X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

দুর্নীতি বাড়লে উন্নয়ন বিপথে হারায়

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
৩০ জানুয়ারি ২০১৯, ১৪:৩৯আপডেট : ৩০ জানুয়ারি ২০১৯, ১৪:৪২

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা স্কুলে, হাসপাতালে হানা দিচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশনের কর্তারা। গিয়ে দেখছে যথেষ্ট উপস্থিতি নেই মাস্টার আর ডাক্তারদের। দুদকের অভিযানটা নতুন, কিন্তু চিত্রটা বহু পুরনো। কর্মস্থলে সরকারি কর্মীদের উপস্থিত না থাকাটা এই দেশের কর্মসংস্কৃতি। সাধারণে একটা ধারণা আছে যে, দেশের সরকারি অফিসে কর্ম নয়, অনিয়ম আর দুর্নীতি উৎপাদিত হয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কল্যাণে সরকারি কর্মীদের জীবন এখন বিলাসী পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। বেতন বেড়েছে বহুগুণ, সুবিধা বেড়েছে ততধিক। তারপরও দুর্নীতি কেন হয়? কেন এরা দুর্নীতিতে জড়ায়? এসব প্রশ্নের সরাসরি কোনও উত্তর নেই। কিন্তু একটা বিষয় পরিষ্কার, দুর্নীতি করলে শাস্তি হবে এমন কোনও ভয় কারও ভেতরে কাজ করে না। দুর্নীতির সম্ভাব্য শাস্তির চেয়ে প্রত্যাশিত আয় অনেক বেশি এই দেশে। তাই দুর্নীতি নিবারণের পথ পাওয়া যায় না। আমাদের এখন দুর্নীতিই নীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর ফৌজদারি অপরাধের বিচার ব্যবস্থায় যেসব ত্রুটি আছে, সেগুলোও দুর্নীতির মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে।

দুদকের তৎপরতা গতি পেয়েছে সাম্প্রতিককালে। প্রধানমন্ত্রী ও তার মন্ত্রীরাও বলছেন, এবার দুর্নীতি যারা করবে তাদের বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা দেখানো হবে। অনেকেই কটাক্ষ করছেন যে, ছোটখাটো দুর্নীতিবাজকে ধরে কী হবে? দুদক তো বড় কাউকে কিছু করতে পারছে না। এটা মেনে নিয়েও বলবো, দুদকের এই তৎপরতা বড় পরিবর্তন না আনলেও সচেতনতা বাড়াবে। তাছাড়া বড় আকারের দুর্নীতির তুলনায় সেবা সংস্থাগুলোর দুর্নীতি আটকানো গেলেও জনগণের মধ্যে স্বস্তি আসবে। তাদের সেবা পেতে গিয়ে হয়রানির শিকার হতে হবে না।

সংস্কারের পথে হাঁটলে দুর্নীতি কমতে বাধ্য। সরকারি কর্মকর্তাদের ডিস্ক্রিশনারি পাওয়ার বা একচেটিয়া কর্তৃত্ব এবং যথেচ্ছ সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার কমাতে পারলে দুর্নীতির সুযোগ কমে আসতো। এতে করে জনগণকে সেবা দেওয়ার ব্যবস্থায় পরিবর্তন আসতো। সমস্যা হলো সরকার এই পথে কখনও হাঁটছে না বা আমলাতান্ত্রিক খপ্পরে পড়ে সে পথে যেতে পারছে না।

দুদক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করবে। কিন্তু একটা বিশ্বাসযোগ্য দুর্নীতি-প্রতিরোধী ব্যবস্থা তৈরি করে দৈনন্দিন দুর্নীতির প্রকোপ কমানোর ব্যবস্থা করতে হবে সরকারকেই। তা করা হবে কিনা, সেটা অবশ্যই রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রশ্ন। টানা তৃতীয় দফায় সরকার গঠনের পর থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভেতর সেই সদিচ্ছা দেখতে পাচ্ছে মানুষ। কিন্তু তিনি একা কিছুই করতে পারবেন না। তার দল ও প্রশাসন কতটা আন্তরিক সেটা বড় প্রশ্ন।

সরকারি টাকা নয়-ছয় করার কথা আমরা জানি। এটি হরহামেশা হয় এবং বড় আকারে হয় প্রকল্প বাস্তবায়নে, নির্মাণে, সরবরাহে। Collusive Bribery বা ‘যোগসাজশভিত্তিক দুর্নীতি’ই এই দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা। এখানে এসে সরকারি কর্তা, ব্যবসায়ী, রাজনীতিক ও নিয়ন্ত্রণকারী কর্তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে যান। আরেকটি বিষয় হলো, ন্যায়বিচারের পথে বাধা সৃষ্টি করা। এটি যে অপরাধ সেই বোধই তৈরি হয়নি যেন সমাজে। নানাভাবে প্রভাব খাটিয়ে, চাতুর্যের সঙ্গে ন্যায়বিচারের পথ বন্ধ করা হয়। এখানে শুধু সরকারি কর্মীরা নয়, কখনও কখনও যুক্ত হয়ে যায় নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যম সংশ্লিষ্টরাও।

আমরা বলছি উন্নয়ের পথে হাঁটছি। যে দেশগুলো উন্নত, তাদের বেশিরভাগই তুলনামূলকভাবে দুর্নীতিমুক্ত। জাতিসংঘের দুর্নীতিবিরোধী কনভেনশন আছে। কয়েক বছর  আগে জাতিসংঘের এক মহাসচিব বলেছিলেন, ‘দুর্নীতি এক গভীর ব্যাধি। সমাজকে তা ভেতর থেকে কুরে কুরে খায়। দুর্নীতি গণতন্ত্র এবং আইনের শাসনকে দুর্বল করে, মানবাধিকার লঙ্ঘন ঘটায়, বাজারকে বিকৃত করে, জীবনের মান নষ্ট করে, নানা রকম অপরাধ, সন্ত্রাস এবং নিরাপত্তার অন্য নানা শত্রুর শক্তিবৃদ্ধি ঘটায়। এই দুরাচার ছোট বা বড়, ধনী এবং দরিদ্র, সব দেশেই দেখা যায়, কিন্তু উন্নতিশীল দেশেই দুর্নীতির প্রভাব সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর। উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ সম্পদ দুর্নীতির কারণে বিপথে চালিত হয়, তার ফলে দরিদ্র মানুষের বিপুল ক্ষতি হয়। সরকারের অত্যাবশ্যক পরিষেবা সরবরাহের সামর্থ্য দুর্নীতির প্রকোপে ব্যাহত হয়, অসাম্য এবং অন্যায় উৎসাহিত হয়, নিরুৎসাহ হয় বিদেশি অনুদান ও বিনিয়োগ।’

এই কথাগুলো যদি আমরা মানি তবে তার জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে। সরকার যখন তার প্রতিজ্ঞার কথা বলছে, তখন আমরা দেখতে চাই দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য কী ধরনের উদ্যোগ করা হয়েছে। অনেক দুর্নীতির ঘটনায় নিশ্চয়ই আইন লঙ্ঘন করা হয়, কিন্তু আইন না ভেঙেও দুর্নীতি সম্ভব। এবং সেটিই বেশি ঘটছে। তাই সরকারি কর্মীদের সরাসরি সংশ্লেষ হয় সেবা, পরিসেবার সঙ্গে, তেমন প্রথা কমাতে হবে। রাজস্ব আদায়ের পদ্ধতি যত ডিজিটাল হবে, ততই রাজস্ব বিভাগের ব্যক্তিদের সঙ্গে রাজস্ব দাতাদের দেখা কম হবে, ঘুষ বন্ধ হবে।

সরকারি কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা করার আগে সরকারি অনুমতি নেওয়ার আইনটি বদলাতেই হবে। তাছাড়া সরকারি কর্মীদের দুর্নীতি প্রমাণিত হলে ক্ষতিপূরণ আদায়ের নিয়ম থাকা উচিত। এসব মামলা দ্রুত বিচারের আওতায় আনা প্রয়োজন।

গত দশ বছরে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় উন্নয়ন এবং একইসঙ্গে উচ্চারিত শব্দ দুর্নীতি। আবার এও সবাই দেখছে যে উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে বৈষম্যও বাড়ছে বেশ। উন্নয়নের সঙ্গে বৈষম্যের একটা ‘স্বাভাবিক’ সম্পর্ক মেনে নেওয়া হলেও উন্নয়ন হলে দুর্নীতি হবেই এমন ধারণা নিশ্চয়ই মানা যায় না। যখন উন্নয়ন এবং দুর্নীতি হাতে হাত ধরে এগোয় তখন উন্নয়ন বিপথে হারিয়ে যায়।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, জিটিভি ও সারাবাংলা

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
চুয়েটের দুই শিক্ষার্থীকে চাপা দেওয়া বাসের চালক গ্রেফতার
চুয়েটের দুই শিক্ষার্থীকে চাপা দেওয়া বাসের চালক গ্রেফতার
টি-টোয়েন্টি র‌্যাঙ্কিংয়ে ফের পাকিস্তানের এক নম্বর বোলার শাহীন
টি-টোয়েন্টি র‌্যাঙ্কিংয়ে ফের পাকিস্তানের এক নম্বর বোলার শাহীন
তাপ কমাতে সড়কে প্রতিদিন ৪ লাখ লিটার পানি ছিটাচ্ছে ডিএনসিসি
তাপ কমাতে সড়কে প্রতিদিন ৪ লাখ লিটার পানি ছিটাচ্ছে ডিএনসিসি
ঢামেকে কারাবন্দি হাজতির মৃত্যু
ঢামেকে কারাবন্দি হাজতির মৃত্যু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ