X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

ছেলেমেয়েদের হাতে মোবাইল ফোন থাকবে কী থাকবে না!

রেজানুর রহমান
২৩ জানুয়ারি ২০১৯, ১৫:২৭আপডেট : ২৩ জানুয়ারি ২০১৯, ২০:১৩

রেজানুর রহমান আমার এক আত্মীয় হঠাৎ অফিসে এসে হাজির। একটা প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন। তার ধারণা আমি প্রশ্নটার উত্তর দিতে পারবো। তাকে আশ্বস্ত করে বললাম, প্রশ্নটা আগে শুনি। তারপর না হয়...। তিনি ঠিক প্রশ্ন নয়, একটা ঘটনার বর্ণনা দিতে শুরু করলেন।
তার ছোট ভাইয়ের ছেলে। ক্লাস ওয়ানে পড়ে। পড়াশোনায় ভালো। সে জন্য পরিবারের সবাই তাকে আদরও করে। কিন্তু এই ভালো ছেলেটাকে নিয়ে তাদের পরিবারে একটা অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। ক্লাস ওয়ানের ছেলে কতইবা বয়স? কিন্তু কথাবার্তায় মনে হবে সবার মুরুব্বি। এ ব্যাপারেও কারও কোনও আপত্তি নেই। আপত্তি শুধু ছেলেটির ফেসবুক আসক্তিকে ঘিরে। বাসায় যতক্ষণ থাকবে ততক্ষণ তার ইচ্ছা অনুযায়ী ফেসবুকে ঢুকতে দিতে হবে। পারলে ঘুমের মধ্যেও সে ফেসবুক চালাতে চায়। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, তাকে কোনও কথা বললেই ফেসবুকে ঢোকার শর্ত দিয়ে বসে। ধরা যাক, তাকে বলা হলো বাবু পড়তে বসো। সঙ্গে সঙ্গেই শর্ত জুড়ে দেয়, একঘণ্টা পড়বো। তারপর কিন্তু আমাকে মোবাইলে খেলতে দিতে হবে। মোবাইলে খেলা মানেই ফেসবুকে ঢুকে যাওয়া। শুধু ফেসবুক নয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সর্বত্রই সে অনায়াসে ঢুকতে পারে। সে যেন অবাক করা জাদুকর। মোবাইলে মাঝে মাঝে সে এমন কিছু জাদু দেখায়, তখন পরিবারের সবাই বিব্রত হয়। বয়স অনুযায়ী এসব জাদু দেখানো তার উচিত নয়। এমন পরিস্থিতিতে পরিবারটির করণীয় কী? তার হাত থেকে মোবাইল নিয়ে নেওয়া? একদিন সেটাই করা হলো। তার হাত থেকে মোবাইল নিয়ে বলা হলো, বাবু সব সময় মোবাইলে ব্যস্ত থাকা ঠিক নয়। এতে তোমার চোখের ক্ষতি হবে। ব্যস, লঙ্কাকাণ্ড বেধে গেলো। অতটুকু ছেলে অনশন করে বসলো। খাবে না, পড়বে না। স্কুলেও যাবে না। তাকে যতই বুঝানো হয় সে ততই উত্তেজিত হয়…।

এই পর্যন্ত বলে আমার সেই আত্মীয় থামলেন, মনে হলো আমার কাছে জবাব চাইছেন!

কী জবাব দেবো তাকে? কী বললে তিনি খুশি হবেন? এই যে বাচ্চা ছেলেটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রতি এত আসক্ত হয়েছে এজন্য কি সে দায়ী? সময়টা কি দায়ী নয়? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে হলের টিভিরুমে আমি প্রথম সরাসরি টেলিভিশন অনুষ্ঠান দেখি। আমাদের ছোটবেলায় ল্যান্ডফোন দেখাও ছিল একটা বিস্ময়কর ব্যাপার। প্রথমে ক্রিং ক্রিং শব্দ হয়। তারপর হাতলের মতো একটা জিনিস উঠিয়ে কথা চলতেই থাকে। ছোটবেলায় কতই না ভেবেছি, আহ্ একবার যদি টেলিফোনে কথা বলতে পারতাম। কী আছে ওই যন্ত্রের ভেতর, কথা বললে কেমন অনুভূতি হয় তা দেখার খুব ইচ্ছে। মনে পড়ে আমি তখন পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। বড়লোক বন্ধুর বাসায় বেড়াতে গেছি। বন্ধুর বাসায় টেলিফোন সেট দেখে খুব ইচ্ছে হয় কথা বলার। সেদিনই প্রথম ল্যান্ডফোনে কথা বলি। ব্যাপারটা সত্যি বিস্ময়কর মনে হয়েছিল। তারের মাধ্যমে কথা আসে আর যায়, এরচেয়ে বিস্ময়কর আর কী হতে পারে।

কিন্তু বর্তমান সময়ের তুলনায় সেটা তো ছিল অতি নগণ্য ব্যাপার। এখনকার ছেলেমেয়েরা বলা যায় মায়ের পেট থেকে বেরিয়েই পৃথিবীর যতসব আধুনিক প্রযুক্তি আছে তার সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওঠে। কেউ কি কোনও দিন ভেবেছিল পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকি না কেন মোবাইল ফোনে পরস্পরের ছবি দেখে সুখ-দুঃখের কথা বলা যাবে? একটি টেলিফোন যন্ত্রই হয়ে উঠবে প্রভুর মতো। সবকিছুই তার নিয়ন্ত্রণে থাকবে। ফেসবুকে এক বন্ধু মোবাইল ফোনকে খাদক হিসেবে তুলনা করে লিখেছেন, মোবাইল ফোন একা কত কিছু খায় একবার ভেবে দেখুন। এখানে তিনি ‘খায়’ অর্থে একক কর্তৃত্বের কথা বলেছেন। তিনি লিখেছেন, মোবাইল ফোন চালু হওয়ার পর রেডিও সেট অকেজো হয়েছে, টর্চলাইটের প্রয়োজন আর পড়ে না। খেলার মাঠের প্রয়োজনীয়তা নেই বললেই চলে। ক্যালকুলেটরের আর প্রয়োজন নেই। স্টিল ও মুভি ক্যামেরারও প্রয়োজন ফুরিয়েছে। টেপরেকর্ডারেরও প্রয়োজন নেই। এমনই আরও অনেক বিষয় তিনি তুলে ধরেছেন, যা একটি স্মার্ট মোবাইল ফোন থাকলেই পাওয়া সম্ভব। অর্থাৎ মোবাইল ফোন একাই কতকিছু করতে পারে। দেখাতেও পারে। কাজেই তার প্রতি ছেলেমেয়েরা আকৃষ্ট হবে সেটা বলাই বাহুল্য। কিন্তু প্রশ্ন হলো আমরা কি এক্ষেত্রে কোনও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু করতে পারি না?

তার আগে সবিনয়ে একটা কথা বলতে চাই, তথ্যপ্রযুক্তির বিস্ময়কর অগ্রগতিকে কাজে লাগিয়েই আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় সগৌরবে এগিয়ে যাচ্ছে। কেউ কি কোনও দিন ভেবেছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার ফরম কেনা ও জমা দেওয়ার কাজ ইন্টারনেটের মাধ্যমে ঘরে বসেই সমাধান করা যাবে। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের বিল ঘরে বসেই দেওয়া যাবে?

কৃষকের ফসলের ক্ষেতের প্রয়োজনীয় তথ্য মিলবে মোবাইল ফোনে। বাস, লঞ্চ, বিমানের টিকিটও একটি স্মার্টফোনের মাধ্যমে কেনা সম্ভব কেউ কি তা ভেবেছিল? এ রকম অসংখ্য সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে একটি স্মার্ট মোবাইল ফোন। কাজেই তাকে অস্বীকার করবো কোন যুক্তিতে? কিন্তু ক্ষেত্রবিশেষে নিয়ন্ত্রণও তো করা যায়?

খোঁজ নিলে দেখা যাবে, দেশের ধনী গরিব প্রায় সব পরিবারেই প্রতিটি সদস্যের হাতে মোবাইল ফোন শোভা পাচ্ছে। স্কুলগামী কোমলমতি শিশুদের হাতেও অনেক বাবা-মা বইয়ের ব্যাগের সাথে স্মার্ট মোবাইল ফোন তুলে দিচ্ছেন। স্কুলে যাওয়ার সময় ছেলেকে অথবা মেয়েকে বলে দিচ্ছেন, স্কুলে পৌঁছে ফোন দিও। স্কুলে পৌঁছে ছেলে অথবা মেয়ে ফোন না দিলে বাবা-মা অস্থির হয়ে নিজেই ফোন দিচ্ছেন। এখন কথা হলো, স্কুলগামী ছেলেমেয়েদের হাতে স্মার্টফোন তুলে দেওয়া কতটা যৌক্তিক? একটি স্মার্টফোনের সঙ্গে যদি থাকে ইন্টারনেট সংযোগ তাহলে গোটা পৃথিবীটা তখন এসে যায় তার হাতের মুঠোয়। কোমলমতি একটি শিশু যখন কোনও নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই বাবা-মায়ের হাত থেকে স্মার্ট মোবাইল ফোন উপহার পায় তখন সে ভয়ঙ্কর জাদুঘরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। স্কুলে ক্লাসের ফাঁকে অথবা বাসায় অবসর সময়ে মোবাইল ফোনে ভার্চুয়াল পৃথিবীতে ঢুকে যায়। যা দেখে তা-ই তার কাছে বিস্ময়কর ঠেকে। কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ, এ ব্যাপারে তার কোনও হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। অনেক বাবা-মা কোমলমতি ছেলেমেয়েদের ‘মোবাইল জ্ঞান’ নিয়ে অহংকারও করেন। বাসায় আত্মীয়-স্বজন বেড়াতে এলেই অহঙ্কারের সঙ্গে বলতে থাকেন, জানেন আমাদের বাবু মোবাইলের জাদুকর হয়ে উঠেছে। কত কিছু যে বের করতে পারে। না দেখলে বিশ্বাস করতে পারবেন না। বাবা-মায়ের অসতর্ক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে এভাবেই কোমলমতি শিশু-কিশোরেরা মোবাইল ফোনের প্রতি অতিমাত্রায় আসক্ত হয়ে উঠছে। দেশের একটি পত্রিকার প্রতিবেদনে পড়লাম, মোবাইল ফোনের প্রতি শিশু-কিশোরদের অতিমাত্রায় আসক্তিকে মাদকের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। অর্থাৎ অতিমাত্রায় মোবাইল ফোন আসক্তিও এক ধরনের মাদকতা। তাহলে আমরা কী করতে পারি? ছেলেমেয়েদের হাত থেকে মোবাইল কেড়ে নেবো? নিশ্চয়ই না। এটা করলে তথ্যপ্রযুক্তির বিস্ময়কর পরিবর্তনকে অসম্মান করা হবে। বরং পরিবর্তনকে মেনে নিয়েই আমরা কি করতে পারি তা ভাবা দরকার। তার আগে একটি ছোট্ট গল্পচিত্র আপনাদের সামনে তুলে ধরতে চাই।

ছোট্ট একটি মেয়ে সম্ভবত তার বাবার সঙ্গে কথা বলছে। বাবাকে দেখা যাচ্ছে না। তবে বোঝা যাচ্ছে মেয়ের পাশে বিছানায় শুয়ে আছেন বাবা। আদুরে মেয়ের সাথে আয়েশী ভঙ্গিতে বাবা কথা বলছেন। ছোট্ট মেয়েটি দেখতে পরীর মতো সুন্দর। চেহারার মতো তার মুখের ভাষাও অনেক সুন্দর। শাসন করার ভঙ্গিতে বাবার সঙ্গে কথা বলছে সে, তুমি তো আমার কথা শোনো না…।

বাবা হাসতে হাসতে বললেন, আমি তোমার কোন কথা শুনি না, বলো?

মেয়েটি আদুরে ভঙ্গিতেই রেগে উঠলো, তুমি আমার কোন কথা শোনো বলো। তোমাকে আমি যা বলি তুমি তার উল্টোটা করো!

বাবা মৃদু হেসে বললেন, আরে বাবা তুমি আমাকে স্পষ্ট করে বলো না, তুমি কোন কথাটা বলেছো আমি শুনি নাই?

ছোট্ট মেয়েটি এবার আদুরে গলায় বললো, তুমি সিগারেট খাও আমার পছন্দ নয়। এটা বন্ধ করো। তোমার এই অভ্যাস আমার ভালো লাগে না।

প্রিয় পাঠক, এটি একটি ভিডিওচিত্র। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এই ভিডিওচিত্রে বাবা ও ছোট্ট মেয়ের মধ্যে আরও অনেক কথা আছে। যা শুনলে আপনার মন ভালো হয়ে যাবে। এটাই হলো একটা পরিবর্তনের চিত্র। যেখানে একটি ছোট্ট মেয়ে তার বাবাকে সিগারেট খেতে বারণ করছে। এটাই প্রমাণ করে আমাদের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা চিন্তাচেতনায় কতটা স্মার্ট। কাজেই তাদের ভালো-মন্দ বোঝানো গেলে তারা বুঝবে। এই ভরসায় আমরা কি কিছু পদক্ষেপ নিতে পারি না?

স্কুল-মাদ্রাসায় এই পদক্ষেপের প্রাথমিক পাঠ শুরু হতে পারে। পাঠ্যপুস্তকে মোবাইল ফোনের ব্যবহার নিয়ে সচেতনতামূলক অধ্যায় রাখা যেতে পারে। বাবা-মায়ের কাছে তার সব ছেলেমেয়েই অনেক আদরের। সেজন্য সবার হাতেই মোবাইল ফোন তুলে দিতে হবে এটাও ঠিক নয়। বয়সের একটা সময় পর্যন্ত ছেলেমেয়েদের হাতে স্মার্ট মোবাইল ফোন না থাকলে কী এমন এসে যায়। দায়িত্বটা কিন্তু বাবা-মায়েদেরই নিতে হবে। ভালো থাকবেন সকলে।

লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক- আনন্দ আলো

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আট বছর পর জাবিতে ডিন নির্বাচন
আট বছর পর জাবিতে ডিন নির্বাচন
তামাকে বিষ, তবুও ঝুঁকছেন কৃষক 
তামাকে বিষ, তবুও ঝুঁকছেন কৃষক 
এফএ কাপে হাল্যান্ডকে নিয়ে সংশয়ে সিটি
এফএ কাপে হাল্যান্ডকে নিয়ে সংশয়ে সিটি
মার্কিন কংগ্রেসে ইউক্রেনের বহুল প্রতীক্ষিত সহায়তা বিলে ভোট আজ
মার্কিন কংগ্রেসে ইউক্রেনের বহুল প্রতীক্ষিত সহায়তা বিলে ভোট আজ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ