X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

বিজেপিবিরোধী জোট: ভারতের রাজনীতিতে নয়া মেরুকরণের আভাস

মো. শরীফ হাসান
২৭ জানুয়ারি ২০১৯, ১৫:৪১আপডেট : ২৭ জানুয়ারি ২০১৯, ২০:৩৭

মো. শরীফ হাসান আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও তার দল বিজেপিকে ক্ষমতা থেকে সরাতে গত শনিবার ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের ডাকে কলকাতার ব্রিগেড ময়দানে মহাসমাবেশ করেছে ভারতের ২৩টি রাজনৈতিক দল। লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতিতে নির্বাচনে একজোট হয়ে বিজেপি’কে হারানোর বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সমাবেশে যোগ দেয়া বিরোধী দলগুলোর নেতারা। বিজেপি’র বিরুদ্ধে ধর্মের নামে ভারতজুড়ে বিভাজন তৈরি, ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন নিয়ে কারচুপি, ঘৃণাজনিত অপরাধে মদত দেওয়াসহ নান অভিযোগ এনে ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনকে ভারতের দ্বিতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম বলে অভিহিত করেন তারা। নির্বাচনকে সামনে রেখে নয়া মেরুকরণের আভাস দিচ্ছে এই মহাসমাবেশ। 
এক.

সর্বভারতের ভিত্তিতে জোটের ঘোষণা করা এখনও বেশ কঠিন। অনেক দল একসাথে হয়েছে। কংগ্রেস এখানে আসেনি কিন্তু তারা বার্তা পাঠিয়েছে। কংগ্রেস নিজেও কিন্তু চেষ্টা করছে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে এক ধরনের সমঝোতা গড়ে তোলার। ভারতে আসলে ওভাবে বিরোধী জোট সর্বভারতের ভিত্তিতে হবে বলে অনেক বিশ্লেষক সংশয় প্রকাশ করেন। তবে বিশ্লেষকরা মনে করেন, রাজ্যে রাজ্যে জোট গড়ে উঠবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, উত্তর প্রদেশে কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে কিন্তু এক ধরনের জোট হয়ে গেছে; বিএসপি ও সমাজবাদী দলের মধ্যে। এবং তারা ভাবছে যে কংগ্রেসকে ছাড়াও জিততে পারবে। হয়তো পারবে, কারণ দুটো দলই উত্তর প্রদেশে যথেষ্ট শক্তিশালী। একটা কথা প্রচলিত আছে, উত্তর প্রদেশ যাদের কাছে যায় সাধারণত তারা কিন্তু কেন্দ্রের ক্ষমতায় পায়। এদিক থেকে আমাদের দেখতে হবে, এই যে ২৩ বা ২২ দল চলে এসেছে ; তৃণমূল কংগ্রেস কিন্তু বেশিরভাগ রাজ্যে নেই। তাতে কিন্তু আসে যায় না। আসল কথা হলো, রাজ্যে রাজ্যে বিভিন্ন জোট হবে, সেটা আরেকটু শক্তভাবে করতে পারে। শেষ পর্যন্ত ফলাফল বলা কঠিন। তবে বিজেপির জন্য কিন্তু আগামী লোকসভা নির্বাচনে জেতা কঠিন হবে। অতীত পরিসংখ্যান ঘাঁটলে দেখা যায়, সর্বভারতের ভিত্তিতে ভোটের শতাংশ হিসেবে বিজেপি কিন্তু কখনোই খুব বেশি ভোট পেয়ে জিতে আসেনি ।

 দুই.

প্রধানমন্ত্রী কে হবেন? নেতা কে হবেন? নেতা কে এই দলে—বিজেপিও এই প্রশ্ন তুলেছ? তবে সেটা কতখানি গুরুত্বপূর্ণ? ভারত আবার কোয়ালিশন সরকারে ফিরে যেতে চায় কিনা সেটা নিয়ে ভারতীয় পত্রপত্রিকাগুলো বিশ্লেষণ করছে।

সোজা বলতে গেলে ভারতের রাজনীতিতে কে প্রধানমন্ত্রী হবেন সেটা ঘোষণা করা নতুন একটা বাস্তবতা। কখনোই কিন্তু ব্যাপারটা এরকম ছিল না। আগে যেটা ছিল যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী দলের যিনি প্রধান তিনিই হতেন। সেটা নিয়ে ভোটারদের মধ্যে যাওয়া বা তাদের আগে থেকেই বলা, এটা কিন্তু ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদিকে আগে থেকেই প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করে এক ধরনের নাটকীয়তার সূচনা করা হয়। ভারতের রাজনীতিতে এটা অত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল না ।

ভারতে কোয়ালিশন রাজনীতি ১৯৮৯-১৯৯০-এর দিক থেকে শুরু হয়েছে । এখন সেখানে আঞ্চলিক দল কিংবা জাতীয় পর্যায়ের যে দলগুলো আছে তারা বিভিন্ন ধরনের কোয়ালিশন করছে। ২০১৪ সালে যখন মোদি ক্ষমতায় আসেন, তিনিও কিন্তু একটা কোয়ালিশন থেকে আসেন, এনডিএ থেকে আসেন। তার আগে, মনমোহন সিং দুই দফা ক্ষমতায় ছিলেন একটা কোয়ালিশনকে নেতৃত্ব দিয়ে, সেটি হচ্ছে ইউপিএ। এর আগেও, কোয়ালিশন রাজনীতিটা বাজপেয়ি সরকারের সময়ে ছিল এবং কংগ্রেস সরকারের সময়ে ছিল। ১৯৫০ বা ১৯৫২ সাল থেকে ৯০-এর দশকের শুরু পর্যন্ত কংগ্রেসের একক আধিপত্যের সময়ে কোয়ালিশনটা সেভাবে ডেভেলপ করেনি, যদিও মোরারজি দেশাই অল্প সময়ের জন্য ১৯৭৭ সালে ক্ষমতায় ছিলেন। কিন্তু এই যে ভারতের পরিবর্তনটা এটা আলোচনার দাবি রাখে। এখন যেটা দেখছি, মমতা যে র‌্যালিটা করলো এবং সেখানে ২৩টা দল অংশগ্রহণ করেছে। কংগ্রেসের সাথে সম্পর্কটা ইন্টারেস্টিং; কংগ্রেস এখানে প্রতিনিধি পাঠিয়েছে। আবার তারা বলছে, তেলেঙ্গানাতে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে কোয়ালিশন করবে। তার মানে, রাজ্যভিত্তিক বা অঞ্চলভিত্তিক কোয়ালিশন হবে, জাতীয়ভাবেও কোয়ালিশন হতে পারে। সর্বোপরি, একটা অ্যান্টি-বিজেপি ট্রেন্ডও থাকবে। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে, যত সম্ভাব্য উপায় আছে সেগুলো ব্যবহার করে বিজেপি’কে কীভাবে ক্ষমতার বাইরে রাখা যায় সেই চেষ্টা কিন্তু থাকবে। এই সমাবেশে তিনটি সুনির্দিষ্ট স্ট্যাটের কথা বলা হয়েছে, একটা হচ্ছে উত্তর প্রদেশ, যেখানে ৮০টি সিট আছে; তার মধ্যে ৭৬টি সিট বিজেপি পেয়েছিল। তাদের ভোট ছিল মাত্র ৩৫ শতাংশ; ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে এই ৩৫ শতাংশ ভোট নিয়ে তারা ৭৬টি সিট পেয়েছিল।

আর এখন বিএসপি এবং সমাজবাদী দল ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ফলে তাদের ভোটের হিসাবটা দাঁড়ায় প্রায় ৫০ শতাংশ। যার অর্থ দাঁড়ায়, বিজেপি’কে আসন্ন মে মাসে লোকসভা নির্বাচনে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে।

এদিকে, পশ্চিমবঙ্গে মমতার একটা আধিপত্য আছে। আবার, তামিলনাড়ুতে ৩৯টি সিট আছে। সব মিলিয়ে, এই তিনটা স্ট্যাটে লোকসভার মোট ৫৩৫টি আসনের মধ্যে ১৬১ সিট। সুতরাং, বিজেপির পিছিয়ে থাকার বিষয়টা তারা সরল-অংক করে দেখাচ্ছে। এর বাইরে রাজস্থান, মধ্য প্রদেশ এবং ছত্রিশগড়ে কংগ্রেসের যে নতুন করে আধিপত্য বা নতুন করে ইতিবাচক পুনরুত্থান হয়েছে; তাতে বোঝা যাচ্ছে তিনটি ধারা ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে মুখোমুখি লড়াইয়ে থাকবে।

তিন.

নির্বাচন যতই এগিয়ে আসবে নির্বাচনের কৌশলও নানারূপ নেবে। ভারত যেহেতু একটা ফেডারেল স্ট্যাট, ফলে ফেডারেল স্ট্যাটের জন্য কিছু সুবিধা আছে, জাতীয়ভাবে তারা এক ধরনের জোট বা কোয়ালিশনের কথা বলবে, এক ধরনের অবস্থান থাকবে। আবার অন্যদিকে, রাজ্যপর্যায়ে তাদের একটা ভিন্ন হিসাব-নিকাশ কাজ করবে, তাদের একটা সাধারণ শত্রু যদি তারা ঠিক করতে পারে। যদি এমন হয় যে কংগ্রেসের একটা সাধারণ শত্রু মোদি এবং তৃতীয় শক্তিরও ( মমতা যেটা করতে চাচ্ছে) সাধারণ শত্রু মোদি। আবার, মোদির সাধারণ শত্রু একইসাথে কংগ্রেস ও তৃতীয় জোট। তৃতীয় শক্তি ভোটের শতাংশে কম নয়।

ফলে, একটা ত্রিমুখী লড়াই আমরা দেখছি এবং সেই লড়াইয়ে রাজ্যপর্যায়ে এক ধরনের কৌশল থাকবে, আবার জাতীয় পর্যায়ে থাকতে পারে; এভাবেই কিন্তু নির্বাচনে এগিয়ে যাবে।

শেষকথা, যে প্রত্যাশা মোদি সরকার পূরণ করতে পারেননি, সেটা এই অল্প চার মাসের মধ্যে পারবেন তা মনে করার কোনো কারণ নেই। কাজেই, সম্ভবত বিজেপি আরেকবার হিন্দুত্ববাদের ধোঁয়া তুলবে এবং সেটার ফায়দা পাওয়ার চেষ্টা করবে। একটা সন্দেহ যে সেটা আগেরবারের মতো কার্যকর নাও হতে পারে ।

লেখক: শিক্ষক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

/এমওএফ/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
১০ জন নিয়েও কৃত্রিম আলোয় ইয়ংমেন্সের উৎসব
১০ জন নিয়েও কৃত্রিম আলোয় ইয়ংমেন্সের উৎসব
পোড়া রোগীদের যন্ত্রণা বাড়াচ্ছে তাপপ্রবাহ
পোড়া রোগীদের যন্ত্রণা বাড়াচ্ছে তাপপ্রবাহ
নিখোঁজের ২৫ দিন পর ছাত্রলীগ নেতার মরদেহ উদ্ধার
নিখোঁজের ২৫ দিন পর ছাত্রলীগ নেতার মরদেহ উদ্ধার
যুক্তরাষ্ট্র বড় শক্তি, তাদের পরোয়া করতে হয়: শ্রম প্রতিমন্ত্রী
যুক্তরাষ্ট্র বড় শক্তি, তাদের পরোয়া করতে হয়: শ্রম প্রতিমন্ত্রী
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ