X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

‘জন্তু-জানোয়ার হলে বই পড়ার দরকার নেই…’

চিররঞ্জন সরকার
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১৫:০০আপডেট : ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১৫:০০





চিররঞ্জন সরকার বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। গতানুগতিক তেরো পার্বণের পর রয়েছে ফুটবল-ক্রিকেট, রাজনীতি। পহেলা ফাল্গুন, ভ্যালেন্টাইন্স ডে, বন্ধু দিবস, মা দিবস, বাবা দিবসসহ আরও নানা দিবসের রমরমা। দিবস আর উৎসবের যেন শেষ নেই। এরমধ্যে সবচেয়ে সৃজনশীল উৎসব বইমেলা। অনেক বইপ্রেমী ব্যক্তির দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টায় বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ১৯৮৪ সাল থেকে ফেব্রুয়ারি মাসে সাড়ম্বরে বইমেলার আয়োজন হয়ে আসছে। প্রতি বছর বইমেলা বিশাল থেকে বিশালতর আকার ধারণ করছে। স্থান সংকুলানের জন্য বাংলা একাডেমির মূল ফটক থেকে বইমেলা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আসন নিয়েছে। মেলা উপলক্ষে বিপুলসংখ্যক বই প্রকাশিতও হচ্ছে। পহেলা ফেব্রুয়ারিতে যে পার্বণ শুরু হয়, চলে পুরো মাসজুড়ে। পৃথিবীতে আর কোনও বইমেলাই এতদিন ধরে চলে না।

মানুষের জীবনের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বস্তু বই হলেও বই পড়ার অভ্যাস কমছে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে। টেলিভিশন, সোশ্যাল মিডিয়া, ইউটিউব, কমিক স্ট্রিপ ও অ্যানিমেশন বই পড়ার চেয়ে অনেক বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। ইন্টারনেট, অ্যান্ড্রয়েডের যুগে বইয়ের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে নতুন প্রজন্ম- যেকোনও আলোচনাতেই কান পাতলে শোনা যায় এ কথা। তারপরও বইমেলায় প্রতিদিন অসংখ্য কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীরা উপস্থিত হয়। এ দোকান থেকে ও দোকানে ঘোরে। তাদের হাতে যেন বই থাকে এবং তারা যেন বই পড়ে- সেই তাগিদটা তৈরি করাই এ মুহূর্তে আমাদের সামাজিক দায়িত্ব হওয়া উচিত। সমাজে এখন অসংখ্য লেখক, অনেক প্রকাশকও। কিন্তু প্রশ্ন রয়েছে এসব বইয়ের বা লেখার মান নিয়ে। একটা নির্দিষ্ট মানে যদি লেখা না পৌঁছায়, তাহলে তা কি ছাপা হওয়া উচিত? কিন্তু এই প্রশ্নের স্পষ্ট কোনও জবাব নেই। বেশিরভাগ প্রকাশনা সংস্থার কোনও নির্দিষ্ট সম্পাদক নেই। লেখক কী লিখলেন, তথ্য ও যুক্তি কতদূর ঠিক থাকলো সেটি দেখে দেওয়ার কেউ নেই। তারই ভূরি পরিমাণ ফসল ছড়িয়ে থাকে বাংলা বইয়ের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায়। আর অধিকাংশ সেসব নিয়েই বছরে এই মেলায় আসে প্রায় তিন থেকে চার হাজার নতুন বই। ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় ৪০০ প্রকাশক আছেন। পরিমাণটা উচ্ছ্বসিত হওয়ার মতো হলেও মানের দিক থেকে বেশিরভাগ বই-ই হতাশাব্যঞ্জক। এর কারণ হিসেবে প্রকাশকরা বলেন বাজারের কথা। তাদের মতে, বাংলা বইয়ের বাজার অত্যন্ত সীমিত। খুব কম লেখকের বই দুইশোর বেশি চলে। ফলে প্রোডাকশন তুলনায় খারাপ হবেই।
‘প্রোডাকশন’ মানে কী? প্রচ্ছদ, বাঁধাই, কাগজ, ছাপা সাধারণভাবে ‘প্রোডাকশন’ বলতে এটাই বোঝেন বেশিরভাগ বাঙালি প্রকাশক। কিন্তু পাণ্ডুলিপি থেকে বই হয়ে ওঠার পুরো প্রক্রিয়াটিকেই ‘প্রোডাকশন’ বলা উচিত। সে প্রক্রিয়ায় প্রথম কাজ হওয়া উচিত পাণ্ডুলিপি ছাপতে দেওয়ার জন্য ‘তৈরি’ করা এবং বারবার প্রুফ দেখে বইয়ের টেক্সট বা মূল পাঠ্যকে বিশ্বাসযোগ্য ও নির্ভরযোগ্য করা আর সে কাজে যে কী বিপুল পরিমাণ অবহেলা দু-একটি চাল টিপে দেখলেই তা স্পষ্ট হয়। রবীন্দ্রনাথ থেকে জীবনানন্দ, শওকত ওসমান থেকে হুমায়ূন আহমেদ বাংলা সাহিত্যে এমন কেউ নেই, যাঁর লেখায় প্রকাশকের ‘কল্যাণে’ কমবেশি পাঠবিকৃতি না ঢুকেছে।
বাংলা বই নামক ‘প্রোডাক্ট’টির গুণমানের হাল মোটের ওপর এই। আর, অনেক প্রকাশকের মতে, বাণিজ্যের সঙ্গেই নাকি জড়িয়ে আছে বইয়ের গুণমান। বাংলা বইয়ের ব্যবসাটা যেহেতু সামগ্রিকভাবে মার খাচ্ছে নানা কারণে, তাই অর্থাভাবে গুণমানের ক্ষেত্রেও বাংলা বই অনেক পিছিয়ে। হাতেগোনা দু-একজন প্রকাশক ছাড়া বাংলা বইপাড়ায় গ্রন্থ-সম্পাদক বলে কেউ নেই। তারও কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রকাশকদের বক্তব্য, ‘অর্থাভাব’।
এর পাশাপাশি আছে বাংলা বইয়ের অলংকরণ। অলংকরণও এখন যেনতেনভাবে করানো হয়। ভালো শিল্পীদের পারিশ্রমিক বেশি। তাইতো নামকাওয়াস্তে মানে-মতলব ছাড়া কিছু একটা অলংকরণ দাঁড় করানো হচ্ছে। বিষয়বস্তুর সঙ্গে যার মিল খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। প্রচ্ছদেরও একই হাল। পণ্যটি সুনির্মিত কিনা সেই প্রশ্ন তার বিপণনের সময় ওঠে। আর এই সুনির্মাণে অলংকরণ থেকে সম্পাদনা বই তৈরির সব দিকই জড়িত। সেখানে খামতি থেকেই যায় বইপাড়ায়।
সে কারণেই কি বইপাড়ার অধিকাংশ প্রকাশক তাকিয়ে থাকেন বইমেলার দিকে? বইমেলা তো অবশ্যই বাংলা বইয়ের ব্যবসার জন্য দরকার। বইমেলায় বই বিক্রি হওয়ার আশা যতটা না থাকে তার চেয়েও বেশি থাকে অনেক পাঠককে বই দেখানোর আশা। বেশিরভাগ প্রকাশকের সেভাবে কোনও শোরুম নেই, ইন্টারনেটের মাধ্যমে বই বিক্রিটাও আয়ত্ত হয়নি অনেকের, ফলে বইয়ের বিপণনে এখনও বইমেলাই ভরসা।
বইয়ের পাঠক নেই বলে ভালো বই বের হয় না, ভালো বই নেই বলে পাঠকরা পড়ে না, দুর্বল বিপণনের জন্য বাণিজ্য হয় না, বাণিজ্যে মন্দা বলেই বই-পণ্যের মান নিচু, আবার নিচুমানের পণ্য বলেই বাণিজ্যও দুর্বল, ডিম-মুরগি ধাঁচের এই ধাঁধাবৃত্তের প্যাঁচেই আপাতত ফেঁসে আছে বাংলা বই।
তবুও মেলা হয়, নতুন বাংলা বই, কেশর ফোলানো আরবি ঘোড়ার মতো সদ্যপ্রকাশ লিটল ম্যাগাজিনের নতুন সংখ্যার দিকে হাত বাড়ায় বাঙালি পাঠক। বইমেলায় নতুন বইয়ের পাশাপাশি পুরনো দুষ্প্রাপ্য বইয়ের পুনর্মুদ্রণও চোখে পড়ার মতো।
বইমেলায় এমন বহু মানুষ আসেন, যারা কিছু কিনতে আসেন না, আসেন বইমেলায় ফুর্তির মৌতাত নিয়ে ঘুরে বেড়াতে। অনেকে আসেন প্রিয়জনের সঙ্গে বেড়াতে। ফি বছর বইমেলায় দর্শনার্থী বাড়লেও তুলনায় বই বিক্রি বাড়ছে না। একুশের বইমেলায় বই বিক্রির অঙ্ক অবশ্য কখনোই মেলে না। কত লোকের পায়ের ধুলো পড়ল, সেই ‘ফুটফল’-এর হিসেবে দুনিয়ার বৃহত্তম বইমেলা, অবশ্যই। কিন্তু পদধূলি দেওয়া সেই দর্শকের অধিকাংশ বই কেনার থেকে চটপটি আর তেলেভাজা খেতে বেশি আগ্রহী, এটি সর্বজনবিদিত সত্য।
কথা হলো বইমেলাকে আরও আকর্ষণীয় করতে হবে, বইপড়ায় নতুন প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। কিন্তু কীভাবে? অনেকে বলেন, এ ক্ষেত্রেও ট্রাডিশনাল মার্কেটিং অ্যাপ্রোচ ব্যবহার করা যেতে পারে। বিভিন্ন শপিংমলে দেখা যায়, দুটো জামা কিনলে তৃতীয়টা ফ্রি। ফ্ল্যাট বুক করলে ভাগ্যবানেরা অনেক সময় লটারিতে গাড়ির মালিক হন বলেও বিজ্ঞাপনে দেখা যায়। বইমেলায় ৫০০ টাকার বই কিনলে একটি লক্ষ টাকার পুরস্কার কী ঘোষণা করা যায় না? ব্যবসা বাড়াতে এ ধরনের লটারির আয়োজন করা যেতেই পারে। রোজই ৫০০ ও তার চেয়ে বেশি টাকার ক্রেতাদের নিয়ে লটারি। আর শেষ দিনে সেই বিজয়ীদের নিয়ে মোটরগাড়ি জেতার মেগা-লটারি, মহা ধামাকা! বইমেলাকে এ ধরনের বিজনেস মডেলে নিতে পারলে ক্ষতি কী?
বইয়ের ক্ষেত্রেও টাইমিং একটি ফ্যাক্টর। মানুষ কিন্তু এখনও খুব বেশি ঘটমান দুনিয়ার বাসিন্দা। তাই এ হলো ব্রেকিং নিউজের যুগ। ফলে সংবাদপত্রে বা সংবাদমাধ্যমের যে ঘটনা এখন দেশে-বিদেশে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, মানুষ বই পড়ার সময় সেই ‘টপিক্যালিটি’-কে বিশেষভাবে মাথায় রেখে চলেছে। চলমান আলোচিত ঘটনাগুলো নিয়ে বই প্রকাশিত হোক। খবরের মতো বইকেও এখন ভাবতে হবে টাইমিং নিয়ে। সবাই তো হুমায়ূন আহমেদের মতো দশকের পর দশক ধরে ফেভারিট হয় না!
আরেকটি কথা, সেটা হলো বইয়ের দাম। ইংরেজিতে জনপ্রিয় বইয়ের মাস-প্রোডাকশনে বিভিন্ন প্রকরণ (ফরমেট) আছে। প্রথমে হার্ড কভার, পরে পেপারব্যাক ইত্যাদি। কিন্তু বাংলায় সেই ফরমেট, বহুলসংখ্যক মাস-প্রোডাকশন নেই। অল্প দামের বই বলে এখন আর তেমন কিছু পাওয়া যায় না। অথচ এখনও কিছু পাঠক তো আছেই, যারা একটু সস্তায় বই খোঁজে।
বই পড়ার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সারাদেশে আবার প্রচার চালাতে হবে। শিক্ষক-অভিভাবকদের এ ব্যাপারে উদ্যোগী হতে হবে। গণমাধ্যমকে দিনে অন্তত দশবার বিষয়টি মনে করিয়ে দিতে হবে। এমনিতেই মানুষ হলো আমোদপ্রিয়। বই পড়ে মাথা ঘামিয়ে কেউ ‘সময় নষ্ট’ করতে চায় না। আর তার দরকারইবা কী? কত হাতছানি আছে! টিভিতে সিরিয়াল, খেলা, গান। হাতে স্মার্টফোনে সমস্ত দুনিয়ার ফান। গরমাগরম সিনেমা তো আছেই। সবই যদি বাদ দিই তো শপিংমল আছে। আছে ফুডকোর্ট। শুধু শুধু গোমড়া মুখ করে বই পড়া আর দীর্ঘশ্বাস ফেলার কোনও মানে হয়?
তবুও বই টিকে আছে। বই পড়লে চেতনার প্রসার হয়, কল্পনাশক্তি জোরদার হয়, বিশ্লেষণী ক্ষমতা বাড়ে, চেনা জীবনের বাইরের জীবনের সন্ধান পাওয়া যায়। তাই তো বইকে, বইমেলাকে টিকিয়ে রাখার জন্য ইতিবাচক উদ্যোগ প্রয়োজন।
বই নিয়ে, বইমেলা নিয়ে, বইপড়া নিয়ে আমাদের অনেক বেশি ভাবনাচিন্তা করা দরকার। যত সমস্যাই থাকুক, বই কিনতে হবে, বই পড়তে হবে। বই কেনা আর বই পড়ার ব্যাপারে আমাদের জাতীয় অঙ্গীকার প্রয়োজন।
পুনশ্চ: বিখ্যাত শিশুসাহিত্যিক সরদার জয়েনউদদীনের উদ্যোগে ১৯৭০ সালে নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের সহযোগিতায় নারায়ণগঞ্জে একটি বইমেলার আয়োজন করা হয়। এই মেলার ভেতরে একটি গরু বেঁধে রেখে তার গায়ে লিখে রাখা হয়েছিল ‘আমি বই পড়ি না’। ঘটনাটি সেই সময় ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। শিক্ষিতজনের বইমুখী হওয়ার ক্ষেত্রে ওই ঘটনাটি দারুণ অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল।
আজ এত বছর পর ঘটনাটি আবার মনে পড়ছে। ‘আমি বই পড়ি না’–এটা কোনও আধুনিক মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে না। জন্তু-জানোয়ার হলে বই পড়ার দরকার নেই। কিন্তু মানুষ হলে বই পড়তে হবে। বই পড়ার দরকার আছে!
লেখক: কলামিস্ট

/আইএ/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
কান উৎসব ২০২৪জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ