X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

৮০ বছর বয়সে জামায়াতের সফলতা কী?

আনিস আলমগীর
১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১৩:১৭আপডেট : ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১৩:২১

আনিস আলমগীর সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী জামায়াতে ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ১৯৪১ সালের আগস্টে এই সাম্প্রদায়িক দলটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মাওলানা মওদুদী সুপন্ডিত ব্যক্তি ছিলেন এবং মুক্তমনা স্বভাবেরও ছিলেন। ইসলামী আকিদার ক্ষেত্রে যুক্তি ও বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানকে কেন্দ্র করে ইসলামের প্রাথমিককালে আবির্ভূত হওয়া মোতাজিলা সম্প্রদায়ের লোকদের মতো ছিলেন তিনি। ধর্মের প্রতিষ্ঠিত রীতিনীতি বিরোধী কথা বলতেও দ্বিধা করতেন না। যেমন ইসলাম ধর্ম নবী রসুলদের সমালোচনার কোনও প্রশ্রয় দেয়নি কিন্তু মওদুদী তা মানতেন না। এসব কারণে মওদুদী এবং তার রচনাবলী সব সময় বিতর্কিত।
জামায়াত প্রতিষ্ঠার সময় বহু প্রতিষ্ঠিত আলেম তার সঙ্গে ছিলেন কিন্তু তার মুক্তমনা স্বভাবের কারণে তারা তাকে পরিত্যাগ করে চলে গিয়েছিলেন। রাজনীতিতে আসার আগে মওদুদী দীর্ঘদিন সাংবাদিকতাও করেছেন। মূলত গত শতাব্দির ত্রিশ এর দশকে হায়দারাবাদ থেকে প্রকাশিত ‘তরজুমান-আল কোরআন’ পত্রিকা সম্পাদনার মাধ্যমে তিনি তার ইসলামী চিন্তা ও দর্শন প্রচার করতে থাকেন। সে পত্রিকাই আসলে তার দল গঠনের ভিত্তি রচনা করে দিয়েছিলো। পত্রিকাটা পাঠকপ্রিয় ছিল। ইসলামের তাত্ত্বিক বিষয়ে আলোচনাই মুখ্যত ওই পত্রিকার উপজীব্য বিষয় ছিল।

মওদুদীর এই পত্রিকাটি মাওলানা আবুল কালাম আজাদের আল-হেলাল এর মতো স্বাধীনতার বিষয় নিয়ে কথা বলতো না বলে কখনও ব্রিটিশের কোপানলে পড়েনি। মাওলানা মওদুদী, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, মাওলানা হোসেন আহাম্মদ মাদানী বা মাওলানা হছরত মোহানীর মতো ভারত বিভক্তির বিরোধী ছিলেন। অবশ্য পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তিনি হায়দারাবাদ থেকে লাহোরে এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন এবং আমৃত্যু লাহোরেই ছিলেন।

জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা মওদুদী পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীরও আমির ছিলেন। ধীরে ধীরে পূর্ব-পাকিস্তানেও জামায়াতে ইসলামীর শাখা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। গত শতাব্দীর পঞ্চাশ দশকের দিকে তিনি পাকিস্তানি কাদিয়ানীদেরকে অমুসলিম ঘোষণা করেছিলেন এবং ঘোষণার পর পরই লাহোরে দাঙ্গা হয়। ওই দাঙ্গায় প্রায় পাঁচ লক্ষ কাদিয়ানী মারা যায়। দাঙ্গার মামলায় মাওলানা মওদুদীর ফাঁসির হুকুম হয়েছিলো। সৌদি বাদশার হস্তক্ষেপে পাকিস্তান সরকার তার ফাঁসির আদেশ রহিত করেছিলো। ১৯৭১ সালের পর মাওলানা মওদুদী রাজনীতি থেকে বিদায় নেন।

পূর্ব-পাকিস্তান বা বাংলাদেশ অংশে জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা আমির ছিলেন মাওলানা আব্দুর রহিম। সাধারণ সম্পাদক ছিলেন গোলাম আজম। স্বাধীনতার পর আবদুর রহিম জামায়াত নামে কোনও সংগঠন করতে ইচ্ছুক ছিলেন না। তিনি এবং মাওলানা ছিদ্দিক ‘ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ’ গঠন করেছিলেন। ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।

জনপ্রিয়তা তেমন না থাকলেও পাকিস্তানের উভয় অংশে জামায়াত ইসলামী মজবুত ভিত্তি  গড়ার চেষ্টা করেছিলো। কিছুটা সফলকামও হয়েছিলো। মাওলানা মওদুদী গত শতাব্দীর প্রথমদিকের মানুষ। কমিউনিস্ট আন্দোলন তিনি প্রত্যক্ষভাবে দেখেছেন। সম্ভবতো সে প্রভাবে তিনি যে কেউ আসলেই তাকে দলের সদস্য পদ দিতেন না। যাচাই-বাছাইয়ের বহু পদ্ধতি অনুসরণ করা হতো। কলেমা পড়লেই মুসলমান, অন্তরের খবর আল্লাহ্ জানে– তার সংগঠনের এটি রীতি বহির্ভূত ছিল। ১৯২৩ সালে আর এক ইসলামিক পন্ডিত হাসান আল বান্না মিশরে ইখওয়ানুল মুসলিমিন বা মুসলিম ব্রাদারহুড নামে একটা রাজনৈতিক সংগঠন গড়েছিলেন। এ সংগঠনটা মধ্যপ্রাচ্যে সর্বত্র গোপনে বা প্রকাশ্যে নিজের অস্তিত্ব জাহির করে রেখেছে। ইখওয়ানের যথেষ্ট সমাজ সেবামূলক কাজ রয়েছে। তারা মিশরে শত শত স্কুল, কলেজ, ব্যাংক, বীমা, হাসপাতাল গড়ে তুলেছে। মাওলানা মওদুদীও তার সংগঠনকে অনুরূপ কাজের মাঝে আত্মনিয়োগ করতে বলেছেন এবং তারা শৃঙ্খলার সঙ্গে তা করে যাচ্ছেন।

ভারতেও জামায়াতে ইসলামী আছে। তবে তারা ভারতে কোনও রাজনীতি করে না, এনজিও’র মতো সমাজ সেবামূলক কাজ করে। আসলে জামায়াতের মাঝে রাজনৈতিক চরিত্রের চেয়ে এনজিও চরিত্রটা প্রবল। সমাজসেবামূলক কাজ করার সময় তারা যে কোমলতার পরিচয় দেয়, রাজনীতির ক্ষেত্রে তার ঠিক বিপরীত। তারা চরম নিষ্ঠুর। বাংলাদেশের রাজনীতিতে হাত কাটা, রগ কাটা, হত্যা, গুম করে লাশ সেফটি ট্যাংকের ভেতরে ফেলে দেওয়ার কাজকর্ম তাদের হাত ধরে এসেছে। ইসলামের প্রথম যুগে মুসলমানের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে মুগ্ধ হয়ে অনেক অমুসলমান মুসলমান হয়েছেন। বাংলাদেশে জামায়াতিদের দুর্ভাগ্য যে অনুরূপ চারিত্রিক গুণাবলী শস্য পরিমাণও রপ্ত করতে পারেননি তারা।

জামায়াতে ইসলামী সবচেয়ে বিতর্কিত ভূমিকা পালন করেছে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়। তারাই রাজাকার বাহিনী গঠন করেছিলো। আল-বদর বাহিনীও তারা গঠন করেছে। আল-বদরকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাদের অঙ্গীভূত করে নিয়েছিলো। হত্যা, ধর্ষণ তাদের কাছে স্বাভাবিক ছিল। মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলামী, পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি- পাকিস্তান সমর্থক রাজনৈতিক সংগঠন ছিল সত্য কিন্তু কেউই জামায়াতে ইসলামীর মতো দেশের মানুষের ওপর এত নৃশংস অত্যাচার চালায়নি। আল-বদর বাহিনী ঢাকা চট্টগ্রাম নির্যাতন কেন্দ্র খুলে মানুষ তুলে নিয়ে নির্যাতন করে হত্যা করেছে। আবার প্রত্যেক জেলায় জেলায়ও নির্যাতন কেন্দ্র ছিল।

তারাই পথ দেখিয়ে পাকিস্তান বাহিনীকে গ্রামের অভ্যন্তরে নিয়ে যেত। তারা সুনির্দিষ্ট করে বলে দিত কোথায় কোথায় আগুন দিতে হবে। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্ব-মুহূর্তে তারা ঢাকা শহরে বাসা থেকে তুলে নিয়ে বহু বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করেছিলো। ১৯৭২ সালের শাসনতন্ত্রে সাম্প্রদায়িক দল গঠনের ওপর শাসনতান্ত্রিক বিধি-নিষেধ ছিল যে কারণে কোনও সাম্প্রদায়িক দল ছিল না। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর জিয়াউর রহমান বিধি-নিষেধ প্রত্যাহার করে নিলে পুনরায় সাম্প্রদায়িক দল গঠিত হয়। ১৯৭৬ সালে জামায়াত ইসলামীও পুনর্গঠিত হয়।

এখন দেখা যাচ্ছে তখনও জামায়াতে ইসলামীতে একদল লোক ছিল যারা জাতির কাছে ১৯৭১ সালের অপরাধের জন্য ক্ষমা চাইতে প্রস্তুত ছিল কিন্তু প্রবীণদের জন্য, যারা যুদ্ধাপরাধে জড়িত ছিল তাদের কারণে এটি করা সম্ভব হয়নি। এখন তাদের নিবন্ধন বাতিল হয়েছে, মার্কা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। শীর্ষ কয়েকজন নেতা যুদ্ধাপরাধে ফাঁসিতে ঝুলেছেন। প্রকাশ্যে দলীয় কর্মকাণ্ড চালানো অসম্ভব হয়েছে। অনুরূপ পরিস্থিতিতে এখন অনেক নবীনরা চাচ্ছে যে জামায়াত নামে কোনও সংগঠনের প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন হলে নতুন নামে দল গঠন করতে। দীর্ঘদিন বিষয়টি দলের মধ্যে থাকলেও সম্প্রতি দলীয় নেতা ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাকের পদত্যাগ এবং শিবিরের সাবেক সভাপতি মজিবুর রহমান মঞ্জুকে দল থেকে বহিষ্কারের পর দলের জাতির কাছে দলের ক্ষমা প্রার্থনা, দলের সংস্কার ইত্যাদি বিষয় মিডিয়ায় আসে।

জামায়াতের বয়স হয়েছে প্রায় ৭৯/৮০ বছর। এই দলটি তাদের হঠকারী সিদ্ধান্তের জন্য উল্লেখযোগ্য কিছুই করতে পারেনি। রাজনীতিতে তাদের সাফল্য বলতে কিছুই নেই। বিরাট ব্যবসা বাণিজ্য আছে আর কিছু কিছু এনজিওর মতো সেবামূলক কাজ আছে। যে রাজনৈতিক সংগঠন ব্যবসা করে তাকে দিয়ে রাজনীতিতে সাফল্য প্রত্যাশা করা যায় না। এ কারণে এত বয়স হওয়ার পরও জামায়াত ইসলামীর সফলতার কোটা শূন্য।

তার ওপর স্বাধীন দেশে বসে স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী হিসেবে চিহ্নিত, ঘৃণিত হওয়ার পরও জাতির কাছে অনুতপ্ত না হতে পারা তাদের চরম রাজনীতিক ব্যর্থতা। বৃহত্তর পরিসরে দেখলে জামায়াত পাকিস্তান সৃষ্টির বিরোধিতা করেছে, তারা বাংলাদেশ সৃষ্টির বিরোধিতা করেছে। তারা দু’ক্ষেত্রেই দেশভাগ চায়নি এমন সাফাইও দেওয়া সম্ভব ছিল তাদের। কিন্তু তারা ভুল স্বীকার করতে রাজি নয় স্বাধীনতার এত বছর পরও।

কারণ গোলাম আজম-নিজামীসহ তাদের শীর্ষ নেতারা বিশ্বাস করতেন ১৯৭১ সালে যুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তান থেকে পৃথক হয়ে যাওয়া ভুল ছিল– এটি একদিন এদেশের জনগণের কাছে প্রমাণিত হবে এবং তখনই তাদের ১৯৭১ সালের ভূমিকা সঠিক ছিল প্রমাণ হবে। বাংলাদেশ টিকবে না, টিকলেও ব্যর্থ রাষ্ট্র হবে। কিন্তু এখন স্বয়ং ইমরান খানসহ পাকিস্তানের শীর্ষ নেতারা স্বীকার করছেন তাদের ‘পূর্ব পাকিস্তান নীতি’ সঠিক ছিল না। পূর্ব পাকিস্তান পাকিস্তানের জন্য বোঝা ছিল- এই ধারণাও মিথ্যা ছিল। পূর্ব পাকিস্তানের মাটি চাই কিন্তু বাঙালিদের চাই না নীতিতে- তারা যে হত্যাযজ্ঞ এখানে চালিয়েছে সেটার জন্যও আনঅফিসিয়ালি পাকিস্তানিরা অনুতপ্ত।

সরকারেরও উচিত জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা। স্বাধীন দেশে কোনও হত্যাকারী সংগঠনকে ওই নাম নিয়ে রাজনীতি করতে দেওয়া উচিত না। অনেকে অভিমত রাখছেন জামায়াত জামায়াতই- যে নামেই ডাকা হোক। খোলস পাল্টালে লাভ নেই।

এখন জামায়াতেরও উচিৎ হবে ৭১ সালের পরে যারা জন্ম নিয়েছে তাদের নেতৃত্বে নতুন নামে সংগঠন করা। জামায়াত বিলুপ্ত করা। পুরনো লোকগুলো তাদের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নিয়ে থাকুক। যারা ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাপাচারে লিপ্ত ছিল তাদের এখন অব্যাহতি দেওয়া প্রয়োজন। পাপের পরিণতি শুভ হয় না। জামায়াত নেতৃত্ব যদি এতই গুণান্বিত হতো তবে তাদের নেতৃত্বে দীর্ঘ ৮০ বছর বয়সেও কোনও সফলতা আসলো না কেন? নব প্রজন্মের নেতা-কর্মীদের উচিত পুরনো নেতাদের দুষকর্মের বোঝা বহন না করে বরং দলটার বিলুপ্তির ঘোষণা করা। আশা করি নব-প্রজন্মের জামায়াত কর্মীদের শুভবুদ্ধির উদয় হবে এবং ঘাতক সংগঠনটির কবল থেকে জাতিকে পরিত্রাণ দেবে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ইরাক ও আফগান যুদ্ধ সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।

[email protected]

 

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
রুশ বিদ্যুৎকেন্দ্রে ইউক্রেনের হামলা, ৫০টি ড্রোন ভূপাতিতের দাবি মস্কোর
রুশ বিদ্যুৎকেন্দ্রে ইউক্রেনের হামলা, ৫০টি ড্রোন ভূপাতিতের দাবি মস্কোর
বিয়েবাড়ির খাসির মাংস খেয়ে ১৬ জন হাসপাতালে
বিয়েবাড়ির খাসির মাংস খেয়ে ১৬ জন হাসপাতালে
সরকারি প্রতিষ্ঠানে একাধিক পদে চাকরি
সরকারি প্রতিষ্ঠানে একাধিক পদে চাকরি
এখনই হচ্ছে না হকির শিরোপা নিষ্পত্তি, তাহলে কবে?
এখনই হচ্ছে না হকির শিরোপা নিষ্পত্তি, তাহলে কবে?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ