X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

দুই বাংলার ভাষা ও বাংলাদেশের আদি জন্মকথা

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী
২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১৪:০০আপডেট : ২৭ মার্চ ২০১৯, ১৮:৪৪

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী গঙ্গাপূজা করতে হয় গঙ্গার জল দিয়ে। মাতৃভূমিরও অর্চনা করতে হয় মাতৃভাষা দিয়ে। আজকে বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি সবই বহাল রয়েছে এবং সমৃদ্ধ হয়েছে ’৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের শহীদদের আত্মত্যাগের ফলে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বাংলা ভাষাকে মুসলমান বানানোর জন্য প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিলো। একদল প্রস্তাব করেছিলেন আরবি হরফে বাংলা লেখার জন্য, আরেক দল বলেছিলেন রোমান হরফে বাংলা লেখার জন্য। একদল চেষ্টা করেছিলেন ভাষায় আরবি, ফার্সি, উর্দু শব্দ ঢুকানোর জন্য, আবার আরেক দল চেষ্টা করেছিলো সংস্কৃতিক শব্দ ঢুকানোর জন্য। একদল চেষ্টা করেছিলো ভাষাটাকে টুপি পরিয়ে মোল্লা বানানোর জন্য, আরেক দল চেষ্টা করেছিলো পৈতা পরিয়ে ঠাকুর বানানোর জন্য।

পণ্ডিতেরা বলেছেন, ভাষা নদীর স্রোতের মতো। আপন মনে চলে। প্রয়োজন দেখা দিলে গ্রহণ করে আবার অপ্রয়োজনীয় মনে করলে বর্জন করে। বাংলা ভাষাভাষী লোক মূলত দুই সম্প্রদায় ভুক্ত। হিন্দু এবং মুসলমান। আবার বাংলাদেশটাও দুইভাগে বিভক্ত- পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম বাংলা। পূর্ব বাংলা আবার স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ নামে প্রতিষ্ঠিত। আর পশ্চিম বাংলা ভারতেরই অংশ। বাংলা, বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় ভাষা। পশ্চিম বাংলায় ভাষাটা প্রাদেশিক ভাষার মর্যাদা পায়। বাঙালি মুসলমান এবং বাঙালি হিন্দুর ভাষা এক কিন্তু শিক্ষাদীক্ষা এবং আধ্যাত্মিক আদর্শে উভয়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। এজন্য একের আদর্শ, ভাব, চিন্তাপ্রণালী ঠিক অন্যের মতো হতে পারে না। অতএব, সাহিত্যে উভয়ের ভিন্ন ভিন্ন ভঙ্গি আছে। ভারত বিভক্তির আগ পর্যন্ত এটি কোনও আকৃতি পায়নি। কারণ, তখন বাংলা সাহিত্যে কলকাতার বুদ্ধিজীবীদের একাধিপত্য ছিল। ১৯৪৭ সালের পরে তা স্পষ্ট স্বকীয় রূপটা পরিগ্রহ করে।
আমেরিকা আর ব্রিটেনের ধর্মও এক, ভাষাও এক। তবুও সবাই জানেন ইংরেজি সাহিত্য আর মার্কিন সাহিত্যে একটা ভাব ও ভঙ্গির প্রভেদ স্পষ্ট। ভাষা ও ধর্ম এক হলেও তথাপি ভেদাভেদ প্রকৃতি ভেদে ঘটেছে। বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলার ভাষা সাহিত্যেও অনুরূপ একটা ভেদাভেদ বিদ্যমান। বাংলা সাহিত্যের আধুনিককাল আরম্ভ হয়েছিলো পশ্চিম বাংলার মানুষের হাত ধরে। পূর্ব-বাংলার মানুষ ভাষা-সাহিত্যে পশ্চাৎপদ ছিল। অথচ বাংলা ভাষাকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করেছিলো মুসলিম শাসকেরা। তারাই বাংলা ভাষাকে সাহিত্যের ভাষা বানিয়েছিলেন।
হোসেন শাহ বাংলা ভাষার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি ভগবত পুরান বাংলা ভাষায় অনুবাদ করার জন্য মালাধর বসুকে নিযুক্ত করেছিলেন। হোসেন শাহ গৌড়ের নিকটে যে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তার মাথার ওপর লিখা ছিল ‘হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, যদি চীন দেশে যেতে হয় তবুও জ্ঞানের অনুসরণ করো।’ মুসলমানদের উৎসাহে বাংলা ভাষার প্রভূত উন্নতি হয়েছিলো। ১৭৫৭ সালে রাজ্য হারানোর পর মুসলমানেরা রাজ্য হারানোর শোকে ব্রিটিশের সঙ্গে অসহযোগিতায় কাল কাটিয়েছে প্রায় শতাধিক বছর। যখন সম্বিৎ ফিরে পেয়েছিলো তখন কানাকড়িও ছিল না, লেংটিই হয়েছিলো সম্বল।

১৯০৫ সালে পূর্ববঙ্গের পশ্চাৎপদতার কথা চিন্তা করে ঢাকাকে রাজধানী করে লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গ করেছিলেন কিন্তু কলকাতার বুদ্ধিজীবী সমাজের মায়াকান্নায় ১৯১১ সালে দিল্লির দরবারে বঙ্গভঙ্গ রহিত হয়ে যায়। পূর্ব বঙ্গের ললাট থেকে দুঃখ আর যায়নি। সম্ভবত সে কারণেই পূর্ব বঙ্গের মানুষেরা বিভক্তির পক্ষে ভোট দিয়েছিলো। জিন্নাহর একগুয়েমির জন্য বিভক্তিটাও সঠিকভাবে হয়নি। ১৯৪০ সালে লাহোরে মুসলিম লীগের অধিবেশনে প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিলো যে মুসলিম লীগ ভারতের উত্তর-পশ্চিম অংশে এবং পূর্ব অংশে মুসলমানদের জন্য দুইটা পৃথক রাষ্ট্রের দাবি করে।

হেক্টর বোলাইথো ‘জিন্নাহ দ্য ক্রিয়েটর অব পাকিস্তান’ নামে একখানা গ্রন্থ রচনা করেছেন। তার ১৪৯ ও ১৫০ পৃষ্ঠায় ১৯৪৪ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর তারিখে জিন্নাহকে লেখা গান্ধীর একটি চিঠির বিবরণী আছে। গান্ধী চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘আপনি যদি ১৯৪০ সালের প্রস্তাব এভাবে সংশোধন করেন সিন্ধু, বেলুচিস্তান সীমান্ত প্রদেশ এবং পাঞ্জাবের পশ্চিম অংশ নিয়ে পশ্চিম খণ্ড এবং বাংলা ও আসামের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলাগুলো নিয়ে পূর্ব খণ্ড গঠিত হবে। তবে তা মেনে নেওয়ার জন্য আমি কংগ্রেসকে সুপারিশ করবো।’

কিন্তু জিন্নাহ গান্ধীর প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছিলেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভক্তির সময় হুবহু গান্ধীর চিঠির নকশা অনুসারে পশ্চিম অংশে পশ্চিম পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু পূর্ব অংশ বিভক্ত হয়েছিলো রেড ক্লিফের খামখেয়ালি অনুসারে। যে কারণে ৭টি মুসলিম সমৃদ্ধ জেলা পূর্ব অংশ যোগ হয়নি। আমি খামখেয়ালি বলছি রেড ক্লিফের বই পড়ে। তিনি তার বইতে লিখেছেন, পাকিস্তানের সীমানা ঠিক করার পর মনে হলো পাকিস্তানের অংশে কোনও বড় শহর পড়েনি। তারা তাদের রাজধানী স্থাপন করবে কোথায়? তখন সীমানারেখাটা পূর্বদিকে সরিয়ে দিয়ে লাহোর পাকিস্তানকে দিয়ে দিলাম।

এ কারণেই বলছি যে বিভক্তিটা রেড ক্লিফের খামখেয়ালি মতো হয়েছিলো। বাউন্ডারি কমিশনে জিন্নাহ উকিল নিযুক্ত করেছিলেন যুক্তপ্রদেশের ওয়াসিমের মতো একজন অখ্যাত উকিলকে। হামিদুল হক চৌধুরী ছিলেন তার সহকারী। অথচ হক সাহেবের মতো আর সোহরাওয়ার্দীর মতো নামজাদা উকিলেরা জিন্নাহর কাছে উপেক্ষিত হয়েছিলেন। খাজা নাজিম উদ্দীন তখন বিভক্তির বিষয়ে উপযুক্ত নজরদারি না করে মুখ্যমন্ত্রিত্ব নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন।

১৮৮৭ সালে আসামকে প্রদেশ করার সময় রাজস্ব ঘাটতি মেটানোর জন্য সিলেট, গোয়ালপাড়া, কাচাঢ় জেলাকে আসামের সঙ্গে যুক্ত করেছিলো। অথচ এগুলো ছিল বাংলার জেলা এবং মুসলিম সমৃদ্ধ এলাকা। গণভোট হলো শুধু সিলেট নিয়ে। কাচাঢ় আর গোয়ালপাড়া বিনা বাক্যব্যয়ে আসামের সঙ্গে রয়ে গেলো। ৫৭ হাজার ভোটে জেতার পরেও সিলেটের করিমগঞ্জ মহকুমাকে ভারতকে দিয়ে দিয়েছিলো।

বাংলাদেশের মাত্রচিত্রটা দেখলে চোখে জল আসে। কত নির্মমভাবে দেশটাকে কাটাছিঁড়া করে বিভক্ত করা হয়েছিলো। ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে আমার এসব আলোচনা প্রসঙ্গিক হচ্ছে কিনা জানি না। তবে বাঙালি জাতির সঙ্গে নির্মম আচরণের কথাগুলো এ প্রজন্মের জানা দরকার বলে লিখলাম। ১৯৪৭ সালে ৫ এপ্রিল তারকেশ্বরে বঙ্গীয় হিন্দু মহাসভার সম্মেলনেও হিন্দু সমৃদ্ধ জেলাগুলো নিয়ে পশ্চিমবাংলা গঠনের প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিলো। এরপরেও মালদহ, মুর্শিদাবাদ, পশ্চিম দিনাজপুর ও জলপাইগুড়ি জেলা বাংলাদেশ থেকে বাদ যায় কীভাবে! যেখানে মুসলমানেরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর জিন্নাহ ১৯৪৮ সালে উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষার করার প্রস্তাব করলে বাঙালিদের দীর্ঘ সময়ের পুঞ্জিভূত দুঃখ বেদনার বিস্ফোরণ ঘটে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের আত্মাহুতির পর অসন্তোষ গণবিস্ফোরণ রূপ নেয়। প্রফেসর আবুল কাসেম তমদ্দুন মজলিশ গঠন করে ভাষা আন্দোলন প্রথম শুরু করেন। তমদ্দুন মজলিশ চেয়েছিলো পাকিস্তানের কাঠামোতে ভাষার অধিকার আদায় করা কিন্তু ছাত্রলীগ ধীরে ধীরে পাকিস্তানের কাঠামো ছিন্ন করে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার দিকে অগ্রসর হয়।

১৯৪৯ সালে ২৩ জুন পুরনো ঢাকার রোজ গার্ডেনে আওয়ামী লীগের জন্ম হয়। সভাপতি হন মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, সাধারণ সম্পাদক হন শামসুল হক আর যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৫৩ সালে শামসুল হকের মস্তিষ্ক বিকৃতি হলে শেখ সাহেব দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৭ সালে পররাষ্ট্র নীতি নিয়ে সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে মওলানা ও তার সমর্থকদের বিরোধ হলে মওলানা ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠন করে আওয়ামী লীগ ত্যাগ করেন। ১৯৬৩ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যু হলে শেখ মুজিব আওয়ামী লীগকে পুনরুজীবিত করেন। পরবর্তী সময়ে শেখ মুজিব ৬ দফা প্রস্তাব পেশ করেন। ১৯৬৬ সালের ইডেন কাউন্সিলে ৬ দফা আওয়ামী লীগের কর্মসূচি হিসেবে গৃহীত হয়।

৬ দফার ভিত্তিতে আওয়ামী লীগ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। আসলে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে ৬ দফার ওপর গণরায় চেয়েছিল। গণরায় তাদের পক্ষে এসেছিল। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন, শেখ আব্দুল আজিজ, আব্দুস সামাদ আজাদ, জহুর আহাম্মদ চৌধুরী, এমএ আজিজ প্রমুখ। তারা আবার সবাই ছিলেন ভাষা আন্দোলনের নেতা। আসলে একটি ভাষাকে কেন্দ্র করে একটা দেশের জন্ম, তার উদাহরণ হলো বাংলাদেশ।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক
[email protected] 

/আইএ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখলে আমাদের লজ্জা হয়: শাহবাজ
বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখলে আমাদের লজ্জা হয়: শাহবাজ
৬ ম্যাচ পর জয় দেখলো বেঙ্গালুরু 
৬ ম্যাচ পর জয় দেখলো বেঙ্গালুরু 
সাদি মহম্মদ স্মরণে ‘রবিরাগ’র বিশেষ আয়োজন
সাদি মহম্মদ স্মরণে ‘রবিরাগ’র বিশেষ আয়োজন
‘নীরব এলাকা’, তবু হর্নের শব্দে টেকা দায়
‘নীরব এলাকা’, তবু হর্নের শব্দে টেকা দায়
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ