X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রিয়াংকা ঝুঁকির মুখে ফেলে দিলেন মোদিকে

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী
৩১ জানুয়ারি ২০১৯, ১৫:২৮আপডেট : ৩১ জানুয়ারি ২০১৯, ১৫:৩০

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী আমি প্রতি বৃহস্পতিবারে লিখি। তাই অনেক সময় সপ্তাহের প্রারম্ভে যেসব ঘটনা ঘটে তা নিয়ে লেখা হয় না। অনেক সময় একটু দেরি হয়ে যায়। এবারের ভারতীয় রাজনীতিতে প্রিয়াংকা গান্ধীর যোগদান পরবর্তী রাজনৈতিক হালচাল লিখতে গিয়েও তা-ই হলো। তবু বিলম্ব হলেও এ বিষয়ে বলবো। রাহুল-প্রিয়াংকা নেহরু পরিবারের পঞ্চম প্রজন্মের লোক। অনেকে তার কংগ্রেস রাজনীতিতে যোগদানকে পরিবারতন্ত্রের পুনরাবৃত্তির বলে হেয় করতে চেয়েছেন। কিন্তু বিষয়টা অনুরূপভাবে হেয় করার মতো নয়।
রাম-রাবণ যেমন ভারতীয়দের কাছে অতি পরিচিত বিষয়, তেমনি নেহরু-গান্ধী পরিবারের পাঁচ প্রজন্মের লোকেরাও ভারতীয়দের কাছে পরিচিত মুখ। ভারত স্বাধীন হয়েছে ৭১ বছর হয়, তার মধ্যে ৪০ বছর শাসন ক্ষমতার শীর্ষে ছিলেন এ পরিবারের লোক। তারা সম্পর্কে হচ্ছেন পিতা, পুত্রী, দৌহিত্র। আবার স্বাধীনতা সংগ্রামে এ পরিবারের অবদান ছিল ঐতিহাসিক, যা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে।

মতিলাল নেহরু ও তার স্ত্রী স্বরূপ রানী, জওহর লাল নেহরু ও তার স্ত্রী কমলা নেহরু, তার কন্যা ইন্দিরা গান্ধী- সবাই তো স্বাধীনতা সংগ্রামে অবদান রেখেছেন। কেউ ব্রিটিশের হাতে নির্যাতিত হয়েছেন, বছরের পর বছর কারাগারে ছিলেন। সুতরাং অনুরূপ একটা ঐতিহাসিক পরিবারের লোক রাজনীতিতে যোগদান না করাই অপরাধ। এরা তো সংসার ধর্ম তেমন কিছু করেননি। জীবন ব্যয় করেছেন দেশের সেবায়।

স্বাধীনতার পর দেখা গেলো এলাহাবাদের নেহরুদের ‘আনন্দ ভবন’ পুনরায় সংস্কারের প্রয়োজন হয়েছে। মতিলাল নেহরু তখন পরলোকে, জওহর লাল নেহরু ঘরের কিছু ফার্নিচার বিক্রি করে সে কাজ সমাধা করেছিলেন। বিশ্বের দেশে দেশে রাজনীতিতে মহাত্মা গান্ধীর মতো, নেহরুর মতো, ম্যান্ডেলার মতো ত্যাগী রাজনীতিবিদ কয়জন পাওয়া যায়। দেশের কোনও বিপর্যয়ের পর ক্ষমতাসীনরা পরিত্যক্ত হয়। কিন্তু ১৯৬২ সালের চীন-ভারতের যুদ্ধে ভারত পরাজিত হলেও ভারতীয়রা নেহরু পরিবারকে পরিত্যাগ করেননি।

শ্রেণিবিভক্তির কারণে ভারতীয় রাজনীতি খুবই কঠিন। স্বাধীনতার পর কংগ্রেস গড়ে উঠেছিল শ্রেণি সমবায় হিসেবে। তার ভোট ব্যাংকে ছিল নানা শ্রেণির মানুষ। এতে প্রধান্য ছিল উচ্চ বর্ণের। কিন্তু নীরব সহযাত্রী ছিল সংখ্যালঘু মুসলমান আর হরিজনেরা। কংগ্রেস আসলে জগজীবন রাম ও রফি আহাম্মদ কিদওয়াইয়ের মতো কিছু হরিজন ও মুসলমান নেতাকে ক্ষমতার অংশীদার করে প্রতীকী সহমর্মিতা দেখালেও উন্নয়নের প্রকৃত কাজ বিশেষ কিছু করেনি। করার তাগিদও ছিল না। কারণ, কেন্দ্রে, রাজ্যে রাজ্যে তাদের ক্ষমতা পাওয়া তো স্বাভাবিকভাবে চলছিলো।

১৯৬৭ সালের নির্বাচনে এ নিয়মানুবর্তিতায় চিড় ধরে। কংগ্রেসের পায়ের তলার মাটি সরে যেতে আরম্ভ করে। আশির দশকে এসে দেখা গেলো কংগ্রেসের সমর্থকেরা নিজেরাই জাতপাতভিত্তিক দল গঠন শুরু করেছে। আরম্ভ করেছিলেন চরণ সিং কিন্তু এখন দেখবেন এক একটি পিছিয়ে পড়া জাতি এক এক নেতার খাস তালুক। উত্তর প্রদেশে মোলায়েম সিং যাদব ও মায়াবতী, বিহারে লালু প্রসাদ যাদব, নিতিশ কুমার, রাম বিলাশ পাশওয়ান- এরাই শুরু করলেন জাতপাতকে পুঁজি করে সক্ষমতার সমীকরণ। আবার আঞ্চলিক দলও কিছু গড়ে উঠলো-শক্তিশালী অবস্থান নিয়ে। পশ্চিম বাংলায় তৃণমূল কংগ্রেস, আসামে অসম গণপরিষদ, উড়িষ্যায় বিজু জনতা দল, কর্ণাটকে দেব গৌড়ার জনতা দল সেক্যুলার, মহারাষ্ট্রের শিব সেনা, তামিলনাড়ুতে ডিএমকে, আন্না ডিএমকে, অন্ধ্রে তেলেগু দেশম, তেলেঙ্গানায় তেলেঙ্গানা রাষ্ট্রীয় সমিতি, কাশ্মিরে ন্যাশনাল কনফারেন্স আর মেহেবুবা মুফতির ডেমোক্র্যাটিক পার্টি, হরিয়ানার রাষ্ট্রীয় লোকদল ইত্যাদি। সর্বভারতীয় দল আছে শুধু কংগ্রেস আর বিজেপি।

এখন চলছে জোটের রাজনীতি। কংগ্রেস জোট আর বিজেপি জোট। জোটের রাজনীতি আর জোটের সরকার ভারতের রাজনীতিতে এখন প্রায় অবধারিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে ভারতের ধনবাদী গোষ্ঠী গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর প্রার্থী হিসেবে বেছে নেন এবং জনতা পার্টি গোয়ার চিন্তন বৈঠকে নরেন্দ্র মোদিকে মেনে নেয়। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদির সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার অখ্যাতি যেমন আছে, শিল্পবান্ধব হিসেবে তার কিছু খ্যাতিও ছিল।

আবার বাকবিভুতিতে ভারতীয় জীবিত রাজনীতিবিদদের মাঝে নরেন্দ্র মোদি শীর্ষে। নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে জনতা পার্টির জোট এনডিএ ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়ে সরকার গঠন করেছিলেন। এ বছর তার মেয়াদ উত্তীর্ণ হচ্ছে, মে মাসে আবার নির্বাচন। কিন্তু ভারত গুজরাট নয়। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদি চূড়ান্ত ব্যর্থ। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের অভিযোগ আছে, নগদ অর্থে রাফায়েল বিমান ক্রয় এবং বিরাট অংকের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগও উঠেছে। কোনোভাবেই নরেন্দ্র মোদি ও জনতা পার্টির অবস্থা ভালো বলা যাচ্ছে না। সুন্দরভাবে নির্বাচন পরিচালনা করা গেলে বিরোধী জোট সম্ভবত ক্ষমতায় যেতে পারে।

কিন্তু সর্বভারতীয় জোটে কংগ্রেসকে নিতে পর্যন্ত নারাজ তৃণমূলের মমতা ব্যানার্জি, তিনি নিজেই প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী হতে চান। তিনি তার মনের কথাটা বলেছেন মহারাষ্ট্রের নেতা শরত পাওয়ারকে। শরত পাওয়ার জীবন কাটিয়েছেন মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রিত্ব ও কেন্দ্রের মন্ত্রিত্ব করে। তিনি হচ্ছেন জীবিত রাজনীতিবিদদের মাঝে প্রবীণ এবং সিজন পলিটিশিয়ান। তিনি মমতাকে বলেছেন কংগ্রেসকে ছাড়া জোট হবে কীভাবে, আর্যাবর্তে কংগ্রেস আগামী নির্বাচনে একাই ১০০ সিটে জিতবে। আর আরেক কাণ্ড করে বসেছেন উত্তর প্রদেশের অখিলেশ ও মায়াবতী। সমাজবাদী পার্টি এবং বহুজন সমাজ পার্টির মধ্যে উত্তর প্রদেশের লোকসভার ৮০ আসনের মাঝে উভয়ে ৩৮+৩৮ আসন ভাগাভাগি করে কংগ্রেসের জন্য ২ আসন আর অজিত সিংয়ের রাষ্ট্রীয় লোকদলের জন্য ২ আসন রেখে তারা উভয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠন করেছেন।

অখিলেশ যাদব নাকি কথা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী পদে সমাজবাদী পার্টি মায়াবতীকে সমর্থন দেবেন। এই চুক্তি যখন তারা সম্পাদন করেন, রাহুল তখন দুবাইয়ে। সাংবাদিকদের মুখে এ কথা শোনার পর রাহুল বলেছেন, অখিলেশ ও মায়াবতীর প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধ আছে, তবে এখন আমিও চমক দেখাবো।

রাহুল পরবর্তী পদক্ষেপ নিলেন উত্তর প্রদেশকে উত্তর-দক্ষিণ দ্বিখণ্ডিত করে পূর্ব অংশের কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত করলেন তার বোন প্রিয়াংকা গান্ধীকে আর পশ্চিম অংশের দায়িত্ব দিলেন মধ্য প্রদেশ কংগ্রেস নেতা জ্যোতিরদিত্য সিন্ধিয়াকে। গোলাম নবী আজাদকে দায়িত্ব দিলেন হরিয়ানার। উত্তর প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির সভাপতি রাজ বাব্বর বললেন কংগ্রেস উত্তর প্রদেশে ৫৪ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। অথচ উত্তর প্রদেশে রাহুল, মায়াবতী, অখিলেশ আর অজিত সিংয়ের মাঝে ঐক্যফ্রন্ট হলে বিজেপি উত্তর প্রদেশের ৮০ আসনের মাঝে ৫ আসনের ওপরে জিততে পারবে না।

মমতা, মায়াবতী ও অখিলেশ রাহুলকে এত অবমূল্যায়ন করলেন কেন জানি না, অথচ তাদের নিজ রাজ্যের বাইরে কিছু নেই। রাহুল মাত্র তিন সপ্তাহ আগে মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড় আর রাজস্থানে বিজেপিকে পরাজিত করে রাজ্য সরকার গঠন করেছেন। এ তিন রাজ্যে নির্বাচনি প্রচারণা চালিয়েছেন রাহুল একা, সোনিয়া বা প্রিয়াংকা কেউই ছিল না। রাহুলের নেতৃত্ব এখন প্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে। তার নেতৃত্বকে অবহেলা করার কিছুই নেই। তিন বড় রাজ্যের (মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড় ও রাজস্থান) বিধানসভায় বিজয় ও কংগ্রেস দলের রাজ্য সরকার গঠন কংগ্রেস সভাপতি হিসেবে রাহুলের নেতৃত্বের প্রাসঙ্গিকতা তুঙ্গে তুলে দিয়েছে। অনুরূপ কোনও দৃষ্টান্ত মমতা, মায়াবতী ও অখিলেশের নেই।

আগামী ২রা ফেব্রুয়ারি কুম্ভ মেলায় ত্রিবেণী সঙ্গমে গঙ্গা স্নান করে দুই ভাই বোন রাহুল আর প্রিয়াংকা প্রেস কনফারেন্সের মধ্য দিয়ে নির্বাচনি প্রচারণার কাজ আরম্ভ করবেন। প্রিয়াংকাকে পূর্ব অংশের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। রাহুলের আমিথি, সোনিয়ার রায়বেরেলী, নরেন্দ্র মোদির বানারস আর উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের গোরকপুর আসন প্রিয়াংকার অংশে। এ অংশে বিজেপি শক্তিশালী। সুতরাং প্রিয়াংকাকে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। প্রিয়াংকা দেখতে তার দাদি ইন্দিরার মতো। কথাবার্তায় চলনে বলনে বুদ্ধিতে প্রায় দাদির অনুরূপ। এ জন্য ভারতের মানুষ তাকে ছোট ইন্দিরা বলে ডাকে। সারা উত্তর প্রদেশ তথা ভারত প্রিয়াংকার রাজনীতির অভিষেকে উতলা হয়েছে।

ভারতীয় মিডিয়া বলছে, প্রিয়াংকার যোগদানে নরেন্দ্র মোদির কপালে ভাঁজ পড়েছে। নরেন্দ্র মোদি পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ। তার এ আতঙ্ক অহেতুক নয়। রাহুল বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী পদের কোনও শর্ত দেবে না কংগ্রেস। সবাই মিলে যাকে চায় তিনিই প্রধানমন্ত্রী হবেন। প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য কোনও বিবাদ না করে বিরোধী পক্ষ এক হয়ে বিজেপি জোটকে মোকাবিলা করলে বিরোধী জোটের জয়ের সম্ভাবনাই বেশি।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জাতীয় পতাকার নকশাকার শিব নারায়ণ দাস আর নেই
জাতীয় পতাকার নকশাকার শিব নারায়ণ দাস আর নেই
পথের পাশের বাহারি শরবতে স্বাস্থ্যঝুঁকি কতটা?
পথের পাশের বাহারি শরবতে স্বাস্থ্যঝুঁকি কতটা?
মন্ত্রণালয়ে সভা করে ধানের দাম নির্ধারণ করা হবে: কৃষিমন্ত্রী
মন্ত্রণালয়ে সভা করে ধানের দাম নির্ধারণ করা হবে: কৃষিমন্ত্রী
জোভানের নতজানু বার্তা: আমার ওপর কষ্ট রাখবেন না
জোভানের নতজানু বার্তা: আমার ওপর কষ্ট রাখবেন না
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ