X
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

জিন্দা লাশ নামায়ে যান

আহসান কবির
০১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১৫:৫১আপডেট : ০১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১৫:৫৩

 

আহসান কবির

রাস্তার জ্যাম আপনার জীবনকে যতই দুর্বিসহ করে তুলুক না কেন, পরিবহনের আলাদা কিছু ভাষা ও ছন্দ আছে। জ্যাম বিষয়ক আলাপে যাওয়ার আগে আসুন, সেইসব পরিচিত ছন্দ ও ভাষা শুনে আসি।

ক. বাস এফডিসি’র কাছে এসে থামলো। কন্ডাকটর চিৎকার দিয়ে বললো– এফডিসি কাওরান (কাওরান বাজার) এইবার বাইরান!

খ. আজিমপুরে বাস থেমেছে। কন্ডাকটর ছন্দ তুলে ড্রাইভারকে বললো—ওস্তাদ, আজিমপুর থামায়ে যান/জিন্দালাশ নামায়ে যান!

গ. ফার্মগেটে যাত্রী তোলা হচ্ছে বাসে। কন্ডাকটর চিৎকার দিয়ে বলছে— সায়দাবাজ সায়দাবাজ (সায়দাবাদ) যাইলে দেন আওয়াজ!

আগে কিছু কিছু বাসকে বলা হতো ‘মুড়ির টিন’।  মুড়ির টিন বা অন্যান্য বাসের ভেতরে মজাদার কিছু লেখা থাকতো। যেমন—

ক. থুথু বাহির হাত ভেতর। একশ পাঁচশো টাকার ভাংতি নাই। ব্যবহারে বংশের পরিচয়।

খ. চালকের সিটের পেছনে লেখা থাকতো— চলন্ত অবস্থায় চালকের সঙ্গে কথা বলা নিষেধ। আর তার মাথার ওপরে লেখা থাকতো— আপনার অভিযোগ চালককে বলুন!

এরপর আসেন ‘পরিবহন ক্যারেকটারে’। যারা বাস বা ট্রাক চালান (ড্রাইভার) তাদের পরিবহনীয় নাম ‘ওস্তাদ বা পাইলট’। যারা জাদুকরের মতো চরম ভিড়ের মধ্যেও যাত্রীদের ধাক্কা এবং বকাবাজি খেয়ে ভাড়া তোলেন, যাত্রীদের শাসন করেন বা নামিয়ে দেন, ওস্তাদের জন্য সিগারেট কিনে নিজে এক-দুই টান দিয়ে ওস্তাদকে হ্যান্ডওভার করেন, তাদের পরিবহনীয় নাম ‘কন্টাকটার’! বেশিরভাগ ‘কন্টাকটার’ যাত্রীদের বলেন— ‘বাই বাড়াটা (ভাড়া) দেন।  চালু করেন’ (চালু করেন মানে হচ্ছে তাড়াতাড়ি করেন) এই ‘কন্টাকটার’রা বাসের ক্যানভাসারদের (যারা বাসে বিভিন্ন মলম, তেল, চেন, অষ্টধাতুর আংটি ,চকলেট, চিরুনি  বা বই বেচে থাকেন) কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে থাকেন।  এরা উদ্বুদ্ধ করেন ওস্তাদদের আরেক বাসের সঙ্গে পাল্লা দিতে।  এরাই ‘কন্টাকটার’ থেকে একসময় ‘ওস্তাদ’ অর্থাৎ চালকে পরিণত হন।

এরা রাস্তার ‘সিগনাল’কে বলেন ‘সিঙ্গেল’।  ওস্তাদ বা চালককে ‘বরাবর’ বা ‘সোজাসুজি চালাতে’ বলে থাকেন ‘বরাবইল বরাবইল’! ছোট গাড়ি বা প্রাইভেট কারকে বলে থাকেন ‘প্লাস্টিক’, কখনও-সখনও মাইক্রোবাসকে বলে থাকেন ‘পলিথিন’।  এছাড়া, যাত্রীদের আকর্ষণ করতে বাসের গায়ে কিছু পরিবহনীয় ভাষা লেখা থাকে।  যেমন—লোকাল, গেটলক, সিটিং গেটলক ইত্যাদি। যতকিছুই লেখা হোক না কেন পরিণতি একই। অসহনীয় জ্যাম, সাধারণ লাখো মানুষের চিরস্থায়ী ভোগান্তি। রাস্তার শৃঙ্খলা ফেরেনি গত ১০ বছরে।  বেড়েছে রাস্তায় মানুষের মৃত্যু, চালক, চালকের সহকারী, মালিক আর পরিবহন শ্রমিকদের মিলিত মাস্তানি।  কৌতুক করে বলা হয়ে থাকে— সাধারণ খাবার হোটেলে ৫০ বছরের আগের ডালও নাকি পাওয়া যায়।  প্রতিদিন যে ডাল বেঁচে যায়, পরদিন নাকি সেই ডাল মেশানো হয় নতুন রান্না করা ডালের সঙ্গে। এই প্রক্রিয়া নাকি কখনও বন্ধ হয় না।  ঠিক তেমনি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়কার বাস বা ট্রাক নাকি আজও  কোনও না কোনও ফর্মে টিকে আছে।  যখনই কোনও বাস বা ট্রাক নষ্ট হয় তখনই এসবের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ খুলে লাগানো হয় অন্য কোনও বাস বা ট্রাকে! এই প্রক্রিয়া যেমন অব্যাহত থাকে, তেমনই পাউরুটিতে জ্যাম বা জেলি নাই থাকুক, আপনার ঘরে খাবার থাকুক কিংবা নাই থাকুক, জ্যাম আর সড়কের বিশৃঙ্খলাজনিত ভোগান্তি কখনও কমবে না হয়তো!

২০১১ সালের জুলাইতে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ এক জরিপ প্রকাশ করে। যানজটের কারণে আর্থিক ক্ষতি দেখানো হয় বছরে ২০ হাজার কোটি টাকা। পরের বছর অর্থাৎ ২০১২ সালে ইউএনডিপি সূত্রে জানা যায়, যানজটের কারণে বছরে ঢাকায় ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়, ৩১ হাজার কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ বিনিয়োগ বোর্ড সূত্রে জানা যায়, যানজটের কারণে বছরে আর্থিক ক্ষতি হয় একলাখ কোটি টাকা, যা মোট প্রবৃদ্ধির সাত শতাংশের সমান।

‘ইনরিক্স’ নামে বিখ্যাত একটা প্রতিষ্ঠান আছে।  এরা পৃথিবীব্যাপী বিখ্যাত বিখ্যাত শহরের যানজট নিয়ে কাজ করে। মজার ব্যাপার হচ্ছে ইনরিস্ক ঢাকা নিয়ে কোনও কাজ বা জরিপ করেনি। হয়তো এরা ঢাকাকে শহরই মনে করে না। ইনরিস্ক-এর জরিপ অনুসারে বিশ্বের যানজটময় শহরগুলো হচ্ছে— আমেরিকার লস এঞ্জেলেস, রাশিয়ার মস্কো, আমেরিকার নিউইয়র্ক, সানফ্রান্সিকো, কলম্বিয়ার বোগোটা, ব্রাজিলের সাও পাওলো।  এই তালিকায় আছে ফ্রান্সের প্যারিসের নামও। ঢাকা নিয়ে ইনরিস্ক আর কখনও কাজ না করুক।  তবে বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য দুটি জরিপ অনুসারে ঢাকা শহরে সকাল আটটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত জ্যামের কারণে গাড়ির গতিবেগ থাকে গড়ে সাত কিলোমিটার।  ২০২৫ সাল নাগাদ ঢাকা শহরের যে জনসংখ্যা হবে এবং যত যানবাহন বাড়বে, তাতে জ্যামজনিত কারণে গাড়ির গতিবেগ দাঁড়াবে চার কিলোমিটার।  একজন সুস্থ সবল মানুষ ঘণ্টায় পাঁচ কিলোমিটার হাঁটতে পারে।  তার মানে দাঁড়াচ্ছে ২০২৫ সাল নাগাদ ঢাকা আদিম যুগে ঢুকে যাবে।  মানুষ তখন গাড়ি ঘোড়া রাস্তায় রেখে পথ হেঁটে বাড়ি বা অফিসে যাবে।

তবে বাংলাদেশ সম্ভবত যানজটে কখনও বিশ্ব রেকর্ড করতে পারবে না। ২০১০ সালের আগস্ট মাসের একদিন (১৪ আগস্ট) চীন যেন থমকে দাঁড়িয়েছিল। যানজটে আটকা পড়েছিল ৮৫ লাখ গাড়ি।  প্রাথমিকভাবে এই যানজট দূর করতে লেগেছিল ১০ দিন। কয়েকশ’ ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে এই জ্যামে।  হার্ট অ্যাটাকে মারা যান অনেকে। আর এই জ্যামের ভেতর জন্ম নিয়েছিল ৩০ শিশু।

ইন্দোনেশিয়ার ব্রেবেস শহরেও ২০১৬ সালে একবার যানজটের কারণে তিন দিন কয়েক লাখ গাড়ি আটকে ছিল রাস্তায়।  জ্যামের ভেতর হার্ট অ্যাটাকে মারা গিয়েছিল ১২ জন। এমন জ্যামের রেকর্ড আছে ব্রাজিলেরও। বাংলাদেশের জ্যাম মনে হয় এত নির্মম না। ফেরি পার হতে গিয়ে বাংলাদেশে এমন জ্যাম পড়লেও এক-দুই দিনের ভোগান্তির খবর পত্রিকার পাতায় বা টেলিভিশনে খবর হয়ে আসে। মানুষ সম্ভবত এই ভোগান্তি নিয়তি হিসেবেই মেনে নিয়েছে!

জ্যাম কমানোর জন্য সারা পৃথিবীতেই নিত্য নতুন আইন করা হয়।  কিছু কিছু আইন বেশ মজার। যেমন—

এক. বাংলাদেশে ময়লার গাড়ি যখন তখন রাস্তায় দেখা যায়।  আর রাশিয়ায় নিজের গাড়ি, ট্রাক বা বাস পরিষ্কার না করে যদি কেউ রাস্তায় নামায়, তাহলে তার জরিমানা গুনতে হয়।

দুই. লাইসেন্স না থাকলে বাংলাদেশে গাড়িতে মদ রাখতে পারবেন না, খেতে তো পারবেনই না।  চলন্ত গাড়িতে যদি কেউ মদ খেতে চান, তাহলে কোস্টারিকা যেতে পারেন। গাড়িতে মদ খেতে পারবেন তবে মাতাল হয়ে গেলেই সমস্যা।  জরিমানা গুনবেন, জেলেও যেতে হতে পারে।

তিন. সুইডেনে গাড়ির হেডলাইট দিন-রাত জ্বালিয়ে রাখতে হয়।  অ্যালবামায় পথ না জেনে বা চিনে রাস্তায় নামলেই পুলিশ ধরবে।  আর পথের মধ্যে যদি গাড়ির তেল ফুরিয়ে যায়, তাহলে জার্মানির রাস্তায় আপনাকে বিপদে পড়তে হবে।

চার. থাইল্যান্ডে গাড়ি চালানোর সময়ে আপনাকে পোশাক পরে থাকতে হবে।  খালি গায়ে গাড়ি চালাতে গেলেই বিপদ।  তবে রেওয়াজ অনুসারে সানফ্রান্সিকোর মানুষেরা তাদের গাড়ি পরিষ্কার করে পুরুষের পরিত্যক্ত আন্ডারওয়ার দিয়ে। যে কেউ চাইলে এদেশে এই রেওয়াজ চালু করতেই পারেন।

জ্যাম যদি নিয়তিই হয়, তাহলে কী করবেন জ্যামে পড়লে? হাউমাউ করে কাঁদবেন? হো হো করে হাসবেন? অবশ্য অনেক আইডিয়া আছে সময় কাজে লাগানোর। যেমন—

এক. ধৈর্য্য শক্তি বাড়ানোর এরচেয়ে বড় পরীক্ষা নেই।  বাস ট্রেন টেম্পুর পেছন ছুটে শরীর ভালো রাখুন, ধৈর্য্য শক্তি বাড়ান।  অবশ্য ঢাকার রাস্তা ও পরিবেশের যে অবস্থা তাতে ধৈর্য্য বাড়লেও হায়াত বাড়ে না!

দুই. বাসে এসি থাকলে ঘুমুতে পারেন। সময় ভালো কাটবে। আর অজ্ঞান পার্টির কবলে পড়লে ঘুমের ডোজ বাড়বে অর্থাৎ কয়েকদিন অজ্ঞানই থাকবেন!

তিন. হাল আমলের ফ্যাশানটাকে ধরতে পারেন। দুই কানে হেডফোন দিয়ে শুনতে পারেন বাংলা হিন্দি বা ইংরেজি গান! এসি বাসে থাকলে বইও পড়তে পারেন। মোবাইলে থাকা বিশেষ ভিডিও দেখতে পারেন।

চার. ধাক্কাধাক্কি করে কোনোক্রমে সাধারণ বাসে উঠতে পারলে বৃক্ষের মতো দাঁড়িয়ে থাকার পরীক্ষা দিতে পারেন। ঢাকা শহরের রাস্তা খোড়াখুড়ি, যানজট, ধুলাবালি, বাতাসে সীসা এই সব নিয়ে ভাবতে বা গবেষণা করতে পারেন।  কিছু না পারলে এই সবের শিকার হয়ে শেষমেষ রোগ বাধিয়ে বসে থাকতে পারেন!

পাঁচ. বাসে ক্যানভাসারদের লেকচার শুনতে পারেন।  মোবাইলে জমে থাকা বার্তা ও মেইল পড়ে উত্তর পাঠাতে পারেন। অসহ্য লাগলে প্রিয় মানুষকে ফোনকল দিতে পারেন। আশেপাশের যাত্রীর সঙ্গে রাজনৈতিক টকশো করতে পারেন। এক্ষেত্রে বিরোধী দলের পক্ষে কথা বললে গনপিটুনি খাবার সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে।

যাই হোক জ্যামে জমে থাকা সময়টা উপভোগ করুন বা কাজে লাগান। সঙ্গে রেজার বা ব্লেড রাখুন। জ্যামের কারণে দাঁড়ি মোচ গজিয়ে গেলে অফিসে গিয়ে শেভ করে নিতে পারেন। শেষমেষ ক্রিকেটের ধারাভাষ্যকার হার্সা ভোগলের কথা বলে শেষ করি। ভদ্রলোক প্রায়ই ক্রিকেটের ধারাভাষ্যের কাজে ঢাকা আসেন। একবার টুইটে তিনি লিখলেন— গত ২০ দিন কাটিয়েছি সিডনি, মুম্বাই, বেঙ্গালুরু, যোধপুর, পুনে, বিশাখাপত্তম, গোয়া ও হায়দারাবাদ। এবার ঢাকায়।  এবার এক জায়গায় বেশ কিছুদিন থাকা যাবে। এর উত্তরে ভারত দলের অফস্পিনার অশ্বিন লেখেন— ২০ দিন আপনি যেসব জায়গায় ছিলেন তারচেয়ে বেশি থাকবেন ঢাকার একটা সিগনালে। উত্তরে ভোগলে লেখে— সিকিউরিটির আওতায় টিম বাসে করে তাড়াতাড়িই যাওয়া যায়। একবার টিম বাস থেকে নেমে আমাদের মতো সাধারণ বাসে চড়ে দেখো। আশা করি, এরচেয়ে বেশি সময় তোমার লাগবে।

লেখক: রম্যলেখক

 

 

/এপিএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বাংলাদেশের সাবেক কোচকে নিয়োগ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র
বাংলাদেশের সাবেক কোচকে নিয়োগ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র
বিএনপির চিন্তাধারা ছিল অন্যের কাছে হাত পেতে চলবো: প্রধানমন্ত্রী
বিএনপির চিন্তাধারা ছিল অন্যের কাছে হাত পেতে চলবো: প্রধানমন্ত্রী
রেকর্ড স্টোর ডে: এবারও বিশেষ আয়োজন
রেকর্ড স্টোর ডে: এবারও বিশেষ আয়োজন
পরীমনির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন
পরীমনির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ