X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

ভুল বললেও দুদক একটু শুনবেন

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১৩:৫৮আপডেট : ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ২০:১০

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা “When the judgement's weak, the prejudice is strong”.
সালেকের জায়গায় জাহালমের ১ হাজার ৯২ দিন জেল খাটা সত্যিকার অর্থেই ভুল বিচার ছিল না। ইচ্ছাকৃতভাবেই দুর্নীতিবাজদের এক বিরাট চক্র কাজটি করেছে বলেই এখন সবাই বুঝছে। দুদক কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের ভুল করার সক্ষমতা বা ক্ষমতা আমাদের জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, জাহালমের জেলবাস তা আরেকবার বুঝিয়ে দিলো।
দুদকের তদন্তে গাফিলতি বা সক্ষমতা বুঝবার আগে একটু মামলাটায় আলোকপাত করা যাক। টাঙ্গাইলের জাহালম একজন দরিদ্র পাটকল শ্রমিক। তিনি কোনও দিন ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নেননি। তার যে আর্থিক ও সামাজিক অবস্থা তাতে হয়তো ব্যাংকের দরজায় পা দেওয়ার সামর্থ্যও নেই। তারপরও দুদক তাকে ভয়ঙ্কর ঋণখেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করে ৩৩টি মামলা দিয়েছে। আর সেই মামলায় তাকে তিন বছর বিনা বিচারে জেলে আটকও  থাকতে হয়েছে। সোনালী ব্যাংক থেকে সাড়ে ১৮ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিলেন আবু সালেক নামের এক লোক। কিন্তু দুদক সালেকের স্থলে জাহালমকে জেলে ঢুকিয়ে বলেছে, তুমিই অপরাধী।

সালেক যখন ব্যাংক থেকে ঋণ নেয় তখন তাকে তার ছবি, তার টিআইএন নম্বর, জাতীয় পরিচয়পত্র এবং সব ঠিকানা দিতে হয়েছিল। এসবই ব্যাংকের কাছে আছে। মামলা যখন হয় তখন ব্যাংক কর্মকর্তাদের কাছ থেকে এসব দলিল নিশ্চয়ই দুদক কর্মকর্তারা বুঝে নিয়েছেন। একইভাবে আইনজীবীরাও নিশ্চয়ই সব কাগজপত্র যাচাই করে আইনি লড়াই করেছেন। তাহলে ভুল হলো কী করে?

ভুল আসলে হয়নি। সবই হয়েছে পরিকল্পনা মতো। দুদক কর্মকর্তাদের ‘৩৩টি’ মামলার মধ্যে ‘২৬টিতে’ জাহালমকে মূল আসামি আবু সালেক হিসিবে চিহ্নিত করে অভিযোগপত্র দেওয়াটা কোনোভাবেই ভুল হতে পারে না। ভুল হতে পারে দুই একটিতে। বুঝতে পারা যায় এটি পরিকল্পিত, একটি চক্র জেনে বুঝে অর্থের বিনিময়ে নিরীহ জাহালমকে জেলে পাঠিয়েছে শক্তিধর সালেককে বাঁচাতে। মানুষ আরেকার বুঝলো দুদক বড় বড় দুর্নীতিবাজকে ধরতে পারে না, কিন্তু জাহালমের মতো নিরীহ মানুষকে জেল খাটাতে পারে।  

একটি পত্রিকায় খবর আসার পর আদালতের নির্দেশে জাহালম মুক্তি পেয়েছেন। কিন্তু পাওয়ার কথা আরও  আগেই। গত বছর ২৪ মে মানবাধিকার কমিশন জাহালম যে সালেক নন, সেটি জানিয়ে দুদককে চিঠি লেখে। এরপরও দুদক আট মাস ধরে বসেছিল, উদ্যোগ বা উদ্যম কোনোটিই নেয়নি।

আমাদের কাছে বিষয়টি আজ  স্পষ্ট যে, মামলার তদন্ত ও নিষ্পত্তিতে দুদকের সততা ও সক্ষমতা আজ  বড় প্রশ্নের মুখে। আমরা জানলাম, যারা এই অন্যায় কাজটি করেছেন, তাদের পদোন্নতি হয়েছে। দুদক চেয়ারম্যান ঘটনাটি জানতে তদন্ত করে দেখার জন্য কমিটি গঠন করেছেন, বলেছেন, ‘যদি’ কেউ দায়ী থাকে তাকে শাস্তি পেতে হবে। এত বড় একটা ঘটনায় এখনও যদি বলার সুযোগ আছে তাহলে!

মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল সম্প্রতি বলেছেন, দেশের জেলখানাগুলোতে দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ বিনা বিচারে আটক রয়েছে। এই সংখ্যা দুই-তৃতীয়াংশ কিনা সে নিয়ে বিতর্ক করার লোক প্রচুর। কিন্তু আমাদের মানতেই হবে যে বিপুল সংখ্যক মানুষের জীবন থেকে তাদের মূল্যবান সময় কেড়ে নিচ্ছে ভুল বিচার আর ভুল তদন্ত।

দুদক সম্পর্কে একটা উচ্চাশা কাজ করে। এই কমিশনে যারা আসেন তাদের সততা ও সক্ষমতা প্রশ্নাতীত থাকবে, এটাই আমাদের ধারণা। কিন্তু বাস্তব বড় কঠিন। হয়তো আমার কথা ভুল, তবুও বলবো, আশা করি দুদক শুনবে যে সংস্থাটির প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার ঘাটতি আছে। বিশেষ করে তদন্তে গাফিলতি আছে, কাঙ্ক্ষিত মানের চেয়ে বেশ পিছিয়ে আছে। আর জাহালমের ঘটনায় বোঝা গেল কোনো কোনো স্তরে সততার ঘাটতিও রয়েছে।

জাহালমের জীবনের তিন বছর তাকে ফিরিয়ে দেওয়া যাবে না। এই সময় তার পরিবার যে কষ্টের ভেতর দিয়ে গেছে তারও কোনো ক্ষতিপূরণ হবে না। জাহালমকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে এবং দিতেই হবে। সেই ব্যবস্থা করতে হবে দুদককেই। কিন্তু দুদকের আচরণে কি সেই সক্রিয়তা দেখতে পাচ্ছি? সেই কর্মকর্তাদের এখনও সাময়িক বরখাস্ত করা হয়নি। ব্যাংক ও দুদক কর্মকর্তা যারা যোগশাজসে এই কাজটি করেছে তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে জাহালমকে দেওয়ার উদ্যোগ দেখতে চায় মানুষ।

কিন্তু এ কথাও ঠিক, এই সবকিছু করা হলেও জাহালম-সালেক কুনাট্যের শেষ অঙ্কের যবনিকা পতন হয়েছে বললে ভুল হবে। দুর্নীতির শিকড় এত গভীরে প্রোথিত যে এত সহজে তাকে উচ্ছেদ করা কঠিন। যে তদন্ত কমিটি করবেন বলে দুদক চেয়ারম্যান বলেছেন, তার ভবিষ্যৎ কী, তাও এখন পর্যন্ত অনিশ্চিত।

দুদক স্বাধীন প্রতিষ্ঠান, অতএব, তার জনসমক্ষে জবাবদিহি করার দায় নেই, এমন কথা হয়তো অনেকেই বলবেন। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি সরকারি। জনগণের করের টাকায় এটি পরিচালিত হয়। তাই জনগণের জানার অধিকার আছে দুদকের ভেতরে থাকা জাহালম সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কবে কতটুকু শাস্তি পাচ্ছে। দুর্নীতির সঙ্গে বিপুল বাণিজ্য জড়িত। কিন্তু মানুষ চায় এমন এক কঠিন কাজে থেকেও দুদক জনস্বার্থ রক্ষার পথেই হাঁটবে, তার স্বচ্ছতা আর সততা নিয়ে কোনো প্রশ্ন উঠবে না।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, জিটিভি ও সারাবাংলা

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিতে ‘বড় পরিবর্তন’ দেখছে না যুক্তরাষ্ট্র
বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিতে ‘বড় পরিবর্তন’ দেখছে না যুক্তরাষ্ট্র
পদে থেকেই ইউপি চেয়ারম্যানরা উপজেলা নির্বাচন করতে পারবেন
পদে থেকেই ইউপি চেয়ারম্যানরা উপজেলা নির্বাচন করতে পারবেন
জীবনানন্দ পুরস্কার পেলেন জাহিদ হায়দার ও মোস্তফা তারিকুল আহসান
জীবনানন্দ পুরস্কার পেলেন জাহিদ হায়দার ও মোস্তফা তারিকুল আহসান
শাকিবের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কের জায়গা অন্যরকম: চঞ্চল
শাকিবের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কের জায়গা অন্যরকম: চঞ্চল
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ