চর।

এই ‘উদ্ভট’ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কারণে আমেরিকার সরকারের এক-চতুর্থাংশ কার্যত অচল হয়ে আছে গত ঠিক এক মাস ধরে। গত ২২ ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া ‘শাট ডাউন’ কত দিন চলবে, কেউ বলতে পারছেন না।  ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্প নির্বাচনি প্রচারণায় বলেছিলেন তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে মেক্সিকো সীমান্তে প্রাচীর তৈরি করবেন যেন কোনও অভিবাসী আমেরিকায় ঢুকতে না পারে। মাদক প্রবেশ করতে না পারে। দুই বছর অতীত হয়েছে, তার প্রেসিডেন্সির মেয়াদ দুই বছর বাকি। সুতরাং ট্রাম্প এখন দেয়াল নির্মাণে তৎপর হয়েছেন এবং প্রতিনিধি পরিষদকে ৫৭০ কোটি ডলার বরাদ্দ বিল পাস করার কথা বলছেন। এখন প্রতিনিধি পরিষদে ডেমোক্র্যাটদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। তারা বলছেন, যেটা পাহারা দিয়ে করা সম্ভব সেটাতে এত ব্যয়সাপেক্ষ প্রাচীর নির্মাণ একটা অদূরদর্শী পরিকল্পনা। তারা প্রাচীর নির্মাণের বরাদ্দ বিল পাস করবে না।

এ বিরোধে ট্রাম্প বেঁকে বসেছেন। এখন তিনি প্রতিনিধি পরিষদ যেসব কর্মচারী কর্মকর্তার বেতনের বিল পাস করে পাঠিয়েছে তাতেও স্বাক্ষর করছেন না। দীর্ঘদিনের এ বিরোধের কারণে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এখন বেতন পাচ্ছে না। কর্মচারী-কর্মকর্তাদের প্রতি সহানুভূতি জানিয়ে কংগ্রেসম্যানেরাও এ পর্যন্ত তাদের জন্য প্রদত্ত কোনও আর্থিক সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করেনি।

ট্রাম্প বিকল্প প্রস্তাব করেছেন। টেক্সাস এবং ফ্লোরিডার বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য প্রদত্ত অর্থের যে ১৪ বিলিয়ন ডলার আর্মি ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের তহবিলে জমা আছে সে অর্থ দিতে বলছেন। প্রতিনিধি পরিষদ বলছে, এ অর্থ দুর্গতদের জন্য, প্রাচীর নির্মাণের জন্য নয়। এখন ট্রাম্প বলছেন তিনি মেক্সিকো সীমান্তের চোরাচালান, মাদকপাচার, সীমান্ত নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে জাতীয় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করবেন। সে কারণে তিনি এখন সীমান্ত এলাকা সফর করছেন।

সবশেষে ফেডারেল সরকারের অচলাবস্থা নিরসনে ‘সমঝোতার’ জন্য বেশ কিছু প্রস্তাব তুলে ধরেছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। ট্রাম্পের প্রস্তাবগুলোর মধ্যে রয়েছে, অভিবাসন নীতি বিষয়ক ড্রিমারস ও টেম্পরারি প্রোটেকশন স্ট্যাটাসের (টিপিএস) মেয়াদ বাড়ানো।  আংশিকভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়া ফেডারেল সরকারের কাজকর্ম (শাট ডাউন) আবার চালু করতে ট্রাম্পের ‘সমঝোতা প্রস্তাবগুলোর’ একটি হচ্ছে কথিত ড্রিমার ইস্যু। বাবা-মায়ের সঙ্গে অবৈধভাবে কম বয়সে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশকারীদের ‘ড্রিমারস’ বলা হয়ে থাকে। তবে তিনি এখনও মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল নির্মাণে ৫৭০ কোটি ডলারই চাইছেন।

ট্রাম্প তার ক্ষমতার বলে হয়তোবা জরুরি অবস্থা জারি করতে পারেন কিন্তু আদালতের কারণে তার পক্ষে সে ঘোষণা টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে। আমেরিকার স্থপতিরা শাসনতন্ত্র রচনা করার সময় এমনভাবে ক্ষমতার বিন্যাস করেছিলেন যে কংগ্রেস, প্রেসিডেন্ট, বিচার বিভাগ কেউ একতরফাভাবে কিছু করা কখনও সম্ভব হয়নি, এখনও সম্ভব হবে না। ডোনাল্ড ট্রাম্প ও প্রতিনিধি পরিষদের মধ্যে যা হচ্ছে তাতে দেখা যাচ্ছে ৫৩ শতাংশ মানুষ ট্রাম্পের ওপর বিরক্ত আর প্রতিনিধি পরিষদকে দায়ী করছেন ২৯% মানুষ।

ট্রাম্প মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তিনি মনে করছেন এই দেয়াল তৈরি করতে পারলে ২০২১ সালে দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে তিনি জিতে আসবেন। কিন্তু প্রতিনিধি পরিষদ এ দেয়াল করার ব্যাপারে সম্পূর্ণভাবে অনিচ্ছুক। তারা বলছে, তারা কখনও অপ্রয়োজনীয় দেয়াল করতে দেবেন না। সে কারণে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে।

ডেমোক্র্যাটরা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিশংসন প্রস্তাব উত্থাপনের বিষয়টা নিয়ে খুবই নীরবে অগ্রসর হচ্ছেন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাশিয়ার সম্পৃক্ততা সম্পর্কে তদন্তের জন্য ফেডারেল ব্যুরো অব ইন্টিলিজেন্সের উদ্যোগকে হতাশ করে দেওয়ার জন্য ট্রাম্প ব্যুরোর ডাইরেক্টর জেমস টমিকে বরখাস্ত করে দেন। বিষয়টা সেখানে শেষ করা সম্ভব হয়নি। পরে আদালত সাবেক এফবিআই প্রধান ও বিশিষ্ট আইনজীবী মুলারের নেতৃত্বে এক উচ্চপর্যায়ের কমিশন গঠন করে দেন। এ কমিশন তাদের কাজ প্রায় শেষ করেছে বলে জানা গেছে। এ কমিশন ট্রাম্পের শুধু নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান ম্যানেফোট বা তার সহকারী জেমস কোহেনকে নয়, ট্রাম্পের পুত্র জুনিয়র ট্রাম্প ও তার জামাই কুশনারকেও জেরা জবানবন্দির সম্মুখীন করেছে।

মেনোফেট এবং কোহেন বিভিন্ন বিষয়ে তাদের দোষ স্বীকার করেছেন। নিউইয়র্ক আদালতে তাদের সাজাও হয়েছে। রাশিয়ার সঙ্গে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সাইবার কারসাজি জনিত কেলেঙ্কারি ও নির্বাচন তহবিল নিয়ে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। এসব কেলেঙ্কারির সঙ্গে পল মেনোফেট এবং তার ব্যক্তিগত সহকারী জেমস কোহেন সরাসরি জড়িত ছিলেন বলে বিভিন্ন তথ্য বেরিয়ে এসেছে। ট্রাম্প টাওয়ারে নির্বাচনের সময় রাশিয়ান কূটনীতিকদের আনাগোনা এবং জুনিয়র ট্রাম্প ও কুশনারের বৈঠকের কথাও প্রকাশিত হয়েছে।

মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই চূড়ান্তভাবে সন্দেহ করছে যে ট্রাম্প রাশিয়ার একজন চর। ট্রাম্পের পক্ষ অবলম্বনকারী ফক্স টেলিভিশনের সাংবাদিক জেনিন ক’দিন আগে ট্রাম্পকে প্রশ্ন করেছিলেন, বর্তমানে কিংবা অতীতে রাশিয়ার জন্য কখনও কাজ করেছেন কিনা। তাতে ট্রাম্প দুঃখ প্রকাশ করে বলেছেন, এ ধরনের প্রশ্ন তার জন্য সম্মান হানিকর। নিউইয়র্ক টাইমস সংবাদটি অন্তত গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ করেছে। মার্কিন নাগরিকেরা এ বিষয়টা নিয়ে অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়েছে যে, লোকে বলাবলি করে তাদের প্রেসিডেন্ট রাশিয়ার ‘চর’।

ডেমোক্র্যাটরা বা মর্যাদাবোধসম্পন্ন আমেরিকানরা খুবই অস্বস্তির মধ্যে আছেন। কারণ, দেয়াল নির্মাণ করলে দ্বিতীয়বার অশিক্ষিত শ্বেতাঙ্গদের ভোটে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে পারেন। অথচ আমেরিকার মতো পরাশক্তির প্রেসিডেন্ট হওয়ার কোনও উপযুক্ততা ট্রাম্পের নেই। অভিশংসনও সম্ভব হচ্ছে না। কারণ, প্রতিনিধি পরিষদে ডেমোক্র্যাটদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলেও সিনেটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই। সিনেটে অভিশংসনের বিল দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে পাস হতে হয়। ট্রাম্প সম্পর্কে ডেমোক্র্যাটরা এবং আমেরিকান সুশীল সমাজের সিনেটের রিপাবলিকান সদস্যদের বোঝানোর চেষ্টা করা প্রয়াজন। অন্যথায় আমেরিকার অবস্থা ষোড়শ শতাব্দীর ফরাসি জ্যোতির্বিজ্ঞানীর কথার অনুরূপই হতে পারে।লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ইরাক ও আফগান যুদ্ধ সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।

[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
দুই বলের ম্যাচে জিতলো বৃষ্টি!
পাকিস্তান-নিউজিল্যান্ড প্রথম টি-টোয়েন্টিদুই বলের ম্যাচে জিতলো বৃষ্টি!
লোকসভা নির্বাচন: প্রথম ধাপে পশ্চিমবঙ্গের ৩ আসনে ভোট আজ
লোকসভা নির্বাচন: প্রথম ধাপে পশ্চিমবঙ্গের ৩ আসনে ভোট আজ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ